mihir

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২৩ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা 

ড. মিহির কুমার রায়: ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় পূর্বাচলের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি) মেলা উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা। মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার এটি ২৭তম আসর। প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথমবার যখন এখানে বাণিজ্য মেলা হয় করোনার কারণে আসতে পারিনি, ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছিলাম, তবে ডিজাইন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমি ছিলাম। এজন্য এখানে আসার আগ্রহ বেশি। তিনি বলেন, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশের অর্থনীতি হিমশিম খাচ্ছে, তবুও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২৩ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, এফবিবিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ এইচ এম আহসান।

দুই বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থেকে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন যার ফলে এবার ব্যাপক পরিসরে বাণিজ্যমেলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যমেলায় সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও পণ্য বহুমুখীকরণে। বাংলাদেশি পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরা এবং স্পট অর্ডার বাড়ানোর ওপর গুরত্ব দেওয়া হয়েছে, পোশাক, চামড়া ও মাছের পাশাপাশি রপ্তানিকৃত আরও ১০টি পণ্যকে টার্গেট করা হয়েছে, যাদের বিক্রি হবে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। রাজধানীর উপকণ্ঠ পূর্বাচল নতুন শহরের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যৌথভাবে বাণিজ্যমেলার আয়োজন করেছে এবং আবার মেট্রোরেলের আদলে বাণিজ্যমেলার মূল প্রবেশপথ তৈরি করা হয়েছে ।

বাণিজ্যমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এবারের মেলায় ব্যাপক দর্শক ও ক্রেতা সমাগমের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা উঠছে বাণিজ্যমেলার। দে শিপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এবার ১০টি দেশের ১৭টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করছে, ক্রেতারা যাতে মেলা থেকে ভালো মানের পণ্য কেনাকাটা করতে পারেন সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছে, কেনাকাটা করে কেউ যেন না ঠকেন সে লক্ষ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিশেষ টিম সার্বক্ষণিক মেলায় কাজ করবে, খাদ্যপণ্যের দাম বেশি নেওয়া যাবে না যার এজন্য দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবেএবং চুরি, ছিনতাই ও ইভটিজিং রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে মেলায়। এছাড়া ক্রেতা-দর্শনার্থীরা কোনো ঝামেলায় কিংবা অসুবিধায় পড়লে যে কোনো বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। এজন্য একটি অভিযোগ বাক্স খোলা হয়েছে। টিপু মুনশি বলেন, এবার টিকিটের দাম বাড়ানো হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ বিনা টিকিটে মেলা পরিদর্শন ও কেনাকাটা করতে পারবেন এবং বিকাশে পেমেন্ট করে টিকিট কাটতে পারবেন অর্ধেক টাকায়। 

উল্লেখ্য, মেলায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারের বাণিজ্যমেলায় দেশীয় বস্ত্র, মেশিনারিজ, কার্পেট, কসমেটিক্স অ্যান্ড বিউটি এইডস, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্সস, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া বা আর্টিফিসিয়াল চামড়া ও জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, স্পোর্টস গুডস, স্যানিটারিওয়্যার, খেলনা, স্টেশনারি, ক্রোকারিজ, পাস্টিক মেলামাইন পলিমার, হারবাল ও টয়লেট্রিজ, ইমিটেশন জুয়েলারি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফাস্টফুড, হস্তশিল্পজাত পণ্য, হোম ডেকর, ফার্নিচার ইত্যাদি পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে।

এবারের বাণিজ্যমেলায় ঢাকা থেকে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রথম পর্যায়ে ৭০টি বিআরটিসি বাস ঢাকা কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে মেলার স্থায়ী ভেন্যু পর্যন্ত যাওয়া আসা করছে, তবে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের চাপ বাড়লে সেক্ষেত্রে ১৫০টি বাস নিয়োজিত করবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ। এবার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ টাকা। এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ব্যাপক লোকসমাগম হবে এমনটি বিবেচনায় নিয়ে এবার আগেভাগে পূর্বাচলের রাস্তা সংস্কার কাজ প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে।

মেলায় আসতে ক্রেতা-দর্শনার্থীরা এখন আর কোন সমস্যায় পড়বেননা, তারা নির্বিঘ্নে আসতে পারবেন, প্রতিদিন সকাল ১০টায় শুরু হয়ে মেলা চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ যে কোনো ছুটির দিনে মেলার সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হবে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার পাশাপাশি এখানে সারাবছর মেলা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পৃথকভাবে মেলা আয়োজনের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। বাণিজ্যমেলা থেকে সরকারের আয়ের বিষয়টি মুখ্য নয়, মূলত বিদেশিদের কাছে দেশি পণ্য তুলে ধরাই মূল লক্ষ্য। এতে করে রপ্তানি বাড়বে, পাশাপাশি দেশী পণ্যের উৎপাদন ও অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করা করা।

এখানে উল্লেখ্য যে গত বছর মেলা থেকে ২০০ কোটি টাকার বেশি স্পর্ট অর্ডার এসেছিল, এবার আরও বেশি হবে বলে  আশা করা যায়। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই মেলার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আর সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়ানো, প্রতিবছর আমাদের রপ্তানি বাড়ছে, গত বছর আমাদের ৫১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আমরা ৬০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছি, এ বছর ৬৭ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তারপরও কোভিড পরবর্তী অবস্থা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও  আশা করা  যাচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্জন করতে পারা যাবে  কারন এ বছর মেলার পরিধি বাড়ানো হয়েছে  এবং গত বছরের তুলনায় ১০০টির বেশি স্টল অংশ নিয়েছে। এদিকে, বাণিজ্যমেলার আয়োজন ও সাজসজ্জার ক্ষেত্রেও এসেছে বড় পরিবর্তন। গতবার যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ ছিল ব্যবসায়ীদের, এবার সেই দুর্ভোগ কমাতে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নজর। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কা ন সেতু পেরিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে (ঢাকা বাইপাস) ধরে কিছুটা এগোলেই পূর্বাচল উপশহরের ৪ নম্বর সেক্টর যেখানে গড়ে উঠেছে ২৮ একর আয়তনের বিবিসিএফইসি। 

এখন আবার প্রশ্ন উঠেছে অপ্রস্তুত বাণিজ্য মেলা, হতাশ দর্শনার্থীরা কারণ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় চতুর্থ দিনে বুধবার পর্যন্ত ২০ শতাংশ স্টলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা, অবকাঠামোর কাজ শেষ না হওয়ায় হতাশা নিয়ে ফিরছেন দর্শনার্থীরা, মেলা প্রাঙ্গণ পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের বিক্রিও বাড়ছে না, পাশাপাশি ঘন কুয়াশা ও শীতের কারণে সকালের দিকে তেমন দর্শনার্থী আসছে না, ব্যবসায়ীরা জানান, মেলায় দর্শনার্থীদের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও বিক্রি একেবারেই নগণ্য। 

ইবিপি সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পূর্বাচল নতুন শহরের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চাযনা ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি) বাণিজ্য মেলার ২৭তম আসরে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৩১টি, এর মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে প্যাভিলিয়ন রয়েছে ৫৭টি এবং মেলায় ভারত, পাকিস্তান, হংক, তুরস্কসহ ১০টি দেশের ১৭টি স্টল রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় কিছুটা ক্রমানয়ে বেড়েছে, তবে মেলার মূল ভবনের পশ্চিমাংশের বেশির ভাগ স্টলের নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি, মূল ভবনের পূর্ব পাশের ইলেকট্রনিকস, কসমেটিকস ও ফার্নিচারের শোরুমের জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে, এখনো বেশ কিছু ফার্নিচারের দোকানের নির্মাণকাজ চলছে, এ ছাড়া অনেক স্টলের নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো মালামাল সাজাতে ব্যাস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা।

মেলা প্রাঙ্গণে স্টল নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত কাঠ, বাঁশসহ নানা জিনিস পড়ে থাকতে দেখা গেছে, এতে কিছুটা ঘিঞ্জি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে কারণে মেলার সৌন্দর্য অনেকটা নষ্ট হচ্ছে। তবে আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সব স্টলের নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা জানান, প্রতিবছরই অপ্রস্তুত অবস্থায় মেলা শুরু করা হয় যা খুবই হতাশাজনক। দর্শনার্থীরা দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় ঘুরতে আসেন। কিন্তু ৪০ টাকা টিকিট কেটে মেলায় এসে দেখে যদি এখনো অপ্রস্তুত তবে কেমন হয়। ইপিবি কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল সবগুলো স্টল যাতে মেলা শুরুর আগে থেকেই নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে কড়া নজরদারি বাড়ানো।

অনেকেই বলেছেন, স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আজকে মেলায় ঘুরতে এসেছিলাম, মেলার সামনের দিকের পরিবেশ অনেক চাকচিক্যময় ও সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে, তবে ভেতরের অনেক অংশে এখনো স্টলের নির্মাণকাজ চলছে। এটি আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক ।দোকানের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ঢাকা থেকে মেলা এখানে স্থানান্তর হওয়ায় তাদের জন্য কিছুটা অসুবিধা হয়ে গেছে। এখানে দোকানের জন্য কর্মচারী নিয়োগ দেয়া, মালামাল আনা-নেয়ায় ঝামেলার কারণে অনেকেরই দোকান নির্মাণে কিছুটা দেরি হয়েছে। এছাড়া মেলায় আসতে এশিয়ান হাইওয়ে বাইপাসে দীর্ঘ যানজট রয়েছে। তারপরও আশা করা যায় মাসব্যাপি মেলার শুরুটা যাই হউক না কেন শেষটা   ভার হবে এভং আর্ন্ত্য্রাতিক বাজারে দেশের ভাবমুর্তি বাড়বে সে আশাই রইল ।

লেখক: অধ্যাপক(অর্থনীতি), ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, সাভার, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/এসএল/এসএএম//
 


Comment As:

Comment (0)