মিহির

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি

ড. মিহির কুমার রায়: গত ১ জুন নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য সামনে রেখে মহান জাতীয় সংসদে নতুন বছরের বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী; যার আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে আর এডিপিসহ মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা (যা মূল বাজেটের ৪২.৭৩%)। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় থাকা বিদেশি ঋণ (প্রকল্প সাহায্য) ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো খরচের খাতা খুলতে পারেনি ছয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।

অন্যদিকে সরকারি উৎসের (জিওবি) বরাদ্দ থেকে খরচের খাতা খুলতে না পারা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা তিনটি। সব মিলিয়ে গত চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত আট অর্থবছরের একই সময়ের মধ্যে যা সবচেয়ে কম। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর চেয়ে কম হারে বাস্তবায়নের রেকর্ড রয়েছে। ওই অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ছিল ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ (উৎস: পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদন )।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা মনে করেন, সরকারের অর্থ সংকটের কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এই স্থবিরতা। প্রকল্পে সরকারের অর্থের জোগান দেয়া সম্ভব হয় না বলে প্রকল্প সাহায্যের বাস্তবায়নেও গতি কমেছে। কারণ ভূমি অধিগ্রহণের মতো কাজগুলো সরকারকে করে দিতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীরা ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়ে ঋণ দেবে না। সরকারের অর্থের টানের কারণে ভূমি অধিগ্রহণের মতো ব্যয়ে অর্থ জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার মৌসুমি একটা ব্যাপারও আছে। অবশ্য পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মতো মেগা অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কারণে হাতে বড় ব্যয়ের প্রকল্প কম। নতুন মেগা প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এই স্থবিরতার কারণে কর্মসংন্থান কাঙ্ক্ষিত হারে হবে না। অর্থের সরবরাহ কমবে। সার্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলমান অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে এডিপির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ছিল ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৬৬ কোটি টাকা কম। গত চার মাসে ব্যয় হয়েছে ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৩২ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। গত এক মাসের হিসাবেও গত অক্টোবরে এডিপি বাস্তবায়নের হার কমেছে। গত মাসে বাস্তবায়নের হার ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

গত বছরের অক্টোবরে যা ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। সাধারণত প্রতি অর্থবছরেই আগের অর্থবছরের তুলনায় এডিপির আকার বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছর এডিপি বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। মোট আকার ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৪০টি প্রকল্পের বিপরীতে এ বরাদ্দ রয়েছে।

আইএমইডির প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত চার মাসে প্রকল্প সাহায্যের বাস্তবায়নের হার ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত চার মাসে বিদেশি ঋণের এই উৎস থেকে প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। গত চার মাসে প্রকল্প সাহায্যের এক টাকাও ব্যয় করতে না পারা ছয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হচ্ছে– পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এডিপিতে ব্যয়ে সরকারি উৎসের (জিওবি) অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চার মাসে যে তিনটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এক টাকাও খরচ করতে পারেনি সেগুলো হচ্ছে– জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন।

অন্যদিকে সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। অথচ অতীতের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, নির্বাচনী বছরে এডিবির বরাদ্দ তুলনামূলক বেশি থাকে, যা চলতি বছরেও রয়েছে এবং ব্যয়ের দিক থেকেও প্রায় শতভাগের কাছাকাছি চলে যায় সত্যি, চলতি বছরে তার ব্যতিক্রম ঘটছে বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সরকার শুধু দাপ্তরিক রুটিন কাজ পরিচালনা করবে এবং সরকারি কর্মকর্তারা নির্বাচনী কাজে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে। তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলন আরও জোরদারের চেষ্টা থাকবে।

সরকার পক্ষ অবশ্য মনে করে, ততদিনে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ফুরিয়ে যাবে। এ অনুমান যে একেবারে ভুল, তা মনে হয় না। ১৫-১৭ বছর টানা চাপে থাকা বিএনপির পক্ষে আর কত শক্তি প্রদর্শনই-বা সম্ভব! অন্যদিকে কেবল দক্ষ নজরদারির কারণেই পুরোনো ধাঁচের আন্দোলন রচনা এখন কঠিন। প্রশাসনও অদৃষ্টপূর্ব মাত্রায় অনুগত এবং আন্দোলন দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অবস্থায় বিএনপি ও তার মিত্ররা অবশ্য সাধ্যমতো বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। ভোটের দিনও হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকবে নিশ্চয়ই। তাতে জনমনে ভয়ভীতি থাকায়ও ভোট পড়বে সীমিত প্রত্যাশার চেয়েও কম।

অবশ্য শোনা যাচ্ছে, এরই মধ্যে ভোটারদের উৎসাহিত করে, খাতির করে কেন্দ্রে নিয়ে আসার কিছু উদ্যোগ থাকবে। তাতে ক্ষেত্রবিশেষে ভোটের হার বাড়লেও জাতীয়ভাবে সেটা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু হবে না। সত্যি বলতে, আইনশৃঙ্খলার বেশি অবনতি ঘটতে না দিয়ে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সেরে ফেলার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে সরকার। অগত্যা ইসিরও উদ্দেশ্য হবে এটাই। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীক না দিয়ে ‘যে জিতে আসতে পারো আসো’ বলে কিছু আসন ছেড়ে দেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আরেকটি মেয়াদের জন্য সরকার গঠনটাই যদি লক্ষ্য হয়, তাতে কোনো ‘রোমান্টিসিজম’ না রাখাই সংগত বলে বিবেচিত হবে।

সে যাই হউক না কেন, দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার এখনো ক্ষমতায় রয়েছে এবং অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, গত দেড় দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে এবং তার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হছে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের উদ্যোগগুলো প্রশংসার দাবি রাখে সত্যি কিন্তু এর বাস্তবায়ন শতভাগ না করা গেলে কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব নয়। তার জন্য সরকারের ধারাবাহিকতার প্রয়োজন রয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, যা নিয়ে ঘরে-বাইরে আলোচনা, সরগরম মাঠ-ময়দান। রাজনীতি বর্তমানে দেশের অঙ্গন ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করছে, যা নিয়ে সমাজের মানুষের ভাবনার শেষ নেই। বাজারে মূল্যবৃদ্ধি রয়েছে, সমাজের মানুষের কষ্ট আছে, তবুও সরকারের মানবিক সুবিধাগুলো পেয়ে তার কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছে।

বাজেট আসবে বাজেট যাবে, সরকার আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মধ্যেই দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে তাদের বিগত ১৫ বছরের অধিক পথ পরিক্রমায় দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে । কাজেই আগামীতে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে আগামীতেও সরকার পরিচালনায় সহায়তা করি- এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ। 

বিনিয়োগবার্তা/কেএইচকে//


Comment As:

Comment (0)