Saiful Islam Pipon

কোন পথে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার: আবেগনির্ভর নাকি ফান্ডামেন্টাল

সাইফুল ইসলাম পিপন: পুঁজিবাজারের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে তার অন্তর্নিহিত মান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বাস্তবতা অনেক সময়ই সেই আদর্শ পথ অনুসরণ করে না। বরং আমরা দেখতে পাই— সংবেদনশীলতা বা সেন্টিমেন্ট ভিত্তিক বাজার আচরণ যেখানে গুজব, গোষ্ঠীগত প্রচারণা, আতঙ্ক বা উচ্চ প্রত্যাশার মতো মনস্তাত্ত্বিক উপাদান মূল্যবোধ ও বিশ্লেষণের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠে— আমাদের পুঁজিবাজার কি ফান্ডামেন্টাল নির্ভর হতে পারছে, নাকি আমরা একটি সেন্টিমেন্ট ড্রিভেন ইকোসিস্টেমে আটকে পড়েছি?

ফান্ডামেন্টাল মার্কেটঃ ফান্ডামেন্টাল মার্কেট মডেলে একটি কোম্পানির শেয়ার মূল্য নির্ধারণ হয় তার আয়, সম্পদ, ব্যয়, ঋণ, শিল্পখাতের প্রবণতা এবং পরিচালনা ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করে। এটি সময়সাপেক্ষ, বিশ্লেষণ ভিত্তিক এবং তৃপ্তিদায়ক প্রক্রিয়া। বিশ্বের উন্নত পুঁজিবাজারগুলো যেমন— যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, এমনকি ভারতেও বিশ্লেষণ নির্ভর বিনিয়োগ ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তার করছে।

সেন্টিমেন্ট-ড্রিভেন মার্কেটঃ সেন্টিমেন্ট ভিত্তিক বাজারে বিনিয়োগকারীদের আচরন প্রভাবিত হয় আবেগ, গুজব, ইনফ্লুয়েন্সারদের বক্তব্য বা সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচনায়। একটি কোম্পানি নিয়ে কোনো ইতিবাচক গুজব রটে গেলেই তার শেয়ারে হঠাৎ উত্থান দেখা যায়— বিনিয়োগকারীরা যাচাই না করেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। আবার বাজারে সামান্য নেতিবাচক সংবাদেও চেইন রি-অ্যাকশনের মতো শেয়ার বিক্রি শুরু হয় এবং বাজার পড়ে যায়।

Behavioral Finance বা আচরণগত অর্থনীতিঃ সেন্টিমেন্ট ও ফান্ডামেন্টাল মডেলের মাঝে রয়েছে একটি নতুন ধারা— Behavioral Finance, যা বলে যে মানুষ কেবল তথ্য নয়, আবেগ, পূর্বানুমান, অতীত অভিজ্ঞতা ও সামাজিক প্রভাব দ্বারা সিদ্ধান্ত নেয়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী সঠিক শিক্ষা ও কাঠামো না থাকলে বিনিয়োগকারী আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং বাজার সেন্টিমেন্ট ভিত্তিক হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের বর্তমান পুঁজিবাজারে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, বহু কোম্পানির শেয়ার মূল্য তাদের আয়, সম্পদ, বা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার তুলনায় অতিমূল্যায়িত অথবা অবমুল্যায়িত। অথচ ট্রেডিং ভলিউম, মিডিয়া হাইপ বা চক্রভুক্ত প্রচারণা অনেক সময় দাম বাড়ার বা কমার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটঃ যুক্তরাষ্ট্রে S&P 500 বা Nasdaq-এ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের আগে বিশ্লেষকেরা কোম্পানির EPS, PE ratio, Free Cash Flow ও ভবিষ্যৎ গাইডেন্স বিশ্লেষণ করে। Morningstar, Bloomberg এবং Yahoo Finance-এর মতো প্ল্যাটফর্মে ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ সহজলভ্য এবং বিনিয়োগকারীর সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। জাপানে Tokyo Stock Exchange কোম্পানিগুলোর Annual Report বিশ্লেষণের জন্য বাধ্যতামূলক করে এবং ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা রোডম্যাপ তৈরি করেছে। ভারতে NSE এবং BSE উভয় স্টক এক্সচেঞ্জই বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে যার আওতায় বিনিয়োগকারীদের মৌলিক বিশ্লেষণ শেখানো হয়, যার ফলস্বরূপ বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটঃ বাংলাদেশে এখনো এমন বহু বিনিয়োগকারী আছেন, যারা ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে নগণ্য। মূলধারার সাধারণ বিনিয়োগকারী এখনো শেয়ার বাছাইয়ে EPS, PE Ratio, ROE বা Debt to Equity Ratio এর ব্যবহার জানেন না বা করেন না। এতে বাজারে গঠিত হয় অস্বাভাবিক হাইপ এবং সেখানেই প্রবেশ করে বিনিয়োগ সন্ত্রাস।

কখন পুঁজিবাজার সেন্টিমেন্টে চালিত হয়ঃ ক) বিনিয়োগ শিক্ষার অভাবে— প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগ শিক্ষার প্রসার কম বা না থাকায় বিনিয়োগকারী ভুলভাল সূত্র ও পোস্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেন। খ) ইনফ্লুয়েন্সার নির্ভরতায়— সোশ্যাল মিডিয়ার তথাকথিত শেয়ার গুরুদের পরামর্শে অন্ধভাবে বিনিয়োগ হয়। গ) তথ্যপ্রকাশে ঘাটতিতে— কোম্পানির তথ্য যথাসময়ে হালনাগাদ না হলে, গুজবই হয়ে ওঠে তথ্যের প্রধান উৎস। ঘ) গুজব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায়— বাজারে গুজব ছড়ানো একটি ঘনঘটনীয় পদ্ধতি হয়ে গেছে, যা বিনিয়োগ সন্ত্রাসীরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ঙ) নীতিনির্ধারক পক্ষের বারবার হস্তক্ষেপ— মূল্যসীমা, ট্রেডিং সময়, নিষেধাজ্ঞা বারবার পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক বাজার গঠনে ব্যাঘাত ঘটে।

কি হতে পারে সমাধানের উপায়ঃ ক) রিটেইল ইনভেস্টর সেন্টিমেন্ট ইনডেক্স চালু করা, যা বিনিয়োগকারীদের মনের অবস্থা যাচাই করে পলিসি গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। খ) বিনিয়োগ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, যেমন— বিও একাউন্ট খোলার আগে সংক্ষিপ্ত কোর্স বাধ্যতামূলক করা। গ) অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক গুজব মনিটরিং সেল গঠন করা, যা মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব চিহ্নিত করবে এবং আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিবে। ঘ) ব্রোকারেজ হাউজে ফান্ডামেন্টাল টুলস চালু করা, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ বিশ্লেষণ ব্যবস্থা হিসেবে প্রাধান্য পাবে। ঙ) নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্ট্যাবিলিটি ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে পলিসি পরিবর্তনে স্থিতিশীলতা রাখা।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে- একদিকে ফান্ডামেন্টাল নির্ভর দীর্ঘমেয়াদি বাজার, অন্যদিকে সেন্টিমেন্ট নির্ভর ঝুঁকিপূর্ণ বাজার। ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আমরা কোন পথ বেছে নিবো তার উপর। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, যতদিন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীর শিক্ষা, তথ্যপ্রাপ্তি, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা হবে, ততদিন বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে গুজব ও আবেগের হাতে। এবং তাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং বাজারের ভবিষ্যৎ।

লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)