মুজিববর্ষে করোনা ভাইরাস

মৌসুমেও কৃষি পণ্যের চড়া দাম: কার লাভ-ক্ষতি

ড. মিহির কুমার রায়: শীতের সবজির সমারোহের মধ্যে যেখানে কমার কথা, সেখানে হঠাৎ আবার চড়া হয়ে উঠেছে এর দাম। গত দুই দিনে কয়েকটি সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। কোনোটির দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু রবি ফসলের ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত সরবরাহ সত্ত্বেও সবজির দাম চড়া। শীতের সবজির ভরা মৌসুম এখন। বাজারে সরবরাহও পর্যাপ্ত। সে অনুযায়ী দাম সহনীয় থাকার কথা। কিন্তু সপ্তাহের ব্যবধানে অধিকাংশ সবজির দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। বাজারে নতুন আলুর সরবরাহ বাড়লেও নতুন ও পুরনো দুটির দামই চড়া। সরবরাহ কমার অজুহাত দেখিয়ে বিক্রেতারা কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়িয়েছে রসুনের দাম। তবে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহে এই নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে সবজির সরবরাহ কিছুটা কমে যাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে মানভেদে যে শিম ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি ছিল, সেই শিম এখন প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। বড় গোল বেগুন ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি, এটি এখন ৮০ টাকা। লম্বা বেগুন প্রতি কেজি ৫০ টাকা ছিল, এটি এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজির করলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। লাউ প্রতিটি ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, দাম বেড়ে এখন ৮০ থেকে ৯০ টাকা। ৭০ টাকা কেজির কাঁচামরিচ মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতিটি ১০ টাকা বেড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। নতুন আলু প্রতি কেজি ৭০ টাকা। দেশি রসুন প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা এবং আমদানি করা রসুন ২৩০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দামও বেড়েছে। ১০ টাকা বেড়ে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, ‘সবজি সম্পূর্ণ পচনশীল পণ্য। এটি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। তাই কাঁচাবাজারে সিন্ডিকেট করার সুযোগ থাকে না। দাম ওঠানামা করে সরবরাহের ওপর। কখনও সরবরাহ কমে গেলে দামটা চড়া হয়ে যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে/কোয়াশায় ক্ষেতে কিছু সবজি বিশেষত আলু নষ্ট হয়েছে। এতে সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে চড়া দাম দীর্ঘ সময় থাকবে না। যে কোনো মূহূর্তে কমে যেতে পারে।’ গত বছর আলুর দর লাফিয়ে বাড়তে থাকায় দাম বেঁধে দেওয়ার পর আমদানির উদ্যোগ নেয় সরকার। আমদানির পাশাপাশি বাজারে এখন নতুন আলুর সরবরাহও অনেক বেড়েছে। এরপরও লাগাম টানা যায়নি। বড় বাজারগুলোতে নতুন আলু ৭০ ও পুরোনো আলুর কেজি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এলাকাভিত্তিক ছোট বাজার ও মহল্লার দোকান থেকে কিনতে গেলে নতুন-পুরোনো উভয় আলুর জন্য কেজিতে ৭০ টাকা গুনতে হচ্ছে। অথচ সপ্তাহখানেক আগে দুই ধরনের আলুর দর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে।

এখন আসা যাক যে অদৃশ্য শক্তি বাংলাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যাকে সাধারণভাবে সিন্ডিকেট বলে অভিহিত করা হয়। গত ৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা আগামী মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে কাজটি করে তারা। যাহোক, সিন্ডিকেট সঙ্গে সঙ্গে এ সুযোগ গ্রহণ করে এবং এক রাতের মধ্যে প্রতি কিলোতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় ১০০ টাকা। বাড়তি দামে যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তা আগেই আমদানি করা এবং ১০০ টাকা কম মূল্যে যখন বিকাচ্ছিল, তখনো তারা তা লাভেই বিক্রি করছিলেন। যদিও কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে আসে। বাংলাদেশে কমবেশি আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ ব্যবহৃত হয় প্রতি মাসে। বর্ধিত দামে যদি তাঁরা এক লাখ টন পেঁয়াজও বেচতে পারেন, তাহলে ভোক্তাদের ট্যাঁক থেকে অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। তাঁদের জন্য এমন সুযোগ অবশ্য অহরহই আসে। কখনো চাল, কখনো আলু, কখনো ডিম, সৃজনশীলতার কোনো ঘাটতি নেই তাঁদের জাদুর বাক্সে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ ১৭ হাজার টন। পক্ষান্তরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সারণি থেকে দেখা যায়, এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু পেঁয়াজের ব্যবহার ১৫ কিলোগ্রাম (ভারতে ১৬ কিলোগ্রাম)। সেই হিসাবে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ২৫ লাখ টন পেঁয়াজই যথেষ্ট হওয়ার কথা। অথচ এরপরও সাত লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আমদানির তথ্যে তো কোনো ভুল নেই, তাহলে বাকি অঙ্কগুলোর কোনটাকে বিশ্বাস করব আমরা?

সম্প্রতি আলুর চরা দামে এবার আলু মজুতের সরকারি তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করল হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি দাবি করেছে, সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোল্ড স্টোরেজের ২০ শতাংশ খালি রয়েছে। আর এ কারণে বাড়ছে আলুর দাম। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু মজুত করছে বলেও মনে করে সংগঠনটি। সম্প্রতি রাজধানীর কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সম্মেলন কক্ষে আলুর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি মোস্থফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, মুনাফালোভী একটি চক্র আলু মজুত করে দাম বৃদ্ধি করছে। এখানে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোনো দায় নেই। উল্লেখ্য, বর্তমান রেকর্ড মূল্যে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু মানভেদে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলে কোল্ড স্টোরেজ শেড থেকে আলু বের হয় ১৮ টাকা কেজি দরে যা খুচরা বাজারে ৭০-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে । তিনি বলেন, পরিবহন, আড়ত ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচসহ সব মিলিয়ে এ আলু ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। আমরা মনে করি মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে যারা আলু সংরক্ষণ করেছে তারা মনে করছে আলুর মজুত কম রয়েছে। এজন্য তারা আলুর দাম বাড়াচ্ছে। সদস্যদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আলু গত বছরের তুলনায় কম সংরক্ষিত রয়েছে, এখন আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

জুলাই ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুতের পরিমাণ ১৯ লাখ ৫৩ হাজার টন। ১৭ কোটি মানুষের দেশের জন্য পরিমাণটা বেশ কমই বলা যায়। সরকারি গুদামগুলোতে মজুত সক্ষমতাও মাত্র ২৩ লাখ টনের মতো। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অবশ্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সরকারি খাদ্য মজুতের পরিমাণ ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার টন, ভারতের ১৪৩ কোটি লোকসংখ্যা মোটামুটি বাংলাদেশের সাড়ে আট গুণ। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মজুতের প্রয়োজন অন্তত ৪৫ লাখ টন। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ এবং দীর্ঘদিন ধরে সে দেশে কখনোই খাদ্যশস্যের জোগানের অভাব দেখা যায়নি। সরকারি গুদামে খাদ্য মজুত কম হলেও তাই ঝুঁকি নেই তেমন। বিপরীতে পরিসংখ্যান যা–ই বলুক না কেন, বাংলাদেশকে নিয়মিতই খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত যখনই মোটা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সিন্ডিকেট কাজে নেমে পড়ে এবং চালের দাম বাড়তে থাকে। সরকারের কাছে বড় মজুত থাকলে সময়মতো বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে এই কারসাজি থেকে, বিশেষ করে প্রান্তিক ভোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২২-২৩ বছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টন। ১২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের দ্য ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত বিবিএসেএর তথ্যমতে দৈনিক মাথাপিছু চালের ব্যবহার ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। যদি তা–ই হয়, তবে ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে প্রয়োজন মাত্রই ২ কোটি ৪ লাখ টন চাল! অতিরিক্ত আরও ২ কোটি টন চাল তাহলে কোথায় যায়? আর ভারত মোটা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কি না, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হয় আমাদের? তাই ভোক্তার সন্তুষ্টি যদি হয় সরকারের লক্ষ্য তবে বাজার নিয়ন্ত্রনে আরও কঠোর হতে বাধা কোথায়? নির্বাচন এবং বিরোধী দলের ক্রমাগত হরতাল/অবরোধ এর কারনে বাজার বিশেষত কৃষি পণ্যের বাজার অস্থির, এমতাবস্তায় ভোক্তার বাঁচার উপায় কি এটি প্রশ্ন আকারেই রইল।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবীদ।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)