দারিদ্র্য দূরীকরণে নোবেলজয়ী ত্রয়ী অর্থনীতবিদই এখন বিতর্কিত

শীতার্ত মানুষের মানবিক সাহায্যে এগিয়ে আসুক সমাজ

ড: মিহির কুমার রায়: পৌষের শীতে রাজধানীসহ সারাদেশ কাঁপছে। শীতের তীব্রতায় উত্তর জনপদে জনজীবনে নেমে আসছে দুর্ভোগ। ঘন  কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে জেলার জনপদ। দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে সড়কগুলোতে চলছে যানবাহন।  কনকনে শীতে বিপাকে পড়েছেন খেটে-খাওয়া মানুষ। নদীর তীরবর্তী অববাহিকায় বসবাস করা শিশু বৃদ্ধদের মধ্যে দেখা  দিয়েছে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। শীতে বিপর্যস্ত রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন। হাড় কাঁপানো কনকনে শীতে  বের হয়েও অনেকের মিলছেনা কাজ। ঘন কুয়াশা আর বাতাস শীতকে আরও প্রবল করেছে।  বিশেষ করে ঢাকায় দিনমজুর-নিম্ন আয়ের মানুষের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। দিনমজুর একদল লোককে জটলা করে বসে থাকতে দেখা যায় মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের সামনে। এখানে তারা প্রায় প্রতিদিনই বসে থাকেন কাজের আশায়। কাজ মিলেও যায়। কিন্তু শীতের কারণে কতদিন ধরে সমস্যা হচ্ছে। শীতবস্ত্রের অভাবে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বেলে  শীত নিবারণের চেষ্টাও করছে অনেকে। শৈত্য প্রবাহের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকায় এসব মানুষের কষ্ট কেবল বাড়ছেই। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। আগামী দিনগুলোতে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগ বাড়বে বহু গুণে। অতীতে আমরা দেখেছি, শীত নিবারণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না  থাকায় শীতের তীব্রতায় অনেকে প্রাণ হারান। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় কুয়াশাও বাড়ছে। অনেক এলাকায় ঘন কুয়াশা দুপুর পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এই চিত্র দেখা যায় প্রতি বছরই। প্রতিবারের মতো এবারও দেশের  উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রচন্ড শীতের কারণে এই অঞ্চলের মানুষজন বাইরে পর্যন্ত  বের হতে পারছেন না, অচল হয়ে পড়েছে অধিকাংশ এলাকা। শীতের তীব্রতার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ, যেমন দিনমজুর  শ্রেণি, যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, যারা ছিন্নমূল মানুষ, যাদের ঘর বাড়ি নেই, তাদের দুঃখ-কষ্টের যেন শেষ নেই! সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন জ্বালিয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। প্রচন্ড শীতের কারণে ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে যারা শিশু ও বৃদ্ধ তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে রোগ ব্যাধি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  নিউমোনিয়া প্রকোপ ছড়াচ্ছে। অনেকেই ভুগছেন শ্বাস কষ্টে। শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করার জন্য আমরা রকমারি শীতবস্ত্র  পরিধান করছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা যে পথ দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছি, সেই পথে বসবাসরত মানুষগুলোর দিকে একটু খেয়াল করলে দেখতে পাই শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করার জন্য তাদের কেউ কেউ কেবল  একটি চটের বস্তা গায়ে জড়িয়ে দিনরাত কাটানোর প্রহর গুনছেন! কেউ আবার পলিথিন ব্যাগ গায়ে চাপিয়ে শীতের প্রকোপ  থেকে রক্ষা পাওয়ার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন। কী সাংঘাতিক সব দৃশ্য! কেউ কেউ শুকনো খড় কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাপ  পোহাচ্ছেন আর অপেক্ষা করছেন তপ্ত রবির আলোর জন্য, যা তাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসবে একটু উষ্ণতা! এসব দৃশ্য মেনে  নেওয়া যারপর নাই কষ্টকর। 

শীতার্ত মানুষের জীবনের গল্প বলে শেষ করার নয়। কথা হয় আবুয়াল মিয়ার সঙ্গে, ৬৫ বছর বয়সী এই দিনমজুর বলেন,  ‘আইজ দুই দিন ধরি কোনো কাম পাইনা। ঘরে খাবার নাই। এই ঠান্ডায় মুড়ি খায়া আছি।’ ঢাকা  উদ্যানের বস্তিতে আবুয়াল মিয়া পরিবার নিয়ে থাকেন। বউ ও ছেলে-ছেলের বউ এবং নাতি-নাতনি মিলে ছয় জনের সংসার  তার। আবুয়াল মিয়া বলেন, ‘কাইল আমার বউ বাসাবাড়ির কামে যাইতে দেরি হওয়ায় তার চাকরি চলে গেছে। এখন  ছেলে রিকশা চালায়। সেই রোজগারে চলছে তাদের ছয় জনের খাওয়া। চা-বিক্রেতা রায়হান হোসেন বলেন, প্রতিদিন বেলা  ১১টা পর্যন্ত তিন ফ্লাক্স চা বিক্রি হতো। কিন্তু কদিন ধরে দুই ফ্লাক্সে নেমেছে। তিনি গাবতলী থেকে কল্যাণপুর ও  শ্যামলী বাস স্ট্যান্ডে চা বিক্রি করেন। রায়হান মিয়া বলেন, বেচা-বিক্রি না হলে না খেয়ে থাকতে হবে। তিনি বলেন,  ‘গরিবের শীত-বৃষ্টি-ঝড় তুফান সব কিছুতেই বিপদ। ঘরে বউ-বাচ্চা আছে, বেচা-বিক্রি না হলে ঘরে রান্না হবে না। আমরা এমনিতেই ডাল-ভর্তা ভাত খাইয়া দিন কাটাই। 

উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীতে কুড়িগ্রামে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। আকাশে ঘন মেঘে সূর্য ঢেকে থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় প্রাকৃতিক উষ্ণতাও পাচ্ছে না মানুষজন। এছাড়া গত কয়েকদিন বরিশালে তীব্র শীত অনুভূত হওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জনজীবন। এ অবস্থায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে পেশাজীবী মানুষ। তবে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। প্রয়োজন ছাড়া অনেকে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। কুড়িগ্রাম আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা দিনে দিনে আরও কমতে পারে। আকাশে ঘন মেঘ কেটে গেলে তাপমাত্রা আরও নিচে নেমে আসতে পারে। তীব্র শীতে গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদিপশুও পড়েছে কষ্টে। অন্যদিকে শীতবস্ত্রের অভাবে চরম কষ্টে দিন পার করছে জেলার নিম্ন আয়ের মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকে। সদর উপজেলার পাঁচ গাছী ইউনিয়নের মিল পাড়া এলাকার বেলাল  হোসেন বলেন, এই শীতে ছোট ছোট দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছি। শীতকালে ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় সংসার চালানোয় কঠিন হয়ে পড়েছে। অভাবের সংসার ছেলেদের জন্য  শীতের কাপড় কিনব তাও পারছি না। স্থানীয়রা জানান, হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দুই পর্বতশৃঙ্গ নিকটে হওয়ায় এই  জেলায় শীতের তীব্রতা বেশি হয়ে থাকে। বিকেল গড়ালেই উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বইতে থাকে ঠান্ডা বাতাস। সন্ধ্যার পর  বাতাসের সঙ্গে ঝরতে থাকে কুয়াশা। এই সময়টাতে মাত্রাতিরিক্ত শীত অনুভূত হয়। রাতে কম্বল ও  লেপ নিলেও বিছানা বরফের মতো লাগে গৃহিণীরা জানান, রাতে কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। ঘরের আসবাবপত্র, বিছানাপত্র  থেকে শুরু করে ফ্লোর, দরজা স্পর্শ করলে হাত অবশ হয়ে আসে, রাতে ও সকালে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে হচ্ছে। শীতের তীব্রতায় জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। এদিকে শীতের কারণে বিপাকে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর খেটে-খাওয়া মানুষ। পাথর শ্রমিক, চা-শ্রমিক, দিনমজুর থেকে শুরু করে ছোটখাটো যানবাহন ও ভ্যান চালকরা পড়েছেন বিপাকে। ভোর-সকালে শীতের তীব্র প্রকোপের কারণে কাজে যেতে পারছেন না অনেকে। তবুও পেটের তাগিদে কাউকে নদীতে পাথর তুলতে, কাউকে চা-বাগানে আবার কাউকে দিনমজুরের কাজ করতে যেতে দেখা গেছে। শীতের দুর্ভোগ বেড়েছে শিশু ও বয়স্কদের। শীতার্ত মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার যে ত্রাণ দিয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। চা-শ্রমিক জাহেরুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন, আরশেদ ও আরিফ বলেন, দুদিন ধরে কুয়াশা না থাকলেও মেঘলা পরিবেশ রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় ঠান্ডা বাতাস। এ বাতাসের কারণে শীতের মাত্রা বেড়ে যায়। চা বাগানে কাজ করতে  গেলে হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে কাজে বের হতে হয়। পাথর শ্রমিক জুয়েল, ইমরান ও  জাকির বলেন, ঠান্ডায় নদীর পানি বরফের মতো মনে হয়। তারপরও আমাদের পাথরই জীবিকা। তাই কাজে বেড়িয়েছি।  কদিন ধরে নদীর ঠান্ডা পানিতে কাজ করে জ্বর-সর্দিতে ভুগলাম। কিন্তু পরিবারের কথা চিন্তা করে সকালেই পাথর  তোলার সরঞ্জাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছি। কবির হোসেন ও হুমায়ুন কবির নামে দুই ফ্রিল্যান্সার বলেন, রাতটা বরফ হয়ে উঠে।  তাপমাত্রা যেন শূন্যে চলে আসে। আমাদের রাতে বসে কাজ করতে হয়। কিন্তু শীতের তীব্রতার কারণে বসে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে শীতের প্রকোপে বেড়েছে নানা ঠান্ডাজনিত রোগ। জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাস কষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১টা  পর্যন্ত শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থায় বলা হয়েছে, উপ মহাদেশীয় উচ্চ চাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের শৈত্য প্রবাহে নাজেহাল পরিস্থিতিতে পড়েছে উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের মানুষ। টানা এক সপ্তাহ জুড়ে শীতল বাতাস আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বিপাকে পঞ্চগড়ের মানুষ। রাত ৮-৯টার মধ্যে শহরের হাট-বাজারগুলোতে কমে যায় কোলাহল। ভোর থেকেই বেলা অবধি ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকছে জেলার চারপাশ। কুয়াশার কারণে মধ্যরাত থেকে বেলা বাড়া পর্যন্ত সড়ক-মহাসড়কগুলোতে বিভিন্ন যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হয়। প্রয়োজন ছাড়া অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী ও কর্মজীবীরা। সকালে সূর্যের দেখা মিলছে না। হাট-বাজারে কাগজ, টিউব পুড়িয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে অনেককে। নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন ফুটপাতের দোকানে গরম কাপড় কিনছে।

এ ধরনের একটি মানবিক বিপর্যয়ে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের দেয়া মানবিক সাহায্য জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই শীতার্তদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে, শীতের প্রকোপ আরো বাড়ার আগেই সমাজের গরিব ও অসহায় মানুষদের রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে, সত্যি বলতে, শীতার্তদের শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করা অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে নয় - দরকার কেবল সদিচ্ছা, সময়োচিত উদ্যোগ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শীতার্তদের সাহায্য করা হয় যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এই অবস্থায় যৎসামান্য ভালোবাসা ও সহানুভূতিই পারে শীতার্ত মানুষের হৃদয়ে উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দিতে। তাই আসুন, স্ব স্ব অবস্থান থেকে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই। এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আবার প্রমান করি বাঙ্গালিরা সবি পারে এবং আগামিতেও পারবে।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)