দারিদ্র্য দূরীকরণে নোবেলজয়ী ত্রয়ী অর্থনীতবিদই এখন বিতর্কিত

জি-২০ সম্মেলন ও বৈশ্বিক অর্থনীতি

ড: মিহির কুমার রায়: জি-২০ গ্রুপ ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠালাভ করে বিশ্বে সাতটি শিল্পোন্নত দেশ নিয়ে জি-৭ নামে এবং এই  গ্রুপ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ১৯ টি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ নিয়ে যার মধ্যে রয়েছে জি-৭ ভূক্ত দেশ (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী, ইউকে, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ও আর্জেন্টীনা, অষ্ট্রেলীয়, ব্রাজিল, চায়না, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, সৌদি আরব,  দক্ষিন আফ্রিকা, টারকি ইত্যাদি ছাড়াও রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর প্রেসিডেন্টসহ ইউরো জোনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের  প্রেসিডেন্ট রয়েছে। জি-২০ গ্রুপে আরও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে যেমন বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি। এই সংস্থাটির মূখ্য উদ্দেশ্য হলো শিল্পন্নোত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনেতিক ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করা যার মধ্যে রয়েছে আর্থিক খাত, কর কাঠামো, আন্তর্জার্তিক আর্থিক খাতের সংস্কার ইত্যাদি। এছাড়াও এই সংস্থা অনানুষ্ঠানিকভাবে আর্থিক সংকটকে বিবেচনায় রেখে ব্রিটন উড পদ্ধতির রুপান্তর সাধন করে থাকে। এই জি-২০ গ্রুপের সভা বছরে একবার হয়ে থাকে এবং এই সকল সভার আলোচনার এজেন্ডা থাকে সাধারনত: প্রবৃদ্ধির নীতিমালা, আর্থিক পদ্ধতির দুর্বলতা নিরীক্ষন ও অবৈধ আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়। এই সংন্থাটির অন্যান্য সংস্থার মত কোন সচিবালয় কিংবা স্টাফ নেই, এর পরিবর্তে এটি একজন চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে যা বাৎসরিকভাবে ২০টি সদস্য দেশের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ঘূর্নিয়মান অবস্থায় বিচরন করে থাকে যাকে বলা হয় ট্রইকা চেয়র যেমন বর্তমান-আগে-পরে যাদের কাজ হলো বাৎসরিক সভার এজেন্ডা নির্ধারন, বক্তা নিরুপন এবং অন্যান্য পরিসেবার সুপারিশকরন। এ ছাড়াও বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ার সংন্থার সচিবালয় তথা সভা গঠনের সমন্বয়কারি হিসাবে কাজ করে থাকে যেমন ২০০৯ সালে জি-২০ গ্রুপ এর চেয়ার করেছিল ইউ.কে. ২০০৫ সালে চীন।

জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এবার সভাপতিত্ব করছে ভারত। গ্লোবাল সাউথ হিসেবে পরিচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন সংকট তুলে ধরতে চাইছে ভারত। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বিভাজন ভারতকে কঠিন কূটনৈতিক পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। এই সম্মেলনে যোগ দিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং নয়াদিল্লিতে রয়েছেন। নয়াদিল্লিতে জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ বড় পর্দায় সম্প্রচার করা হয়। এবং বিভেদ ভুলে উন্নয়নশীল বিশ্বের সংকট সমাধানের দিকে নজর দিতে জি-২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘এক গভীর বৈশ্বিক বিভাজনের সময়ে আমরা এ বৈঠকে অংশ নিচ্ছি। আজকে এই কক্ষে যারা উপস্থিত নেই, তাদের প্রতিও আমাদের অনেক দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। ইংরেজিতে রেকর্ড করা মোদির উদ্বোধনী ভাষণ সম্প্রচার করা হয় যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা সরাসরি উল্লেখ না করলেও মোদি স্বীকার করেছেন, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবারের সম্মেলনে প্রভাব ফেলবে। মোদি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, সন্ত্রাসবাদ এবং যুদ্ধের মতো ঘটনা দেখেছি। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিশ্ব ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। মোদি আরও বলেন, ‘যেসব সমস্যা আমরা  সম্মিলিতভাবে সমাধান করতে পারব না, সেসব সংকট তৈরিই হতে দেয়া যাবে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বড় ফারাক রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ চীন ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি নিন্দা জানায়নি। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণে ভারতের ওপর চাপ বাড়ছে। ভারত এখনো পর্যন্ত ওই চাপ সামলে যাচ্ছে এবং সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা থেকে বিরত থাকার  কৌশলে অটল রয়েছে। রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। এ ছাড়া ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে  তেল আমদানি আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা না জানালেও গত বছর রুশ  প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে মোদি বলেছিলেন, ‘এটা যুদ্ধের সময় নয়।’ এমন পরিস্থিতিতে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে ভারত কীভাবে সম্মেলন সফল করবে, তার দিকে বিশ্বের নজর রয়েছে।  ভারতের এক সাবেক কূটনীতিক বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতকে এমন বিশেষ কিছু করতে হবে যাতে এই নেতারা যুদ্ধের বিভেদকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হন।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখা ভারতকে বিশ্বের অন্যান্য  দেশের প্রতি একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাতে গেলে খুবই সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের ব্যাঙ্গালুরতে গত  সপ্তাহে জি-২০ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন কোনো মতৈক্য ছাড়াই শেষ হয়। ওই সম্মেলনে সমাপনী বিবৃতিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ভাষায়’ নিন্দা জানানো হলে ওই বিবৃতি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় মস্কো এবং বেইজিং।

এবারের জি-২০ সম্মেলনের জন্য ভারতের স্লোগান হলো, ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ।’ বৃহস্পতিবারের (২রা ফেব্রুয়ারী) অধিবেশনে খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নয়ন সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ এবং মানবিক সহায়তার মতো ইস্যুগুলো আলোচনা হয়েছে। এদিকে মোদির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেই দিন সম্মেলনে ইউক্রেন যুদ্ধ ছায়া ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। কারণ  সম্মেলনের আগেই জি-২০ নেতাদের কেউ কেউ যুদ্ধ নিয়ে কড়া বক্তব্য দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা কৌশল বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘অবশ্যই এই যুদ্ধের নিন্দা জানানো উচিত। আমি আশা করি, ভারত তাদের কূটনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে রাশিয়াকে এটা বোঝাতে পারবে যে, এই যুদ্ধ শেষ করতেই হবে।’ অন্যদিকে গত বুধবার (১লা ফেব্রুয়ারী) ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কায়াত্রা বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ এবারের জি-২০ সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। এ ছাড়া খাদ্য, জ্বালানি এবং সার সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো সহ সংঘাতের প্রভাবে আমরা বর্তমানে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি, তাও আলোচনায় গুরুত্ব  পেয়েছে।

দিল্লিতে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-টোয়েন্টির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আলোচনায় সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ। এই নিয়ে তীব্র মতবিরোধে দুই পক্ষের মধ্যেই হয়েছে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। যার জের ধরে এর  আগে বেঙ্গালুরর জি-টোয়েন্টির অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনের মতো দিল্লির এই সম্মেলনেও কোনো যৌথ  বিবৃতি আসছে না বলে জানিয়েছে আয়োজক দেশ ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর এক বছর পর এই সম্মেলনেই প্রথম মুখোমুখি বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে পরস্পরকে কটাক্ষ করেছেন তারা। বিবিসি খবর বলছে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মন্তব্য করেছেন, ‘ইউক্রেনে বিনা উস্কানিতে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং অন্যায় যুদ্ধের কারণে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।’ অপর দিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেইল ও হুমকি’ সৃষ্টির অভিযোগ করেছেন। ২রা ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো নিরপেক্ষ দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, যাতে তারা ইউক্রেনে যুদ্ধের নিন্দা জানায়। পশ্চিমারা সবকিছুতে এবং প্রত্যেককেই চাপ দেয়ার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক ইউক্রেন নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, আটকে গেল যৌথ ঘোষণা অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তীব্র মতবিরোধে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে যার জেরে এর আগে ব্যাঙ্গালুরর জি-২০ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনের মতো দিল্লির এই সম্মেলনেও কোনও যৌথ বিবৃতি আসছে না বলে জানিয়েছে আয়োজক দেশ ভারত। ভারত জানায়, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আলোচনা অন্যদিকে ফেরাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর প্রভাব ফেলা বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন নিয়ে তর্ক স্থিমিত করা যায় নি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর বলেছেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ ছিল।’ বর্তমানে জি ২০ জোটের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছে ভারত। ভারতের এক সাবেক কূটনীতিক বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতকে এমন বিশেষ কিছু করতে হবে যাতে এই নেতারা যুদ্ধের বিভেদকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হন।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখা ভারতকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাতে গেলে খুবই সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত গ্লোবাল সাউথ (গ্লোবাল সাউথ মূলত আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিযান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং মধ্যপ্রাচ্য সহ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো নিযে গঠিত অঞ্চল) বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করেছেন অথচ এই বিষয়টি নিয়ে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি। এস জয়শঙ্কর উল্লেখ করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত খাদ্য নিরাপত্তা এবং সার সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য খুবই খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ‘তবে এটি নতুন নয়, প্রকৃত পক্ষে, ভারত প্রায় এক বছর ধরে এটি খুব জোরালোভাবে বলে আসছে যে এটি বিশ্বকে প্রভাবিত করছে, বিশেষত জ্বালানি খরচ, খাদ্য খরচ, সারের খরচ সব কিছুতে। জয়শঙ্কর বলেন, কিছু দেশ মহামারি পরবর্তী ঋণের সঙ্গে লড়াই করছে। কিছু দেশ যারা ইতিমধ্যেই ঋণ নিযে লড়াই করছিল এবং যারা ইতিমধ্যে মহামারির কারণে প্রভাবিত হয়েছিল তাদের জন্য এই  সংঘাত মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা সকলের জন্য খুবই গভীর উদ্বেগের বিষয়। এই কারণেই এই বৈঠকে  গ্লোবাল সাউথের উদ্বেগের ওপর খুব বেশি ফোকাস রাখা হয়েছিল। 

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)