জিডিপিতে অবদান বাড়াতে পুঁজিবাজারকে আরও গণমুখী করতে হবে: কে এ এম মাজেদুর রহমান

জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়াতে হলে এ বাজারকে আরও গণমুখী করতে হবে। বাজারের গভীরতা আরও বাড়াতে হবে। বাজারের গভীরতা বাড়াতে এখানে ভাল কোম্পানি তালিকাভূক্ত করতে হবে। আর এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে। প্রয়োজনে আইন-কানুন বা বিধি-বিধান কিছুটা পরিবর্তন করে হলেও তাদেরকে এখানে আনতে হবে।

বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলছিলেন দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান। এ সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।

বিনিয়োগবার্তা: বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলুন।

কে এ এম মাজেদুর রহমান: বর্তমান বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থানেই রয়েছে। রোজার মাস এবং বছরের শেষ দিকে বিনিয়োগকারীরা একটা সতর্ক অবস্থানে ছিল। ওই সময় শেয়ার কেনা বেচার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করেছিল। এখন তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফি‌রে এসেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই সূচক ও লেনদেন বাড়ছে। এটি বাজারের জন্য শুভ লক্ষণ। এ অবস্থা থাকলে আগামী দিনে বাজার আরও সমৃদ্ধ হবে। আর বাজার সমৃদ্ধ হলেই দেশের অর্থনীতিতে এ বাজারের অবদান বাড়বে।

বিনিয়োগবার্তা: এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারের প্রাপ্তি নিয়ে বলুন।

কে এ এম মাজেদুর রহমান: এবারের বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে নতুন কিছু নাই। প্রাক বাজেট আলোচনায় স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর পক্ষ থেকে আমরা এনবিআরকে কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম; বাজেটে সেগুলোর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।  তবে এটিও সত্য যে, বিগত বাজেটগুলোতে এ বাজারের জন্য যা কিছু প্রণোদনা বা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোরও পুরোপুরি বাস্তবায়ণ এখনো শেষ হয়নি। এসবের মধ্যে কিছু কাজ হয়েছে, বাকি কিছু এখানো বাস্তবায়ণ করা হচ্ছে। আসলে সব কিছুতো আর একদিনে শেষ করা যায় না।  যেকোনো কাজ বাস্তবায়নের জন্যই একটু সময়তো লাগেই। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। স্টক মার্কেটের ডি-মিউচুয়ালাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এর সুফল পেতে আরও সময় লাগবে।  আলাদা বন্ড মার্কেট চালু, ডেরিভেটিভস ও ইটিএফ চালু, ট্র্যাটেজিক পার্টনার নেওয়া-এসব কিছুই প্রক্রিয়াধীন।  এসব কাজ শেষ হলে আমরা আবার জোড়ালোভাবে সরকারের কাছে কিছু চাইতে পারব।  আর একটি কথা হলো- শুধু বাজেটে নয়; সরকার চাইলে যেকোনো সময়ই বাজারকে প্রণোদনা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- পুঁজিবাজারকে সমৃদ্ধ করতে সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে। আমরা আশা রাখছি, সময়োপযোগী সহযোগিতা দিয়ে এ বাজারকে আরও বিস্তৃত করতে সরকারের সুনজর অব্যাহত থাকবে।

বিনিয়োগবার্তা: জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান কিভাবে বাড়তে পারে?

কে এ এম মাজেদুর রহমান:  জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়াতে হলে এ বাজারকে আরও গণমুখী করতে হবে। বাজারের গভীরতা আরও বাড়াতে হবে। বাজারের গভীরতা বাড়াতে এখানে ভাল কোম্পানি তালিকাভূক্ত করতে হবে। আর এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে। প্রয়োজনে আইন-কানুন বা বিধি-বিধান কিছুটা পরিবর্তন করে হলেও তাদেরকে এখানে আনতে হবে। এসব কোম্পানির পেইড আপন ক্যাপিটাল অনেক। তাই তারা বাজারে আসলে এমনিতেই বাজারের সাইজ বড় হবে। এরফলে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক লাভবান হবেন।

বিনিয়োগবার্তা: এ বিষয়ে সরকারের ভিতরে ও বাইরে অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কেন?

কে এ এম মাজেদুর রহমান: আসলে রাষ্টায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার অফলোড করতে সরকারের জোড়ালো ভূমিকা নিতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে বারবার তাগিদ দিয়ে আসলেও নানা জটিলতায় বিষয়গুলো আটকে আছে বলে আমরা শুনে আসছি। কিন্তু জটিলতা এড়াতে কোনো ভুমিকা আমরা ওইভাবে দেখছি না। এ বিষয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রীও বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু কেনো বিষয়টি আলোর মুখ দেখছে না; তা বোধগম্য নয়। আর বড় শিল্পগ্রুপ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে আইন-কানুনের কিছু ছাড় দেওয়ার ব্যাপার আছে বলে আমি মনে করি।   ট্যাক্স-ভ্যাট বা অনান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদেরকে বিছুটা ছাড় দিয়ে বাজারে আনতে হবে। আর বাজারে আসলে তারা কি ধরনের ফ্যাসিলিটিজ পাবে, এসব বিষয়ে তাদেরকে বুঝাতে হবে।  এছাড়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অধিকাংশেরই মাদার প্রতিষ্ঠান যেহেতু দেশের বাইরে,। এদেশে শুধু তাদের সিস্টার কর্নসার্ন কাজ করছে। কাজেই তারা চাইলেই ক্যাপিটাল রেইজ করতে পারে না।তারা শুধু ওয়ার্কি ক্যাপিটাল নিতে পারে। এজন্য  তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে আমাদের পুঁজিবাজারের গুরুত্ব বুঝাতে হবে। তাই মাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে আইন-কানুনের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। আর এটিও করতে হবে সরকারের পক্ষ থেকেই। কারণ, সরকার চাপ প্রয়োগ করলেই কিন্তু তারা নড়ে-চড়ে বসবে।

বিনিয়োগবার্তা: বাজারে ডেরিভেটিভস, বন্ড মার্কেট, ইটিএফসহ নতুন প্রোডাক্ট চালু করার বিষয়ে বলুন।

কে এ এম মাজেদুর রহমান:  দেশের পুঁজিবাজারে নতুনত্ব আনতে ইতোমধ্যে কিছু নিয়ননীতি পরিবর্তন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। আমরা সেসব নিয়ননীতির আলোকে প্রস্ততি গ্রহন করছি। আসলে নতুন প্রোডাক্ট চালু করতে প্রশিক্ষিত লোকবলেরও প্রয়োজন রয়েছে। আমার এখন সেদিকটায় বেশি নজর দিচ্ছি। আমাদের লোকবলকে কিভাবে প্রশিক্ষিত করা যায়, তার যথাযত পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে পুঁজিবাজার এখন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এগুচ্ছে। এ বাজারের ব্যাপ্তি বাড়াতে নতুন প্রোডাক্টের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। আমরাও বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণের চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি।

বিনিয়োগবার্তা: মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না? এ জন্য কি করা যেতে পারে?

কে এ এম মাজেদুর রহমান: আপনি ঠিকই বলেছেন। মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিশ্ব বাজারে অনেক জনপ্রিয় হলেও আমাদের এখানে তা হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হয়, এ বিষয়ে আমাদের প্রচার প্রচারণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ফান্ডগুলোর উদ্যোক্তাদের উচিত প্রচারণায় গুরুত্ব দেওয়া। বিনিয়োগকারীদেরকে ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগের নিষ্চয়তাসহ বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে বুঝানো উচিত। তারা এ ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগের বিভিন্ন সুবিধা সম্মন্ধে জানতে পারলেই এগুলো জনপ্রিয়তায় ফিরবে।

বিনিয়োগবার্তা: স্ট্র্যটেজিক পার্টনার নেওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে বলুন।

কে এ এম মাজেদুর রহমান: আসলে স্ট্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত বিনিয়োগকারী নেওয়ার জন্য আমরা চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা এ বিষয়ে আগ্রহপত্রও  পেয়েছি। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু বিশাল  একটি  ব্যাপার; তাই যাচাই-বাছাই না করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিএসইসিরও সম্মতির দরকার রয়েছে। তাই সার্বিক বিষয়াদি মাথায় রেখেই আমরা এগুচ্ছি। আশা রাখছি খুব দ্রুতই এ বিষয়ে একটি ‍সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবো।

বিনিয়োগবার্তা: দায়িত্বকালিন সময়ে আপনি ডিএসইকে কোন মাত্রায় নিয়ে যেতে চান?

কে এ এম মাজেদুর রহমান: আসলে আমাদের দেশে বর্তমান অর্থনীতির আকার ও জাতীয় বাজেট তথা জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজার খুবই ছোট। উন্নত দেশগুলোর জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান ৬০-৭০ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু আমাদের এখানে এটি মাত্র ২২ শতাংশ। এ অবস্থার উত্তোরণ ঘটাতে চাই। জাতীয় অর্থনীতিতে বা জিডিপিতে ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান বাড়াতে যা কিছু করণীয় সেইভাবেই নিজের কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করতে চাই। তবে সেজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযেগিতা খুবই প্রয়োজনীয়। আমি আশা করবো এ বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের নীতিনির্ধারনী মহল, কর্মকর্তা-কর্মচারী, গণমাধ্যমসহ সকলের সহযোগিতা পাবো।

বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

কে এ এম মাজেদুর রহমান: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ অন্য দু/একটি ব্যবসার মতো নয়। এ বাজারে বিনিয়োগের জন্য স্টাডি করা বা শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। জেনে-বুঝে এবং বিশ্লেষণ করে এখানে বিনিয়েগে আসতে হবে। হুট করে কারো পরামর্শে এখানে বিনিয়োগ করবো আর কিছু লাভ বা লোকসান করে চলে যাবো, এমনটি হওয়া যাবে না। এখানে বিনিয়োগের দুইটি ধরন। একটি সর্ট টার্ম ইনভেস্টমেন্ট, আরেকটি লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট। সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকে এখানে ভেবে চিন্তে বিনিয়োগে আসতে হবে। আর একটি কথা হলো- এখন বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার জন্য বিভিন্নমুখী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকারও এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক সকলেই এ বিষয়ে কাজ করছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহীদেরকে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ শিক্ষা নিয়ে আসার জন্য আমার পরামর্শ থাকবে। আর প্রশিক্ষন নিয়ে বিনিয়োগে আসলে লোকসানে পড়ার ঝুঁকি কম থাকবে।তাই আমি বলবো সচেতন বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজিবাজার অত্যন্ত ভালো বিনিয়োগের জায়গা।

(রেজা/শামীম/ ২৯ জুলাই ২০১৭)

 

 

 

 

 


Comment As:

Comment (0)