পেঁয়াজে সফলতা এনেছে নাসিক–৫৩
ড: মিহির কুমার রায়: পেঁয়াজ একটি মসলাজাতীয় ফসল যা বাংলাদেশের কিছু এলাকায় অর্থকরি ফসল হিসাবে চাষ হয়ে থাকে। এখানে অনেক উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন হয়েছে এবং এর পরও আমদানী নির্ভরতা কমেনি যেহেতু সারাবছর জোরে এর চাহিদা আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানী হয়ে থাকে মূলত ভারত থেকে অবস্থানগত কারনে। গত কয়েকবছর ধরে পেয়াজের মূল্যের দেখা য়ায়, এমনকি আমদানী করার মত দেশও খুজে পাওয়া যায় না যা দেশের ভোক্তাদের জন্য ক্ষতির কারন ছিল। পেঁয়াজের একটি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে যেমন পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে, ক্যালসিয়াম- সালফার- ভিটামিন সংযোজনে, শরীরের তাপমাত্রা কমাতে, লিভারের হজম শক্তি বাড়াতে, ত্বকের সমস্যা নিরসনে, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বিগত অর্থবছরগুলোতে দেশে পেঁয়াজের গড় উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে বছরে ২৪ লাখ টন। আবার উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ (প্রায় ৩০ শতাংশের মতো) বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয় বিধায় মোট ঘাটতি ৮ থেকে ৯ লাখ টন থেকেই যায় যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়, প্রতিবছরই যা স্বাভাবিক নিয়ম এবং আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়; যার ৯৫ ভাগের বেশি আসে ভারত থেকে। ক্রেতার চাহিদা বুঝে বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা সাধারণত ভারত থেকে নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ আমদানি করেন। এই মৌসুমে আমদানি করা পেঁয়াজের এলসি মূল্যই থাকে ৫৫০ মার্কিন ডলার। এই দামে ৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানিতে প্রতিবছর দেশকে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। যদিও এর পুরোটাই সাশ্রয় করা সম্ভব, যদি দেশেই ভারতীয় নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানো যায়। আর এখানেই হচ্ছে সম্ভাবনার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র।
আশার খবর হচ্ছে, কৃষি বিভাগ বলছে, ইতিমধ্যেই দেশে এ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ২০২০ সালে শুরু হওয়া উদ্যোগ এখন রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর সহ বেশ কিছু জেলায় ভারতীয় এই জাতের পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে। এ জাতের পেঁয়াজ উৎপাদনের খরচ কম। মাত্র আড়াই মাসের মাথায় ফলন পাওয়া যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফসল শাখার পরিচালক ড. কাজী আফজাল হোসেন বলেন, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি নির্ভরতা কমানোই নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষের উদ্দেশ্যে। এতে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে কোথাও কোথাও। ফলাফল ভালো থাকলে ভবিষ্যতে চাষ আরও বাড়বে।
দৈনন্দিন জীবনে অত্যাবশ্যকীয় একটি কৃষিপণ্য হচ্ছে পেঁয়াজ। ধনী-গরিব সবার রান্নাঘরে এর রয়েছে ভীষণ কদর। তবে প্রতিবছর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর — এই তিন মাস দেশে পেঁয়াজের বড় সংকট থাকে। এই সময়ে সরবরাহ সংকটের গভীরতা অনুযায়ী কোনো বছর এর দাম ট্রিপল হাফ সেঞ্চুরি থেকে ডাবল সেঞ্চুরিও পার হতে দেখা গেছে। এতে ভোক্তার নাভিশ্বাস সরকারকেও ফেলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক বলেন, এখন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা বাড়ার কারণে পেঁয়াজের ব্যবহার আরও বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, আগে শুধু শীতকালেই মুড়ি কাটা পেঁয়াজ চাষ হতো। ২০২০-২১ মৌসুম থেকে শুরু হয়েছে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ। নাসিক-৫৩ জাতের ভারতীয় এ পেঁয়াজের বীজ আমদানি করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ওই পেঁয়াজ বীজ প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যেই চাষিদের সরবরাহ করা হয়। কারওয়ান বাজার ঘুরে জানা যায়, সব ধরনের পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১০০ টাকার ওপরে। বিক্রেতা জানান, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১৩০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় এই পেঁয়াজ মূলত নাসিক-৫৩ জাতের।
তথ্যমতে, এ ধরনের পেঁয়াজ চাষে উপযোগী মাটি বেলে দোআঁশ। সরাসরি জমিতে বীজ বুনে, কন্দ ও চারা রোপণ করে পেঁয়াজ উৎপাদন করা যায়। আবার বীজতলায় বীজ বুনে সেই চারা তুলে রোপণ করা যায়। গ্রীষ্মকালে সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পেঁয়াজ রোপণ করা হয়। রাজশাহীতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ বেড়েছে। অসময়ের এই পেঁয়াজে ভালো লাভ হওয়ায় গত মৌসুমের তুলনায় এবার চাষ বেড়েছে আড়াইগুণ। মাঠে মাঠে চাষ হয়েছে ভারতীয় নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ। এ পেঁয়াজ হয় মাটির ওপরেই। ইতিমধ্যে জমিতে পেঁয়াজ দেখা দিয়েছে। তা দেখে আশায় বুক বেঁধেছেন চাষিরা। বিঘাপ্রতি লাখ টাকা লাভের আশা তাঁদের।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের হিসাবে, ২০২০-২১ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাত্র ২০০ বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে এই পেঁয়াজ চাষ হয়েছিল। ২০২৩-২৪-এর খরিপ-১ মৌসুমে ৫ হাজার ২০০ ও খরিপ-২ মৌসুমে ৬ হাজার ২০০ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ হয়। এবার ২০২৪-২৫-এর খরিপ-১ মৌসুমে চাষাবাদ আড়াইগুণ বেড়ে ১৩ হাজার বিঘা জমি হয়েছে। এবার হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ২০ টন পেঁয়াজের উৎপাদনের আশা করছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর গ্রামে এহসানুল কবির টুকু এবং রাকিব আলী জানান, নভেম্বরের শেষের দিকে তাঁরা জমি থেকে পেঁয়াজ তুলবেন। তখন একেকটি পেঁয়াজই হবে ১০০ গ্রাম। প্রতি বিঘায় ১২০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদনের আশা তাঁদের। যদি ৮০ মণও হয়, তাহলেও অন্তত ১ লাখ টাকা লাভ হবে। কারণ, বিঘাপ্রতি খরচ পড়বে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। গোদাগাড়ীর কাঁঠালবাড়িয়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত না হলে এই পেঁয়াজ চাষে কোনো সমস্যা হবে না।
এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের ৩টি গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। এরইমধ্যে সরকার নয়টি কৃষি পণ্যের ওপর প্রণোদনা দিয়েছে যার মধ্যে পেঁয়াজও আছে এবং পেঁয়াজ চাষীরা যাতে সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পেঁয়াজ এমন একটি মসলাজাতীয় ফসল যা পৃথিবীব্যাপী উৎপন্ন হয় এবং সবচাইতে বেশি উৎপাদন হয় ভারত ও চীন দেশে বিশেষত আদ্র অঞ্চলগুলোতে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম হয় আর হালকা শীত থাকে। মাঠের তথ্যে দেখা যায় পেঁয়াজের ঘাটতি ও চাহিদা পূরণে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামের তরুণ যুবক কৃষি উদ্যোক্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করার জন্য ৩২ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন পেঁয়াজ, পর্যাপ্ত পরিমাণে মৌমাছি না থাকায় বীজ উৎপাদনে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় করছেন পরাগায়ন। এতে স্থানীয়দের যেমন আয়ের সুযোগ হয়েছে, তেমনি এই বীজ দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বলে আশা করছেন এই কৃষি উদ্যোক্তা। জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামে মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো আরও অনেক কৃষক শত শত বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করেছেন। এলাকার ফসলি মাঠগুলোর দিকে তাকালে চোখে পড়ে শুধু পেঁয়াজ গাছের সবুজ ডাটা ও কদম ফুলের আকৃতির মতো সবুজ সাদা শুভ্র ফুল আর ফুল। চোখ ও মন জুড়ানো সবুজ ও সাদা ফুল এবং মৌমাছি ফুল থেকে মধু আহরণ প্রকৃতিতে এনে দিয়েছে এক অনন্য মনরোম দৃশ্য।
সরকারিভাবে মসলাজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে বেশ কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ। ফলে এবার ঠাকুরগাঁওয়ে উল্লেখযোগ্যহারে মোয়াজ্জেম ও মাসুদ রানার মতো অনেকই পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করেছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এভাবে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে, এছাড়াও কৃষকদের বীজ উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অদূর ভবিষ্যতে এই মশলাজাতীয় ফসলের উৎপাদন এ জেলায় আরও বৃদ্ধি করা হবে এবং এর সঙ্গে মৌ-চাষকে সম্পৃক্ত করলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন। তাই ভোক্তা, উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনায় রেখে আমদানি বাণিজ্যে আমদানিকারকদের সকল বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে, টিসিবির কার্যক্রম ভোক্তাবান্ধব হতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বাজার স্থিতিশীল হতে হবে, সঠিক নিয়মে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে মূল্য বিপর্যয়ের কোন সম্ভাবনা থাকবে না যা কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় হতে বাধ্য। সর্বোপরি পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে, বাংলাদেশে পেয়াজ উৎপাদনকারী প্রধান এলাকা হলো পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্ঠিয়া, মেহেরেপুর, বগুরা ও লালমনিরহাট, দিনাজপুর। এসব এলাকার চাষীদের গ্রীস্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বেশী উৎসাহ দিতে হবে বিশেষত: অতি বৃষ্ঠি ও বন্যার কথা বিবেচনায় রেখে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক জ্যাষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//