কোভিড-১৯ ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ণ প্রসঙ্গ

নিরাপত্তা সম্মেলনে ২০২৪: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ড: মিহির কুমার রায়: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো জয়লাভ করে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সরকারি সফরে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মিউনিখ যান। সেখানে অবস্থানকালে  শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন এবার ৬০তম বার্ষিকী পালন করেছে। দীর্ঘ এই সময়ে সম্মেলনে অনেক বৈচিত্র এসেছে। এবারের সম্মেলনেও বিশ্ব নেতারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক আন্তর্জাতিক বিষয়, যেমন বৈশ্বিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনীত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি বেশ কয়েকজন বিশ্ব নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন যাদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রটে, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানি এবং ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিক সেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এছাড়াও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইও, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস, বিশ্বব্যাংকসহ প্রায় ৬০টি দেশের সরকার প্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সুশীল সমাজ, সরকারি-বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রায় পাঁচশ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের উদ্বোধন হয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়।

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের রয়েছে দীর্ঘ ষাট বছরের ইতিহাস। ১৯৬৩ সালে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো থেকে মূলত অংশগ্রহণ করা হতো এবং  এ সম্মেলনের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের যেসব হুমকি এবং নিরাপত্তা সংকট ছিল, সেগুলো নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যেই মূলত মিউনিখ নিরাপত্তা  সম্মেলনের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠার সময়টিই বলে দিচ্ছে, স্নায়ু যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলনের উৎপত্তি এবং বরাবরই  সম্মেলনটি একটি অনানুষ্ঠানিক প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয়গুলো তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত হয়েছে। এবার এ সম্মেলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, এখানে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, রাজনীতিক, কূটনীতিক একত্র হয়েছিলেন এবং একটি অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। প্রথম কয়েক দশক আলোচনা মূলত স্নায়ু যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যেই সীমিত ছিল এবং সেখানে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার দ্বন্দ, প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মুখ্য বিষয় ছিল এবং তাকে কেন্দ্র করে ইউরোপের উদ্বেগ  এবং শঙ্কা ছিল। আমরা জানি, ইউরোপ তখন পশ্চিম ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে ছিল এবং এখনো যা বজায় আছে। এ সম্মেলন ইউরোপভিত্তিক একটি প্লাটফর্ম,  যেটি ইউরোপের নিরাপত্তা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করে। সেখান থেকে বিভিন্ন বিষয় আলোচনার পর পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু গত দুই বছর অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিত, আলোচ্য বিষয় এবং নিরাপত্তা সম্মেলনের ভবিষ্যৎ করণীয় সবকিছুই পালটে যায়। ফলে বর্তমান বিশ্বের একটি জটিল সময়ে এ নিরাপত্তা সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এটি অতীতের চেয়ে অনেক বড় পরিসর ধারণ করেছে। এ সম্মেলনটি এক সময় পশ্চিমা দেশগুলোকে কেন্দ্র করে হলেও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দেশ সেখানে অংশগ্রহণ করছে। পুতিন এক সময় নিয়মিত এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেও এখন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে তার অবস্থান। সেদিক থেকে মিউনিখ সম্মেলনে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছিল, সেটি মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার যে হুমকি, সেই হুমকির বিষয়টি। 

এ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের একজন অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি এ সম্মেলনে ‘ফ্রম পকেট টু প্ল্যানেট: স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনায় বক্তৃতা ও ছয়টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবগুলো হলো প্রথম: আমাদের সঠিক পথে রাখতে জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সমাধান খুঁজে বের করা। উন্নত দেশগুলোকে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মেনে চলা; দ্বিতীয়: বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকান্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে; তৃতীয়: জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করা; চতুথ: বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থপ্রাপ্তি সুগম করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাটি তাদের সক্ষমতায় বিনিয়োগ করার সুযোগ সহ সমাধান করা; পঞ্চমত: বৈশ্বিক অর্থায়নের ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ন দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক লাভের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ ফলাফল দেখানো; ষষ্ঠ: জলবায়ু কর্মসূচির জন্য বেসরকারি পুঁজি প্রবাহের জন্য সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকল্পের জন্য বেসরকারি পুঁজি আকৃষ্ট করার জন্য আহবান জানানো।  

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি সুস্পষ্ট যে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ছাড়া জলবায়ু অর্থায়নের বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কার্যকর সমাধান করা যাবে না। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে এত বড় বড় রাষ্ট্র নেতাদের ভিড়েও ফোকাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্ব প্রথম এরকম একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ২০১৭ সালে এবং পরবর্তীকালে ২০১৯ সালেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা নয়। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সরব পদচারণা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে।

সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল কতগুলো বিষয় গবেষণার মাধ্যমে পূর্ব থেকে নির্ধারণ এবং তার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন  তৈরি যা আলোচনার ক্ষেত্র হিসাবে স্থান পাবে। যেমন এবারের আলোচনার মূল বিষয় ছিল ১. মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদন ২০২৪, যার শিরোনাম হচ্ছে Lose-Lose অর্থাৎ নিরাপত্তার দিক থেকে বিশ্ব এমন একটি অবস্থানে আছে, যে পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চল  ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসে একটি ভালো অবস্থায় যাওয়ার অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। বৃহৎ শক্তিগুলো  যেভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখছে, তাতে তারা বরং ক্রমাগত পরস্পরের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সেখান থেকে বিজয়ী হওয়ার  কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এবারের মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এখানে তারা বলছে, সবাই পরাজিত হচ্ছে; ২. ইউরোপ, ইন্দো-প্যাসেফিক, আফ্রিকা কিংবা এশিয়া এসব অঞ্চলের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়সহ অন্যান্য  বিষয়ের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে; ৩. বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যে সম্মেলন হয়েছে, সেখানে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সম্মেলনের বা এজেন্ডার প্রসার ঘটেছে; ৪. এবারের সম্মেলন ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের যে সংকট সেটি সামনে উঠে এসেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়টি। সেখানে চীন এবং রাশিয়ার প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে। যেহেতু অনেক দেশই সেখানে অংশগ্রহণ করছে, তাই প্রতিটি দেশেরই তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। সেদিক থেকে এটি একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা কূটনীতির মঞ্চ; ৫. বাংলাদেশ যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়েছে, তা হচ্ছে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান। এ সম্মেলন ইউরোপের একটি দেশে অনুষ্ঠিত হলেও এটি মূলত ইউরোপে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করার একটি সুযোগ তৈরি করেছে; ৬. বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জোরালো বক্তব্যের মধ্যে ছিল বিশ্বকে কীভাবে আরও শান্তিপূর্ণ করা যায়, স্থিতিশীল করা যায়, বিশ্বের নিরাপত্তা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এবং সেই ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এগিয়ে আসা, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার বিষয়, গাজা যুদ্ধে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের এ সম্মেলন থেকে যা অর্জন তা হচ্ছে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট  করা। এ সম্মেলন ইউরোপের একটি দেশে অনুষ্ঠিত হলেও এটি মূলত ইউরোপে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করার একটি সুযোগ তৈরির পথ সৃষ্ঠি করেছে যা প্রশংসনীয়। দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণ মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছে। এটি একটি উন্মুক্ত ফোরাম। সম্মেলনে রাষ্ট্র নেতারা ছাড়াও শিক্ষাবিদ, বানিজ্য ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, মানবাধিকার কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)