মিহির

সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনীতি ও অর্থনীতি

ড:মিহির কুমার রায়: নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের টানাপড়েনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন এবংঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি। 

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি, জামায়াত ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন ও বাম রাজনৈতিক জোট একতরফা নির্বাচনী তফসিল প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

এরই অংশ হিসাবে ঘেড়াও, অবরোধ ও হরতাল বিগত ২৮ শে অক্টোবরের পর থেকেই শুরু হয়েছে এবং তা চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে বিরোধী বলয়। তাদের দাবি একটাই দলীয় সরকারের অধিনে আর নির্বাচন নয় কেননা বিগত দুটি নির্বাচন স্বাভাবিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। এবারকার নির্বাচনেও স্বাভাবিক পরিবেশ নেই, তা ইসি যাই বলুক না কেন। যেমন বিগত নির্বাচনগুলো নিয়ে কেউ কেউ মনে করেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সরকারকে খুশি করার একধরনের অভিপ্রায় বোধ করার ফলে সেসব ক্ষেত্রে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল । 

এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা রাখার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকেই অর্জন করতে হবে।কিন্তু বাংলাদেশের কৃষ্ঠি হলো বিগত ১১টি জাতীয় নির্বাচনে ইসি নির্বাচন অনুষ্টিত করে রাজনৈতিক দলের আস্তা ভাজন হয়েছে তা দেখা যায় নি । সমস্যাটি গনতান্ত্রিক আচরনের ও অনুশীলনের । এখানে উল্লেখ্য যে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়ে থাকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কতৃীক যা একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ সংন্থা হিসাবে সংবিধান স্বীকৃত।

এদিকে আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই, দেখব গত বছরের মার্চ থেকে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী ও বার্তা সম্পাদকদের সঙ্গে কমিশনের মতবিনিময় হয়েছিল দফায় দফায়। নির্বাচন কমিশন আয়োজিত এই সংলাপ নাগরিক সমাজের দৃষ্টি কেড়েছিল। 

সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের মতামত, পরামর্শ ও প্রস্তাবগুলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচন কমিশনের আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করা, দেশে যেকোনো নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও কারচুপিমুক্ত হচ্ছে তা দৃশ্যমান করা। এই উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এবারকার নির্বাচনে স্বাভাবিক পরিবেশ নেই, তা ইসি যাই বলুক না কেন। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করার ‘বাধ্যবাধকতা’য় নিকট অতীতে তারা যাই বলুন না কেন, এখন বলছেন নির্বাচন আয়োজনে কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন আয়োজনে সমস্যা নেই; তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সমস্যা রয়েছে। নিয়মমাফিক নির্বাচন করাই ইসির কাজ কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। যারা এ প্রশ্ন তোলেন, তারা বলেন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই ইসির দায়িত্ব। তেমন নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে তারা কি সেটা বলে তফশিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকতে পারেন? এমন দাবি কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে ইসির উদ্দেশে জানানো হয়েছে। তারপরও বিরোধী বলয় এই কমিশনকে কেন দোষারুপ করবে তা ভাবনার বিষয়।

এখন পর্যন্ত যে আলামত পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয় প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। প্রধান সব দল অংশ নিলে কেমন হয় নির্বাচনের পরিবেশ, সেটা আমাদের জানা আছে। তবে দেশের একটি তরুণ জনগোষ্ঠী তেমন পরিবেশ এখনো দেখতে পায়নি। কেননা বিগত দুটি নির্বাচন স্বাভাবিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি যা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

দলীয় ফোরামে সরকারের তরফ থেকে অবশ্য কর্মীদের সাবধান করে বলা হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি। সেটা কোন বিএনপি, এ প্রশ্ন রয়েছে। একটি নতুন দল তৃণমূল বিএনপি এর সভাপতি এর মধ্যে ঘোষনা দিয়েছে তারা তিনশত আসনেই প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। তারা কি আদি বিএনপি থেকে দলছুট নেতারা এখানে আসছেন তা অস্পষ্ঠ। 

বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর একটা চেষ্টা আছে বলেই প্রশ্নটি ওঠে। তৃণমূল বিএনপি বলছে বিএনপি থেকে কেহ আসলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে এবং নির্বাচনে প্রার্থীতার সুযোগ দেয়া হবে । এরি মধ্যে জাতীয় প্রার্থী থেকে মনোনীত জাতীয় সংসদে বিরোধি দলীয় নেতৃ রওশন এরশাদ তফসিল ঘোষনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। 

এদিকে ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ ১৮ ই নভেম্বর থেকে মনোনয়ন আবেদন ফরম বিক্রি করেছে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের সভানেত্রীর উদ্ভোধনের পরপরি। আবার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বলেছেন তার দলও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করবে।

এখন বিএনপি জোট কি করবে , হয়ত বর্তমান সরকারের অধীনে হতে যাওয়া নির্বাচনটি প্রতিহত করারও চেষ্টা চালাবে তারা।বস্তোত তাই করছে ও তফশিল ঘোষণার পর আন্দোলন আরও জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে যা তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে করেছিল যাকে বলা হয়েছিল আগুন সন্ত্রাস।ভোটের দিনও হরতাল- অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকবে নিশ্চয়ই। তাতে জনমনে ভয়ভীতি থাকায়ও ভোট পড়বে সীমিত প্রত্যাশার চাইতেও কম যা জিয়ী দলের জন্য সমালোচনার ক্ষেত্র সৃস্টি হতে সহায়ক হবে। 

এ ধরনের কাজে সাধারন মানুষ আমজনতা সহ অর্থনিিত যে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা নিয়ে রাজনীতিবীদ গন কিছু কি ভাবছেন ? এমনিতেই সারা বছর ধরে বাজার অস্থির,মানুষের ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে, জমা করা অর্থ ভেঙ্গে খাচ্ছে যা নিয়ে অর্থনীতিবিদগন হিসাব নিকাল করছে প্রতিনিয়ত । 

এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৩-১৪ সালের জুলাই-জানুয়ারির ১৮০ দিনের মধ্যে সংঘটিত হরতাল-অবরোধের নামে মোট ৫৫ দিনের নজিরবিহীন অগ্নিসন্ত্রাস- সহিংসতায় দেশের ক্ষতি হয়েছিল ৪৯ হাজার কোটি টাকা (দৈনিক ৮৯১ কোটি টাকা)। আর এখন চলমান হরতাল-অবরোধের প্রথম ৯ দিনে সারাদেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন এবং ১৩১টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।

আরও একটি হিসাবে উঠে এসেছে ২৮ অক্টোবর হতে ৬ নভেম্বর ৬ দিনে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অনুসারীদের ডাকা অবরোধ-হরতালে রাষ্ট্রের অর্থনীতির আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থাৎ দৈনিক ৬,৫০০ কোটি টাকা।

প্রযুক্তিজ্ঞানে সজীব ওয়াজেদ প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশের ৩৬৫ দিনের জিডিপিকে দৈনিক হিসাবে ভাগ করে আর্থিক ক্ষতির একটি আনুমানিক চিত্র তুলে ধরেছেন। এই সময়ে ১১০টি বাসে অগ্নী সংযোগ গঠেছে এবং প্রতিটি হামলাতে ৩ হাজার টাকা পেয়েছে ভাড়াকড়া সন্ত্রাসীরা (উৎস্য: ভোরের কাগজ,৮ নভেম্বর,২০২৩) । অধ্যাপক আবুল বারকাত,সভাপতি,বাংলদেশ অর্থনীতি সমিতি এর মতে, সব মিলিয়ে ৬ দিনের হরতালে আসলে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৮০,০০০ কোটি টাকা (দৈনিক ১৩,৩৩৩ কোটি টাকা)। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু অথবা দুটি মেট্রোরেল অথবা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেনবিশিষ্ট আরও ১০টি টানেল করা যায়।

এখন অর্থনীতির সমীকরন আর রাজনীতির সমীকরন কি এক তানিয়ে বিতর্ক আছে। কান নির্বাচনকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলে কোনো কোনো খাত গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে চলে পর্যালোচনা। নীতিকাঠামোর ধারাবাহিকতা থাকা নিয়েও দেখা দেয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা যার প্রভাব পরে বিনিয়োগে ,আয়ে ও কর্মসংন্থানে। যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি কমেছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ। এ হিসাবে মোট রপ্তানি অক্টোবরে ১২৪ কোটি কম হয়েছে।

এছাড়াও চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৩৯২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৮৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। রেমিটেন্স আয় অক্টোবরে বাড়লেও লক্ষ্য পূরণের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন যুক্ত হয়েছে বিএনপি জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতাল অবরোধসৃষ্ট মিছিল-মিটিং আগুনসন্ত্রাসের সহিংস রাজনীতি। স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্টকারী এসব কর্মকান্ডের ফলে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ এবং ধ্বংস হচ্ছে দেশের সম্পদ। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের আয়-উপার্জন। উপরন্তু সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়ছে।

এখন বাংলাদেশ নিজের ঘরের সমস্যা সমাধানে ব্যার্থ হয়ে বর্হিদেশের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ভূ-রাজনীতি অংশে পরিণত হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়। অতীতের দু-একটি নির্বাচন ছাড়া সব কটি নির্বাচনের আগে এবং পরে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী দলের অভিযোগ শোনা গেলেও বিদেশিদের তখন অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে শোনা যায়নি।

এবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহের পরিধি মনে হয় আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। ছোট হলেও ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন অনেক দেশেরই বিশেষ নজরে পড়েছে। কারণ বিশ্বরাজনীতি এখন অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে।সে ক্ষেত্রে আমরা অনেকের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছি। এটি আমাদের স্বস্থির খবর হওয়ারই কথা।কিন্তু আমাদের নিয়ে যখন বড় দেশগুলোর এতসব কথাবার্তা, উপদেশ, টানাটানি, আবার নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা, হুমকি-ধমকি, তখন এই স্বস্তি বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে ওঠে। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু যত ভালো কথাই বড় বড় রাষ্ট্রের মুখ থেকে শুনি না কেন, তারা মানবিকতার দিক থেকে ততটা যদি উদার এবং বড় থাকত, তাহলে আমাদের মতো ছোট দেশের জন্য অনেক বেশি শান্তি এনে দিতে পারত। 

বিশ্বরাজনীতি এখন বোধ হয় জটিল থেকে কুটিল হওয়ার দিকেই মোড় নিয়েছে। মুখে চমৎকার উপদেশ, কূটনীতির শব্দচয়ন; কিন্তু ভেতরে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। এখানেই যত বিপত্তি। আমরা স্বস্তি এবং শান্তি চাই, ১৭ কোটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন
ঘটানো আমাদের জন্য মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতার যে বিশাল বহর অতিক্রম করতে হয়, তার ওপর বিদেশিদের জটিল ও কুটিল উদ্দেশ্য সাধনের খড় যখন মাথার ওপর থাকে, তখন আমাদের পড়তে হয় বেশি বিপাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্বমোড়লদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে জড়ানোর কোনো নীতিগত অবস্থানই নেই। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই বাংলাদেশকে চলতে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য কোনো পরাশক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া অথবা সামরিক বলয়ে অবস্থান নেওয়ার কোনো ইচ্ছেই যে নেই, সেটি বারবার বলার পরও স্বস্তি নেই কোনো জোটে, চাপ বাড়ছে আমাদের ওপরে। সেই চাপ তীব্রতর করার জন্য আগামী নির্বাচনকে কোনো কোনো দেশ বাছাই করে নিয়েছে। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং ঘন ঘন প্রতিনিধিদল পাঠানোর দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে, তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে এমন কাউকেই আগামী নির্বাচনে জিতিয়ে আনার জন্য ঘন ঘন ঢাকায় আসছেন। নানাজনের সঙ্গে মিশছেন, কথা বলছেন। কিন্তু তাদের এই আসা-যাওয়ার আসল লক্ষ্য বোঝা যাবে আর কিছুদিন পরেই। 

আওযামী লীগ সরকার ভারতের অনেক সহায়তায় এগিয়ে এসেছে যেমন, উগ্র ইসলামপন্থিদের দমন থেকে শুরুকরে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য চলাচলের অবাধ সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি। নযাদিল্লির জন্য এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের নৈকট্য। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ফ্যাক্টরটি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একই জায়গায় নিযে এসেছে। তাছাড়াও উভয় পক্ষই এ বিষয়ে একমত হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দিতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আলোচনার ঝড় তুলেছে যা কাম্য নয়। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, প্রভাব বিস্তার, কালোটাকা, ধর্মের অপব্যবহার, সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো ইত্যাদিকে কঠোরভাবে নজরদারিতে রাখতেই হবে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। একই অবস্থা জাপানের সঙ্গেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তো আগাগোড়াই আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। বাংলাদেশ গত দেড় দশকে অর্থনীতিতে দারুণভাবে সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে। সে কারণে বিশ্বরাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে নিয়ে বৃহৎ এসব রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে নানা ধরনের স্বার্থ বিবেচিত হচ্ছে। সে জন্যই এবার আগের চেয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে অনেক বেশি নজর দিচ্ছে বলে মনে হতে পারে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করলেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান। 

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান অ্যান্ড্রু গারবারিনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ গত দেড় দশকে যে সাফল্য দেখিয়েছে তা অর্জনের জন্য অন্যান্য দেশের চেষ্টা করা উচিত বলে মন্তক্যব্য করেন তিনি। 

গত ১৮ই আগস্ট কংগ্রেসম্যান অ্যান্ড্রু গারবারিনো (নিউইয়র্ক কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট-২) সম্মানে নিউইযর্কে মোর্শেদ আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশি মার্কিন প্রবাসীদের একটি শুভেচ্ছা সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। 

মার্কিন কংগ্রেসম্যান বলেন, ‘আসন্ন জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি স্বাধীন কমিশনের হাতে তুলে দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বাধীন কমিশনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে যাতে করে তারা দেশকে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারে এবং তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি অর্থনীতিতে বাংলাদেশ যে প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে, জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে তাঁর যে ভূমিকা তা অন্যান্য দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় হবে। 

তিনি আরও বলেন, ২০০৯ থেকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত রূপান্তর ঘটেছে এবং আগামী অর্ধশতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের শুধু আঞ্চলিক পাওয়ারহাউজ নয় বরং বৈশ্বিক পাওয়ারহাউজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে। জাপানভিত্তিক পৃথিবীর বৃহত্তম আর্থিক সংবাদ মাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার (২৩ নভেম্বর, ২০২০) শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ সঠিক কারণে তার সমালোচনাকারীদের হতবাক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে সঠিকভাবে পূর্ব এশিয়ার মডেল হওয়ার পথে হাঁটছে। মানব পুঁজিতে বাংলাদেশের বড় বিনিয়োগ ঢাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে। আশাকরা যাচ্চে আগামী দ্বাদশ নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহনে সম্পন্ন হবে এবং যে দলই ক্ষমতায় আসবে জনগন সেটা মেনে নেবে। এটাই গনতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূলমন্ত্র।

লেখক: অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

বিনিয়োগবার্তা/কেএইচকে//


Comment As:

Comment (0)