এফডিআইয়ের জন্য নিরাপদ ও লাভজনক গন্তব্য হবে বাংলাদেশ: কে এম আমিনুল ইসলাম

আগামী দিনের বাংলাদেশকে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) এর জন্য একটি বিশ্বমানের গন্তব্যে নিয়ে যেতে চাই। এলক্ষ্যে সকল অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। বিদেশিরা যেন এখানে সহজভাবে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পায়, সেদিকে আমরা সর্বদাই খেয়াল রাখছি। এটি শুধু বিদেশিদের জন্যই নয়, দেশিয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও সহজতর হচ্ছে।

একান্ত আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কে এম আমিনুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শামীম আল মাসুদ। পাঠকদের উদ্দেশে আজ তুলে ধরা হলো সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় পর্ব ।

বিনিয়োগবার্তা: আপনার দৃষ্টিতে বিগত দিনে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) মিসিংগুলো কি কি?

কে এম আমিনুল ইসলাম: আসলে বিনিয়োগ উন্নয়নের কাজটি হচ্ছে সামগ্রিক একটি কাজ। এই সংস্থার মূল কাজগুলো হলো- সকল মন্ত্রনালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়ন কাজ তরান্বিত করা। বিগত দিনের বিওআইতে এই সামগ্রিকতার অনুপস্থিতি ছিল। বিওআই এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। আর এ কারনে বিনিয়োগ সেবা পেতে উদ্যোক্তাদের অনেক হয়রানী হতে হতো। এসব কারনে তাদের অনেক সময়ও নষ্ট হয়ে যেতো।

”আসলে বিনিয়োগ উন্নয়নের কাজটি হচ্ছে সামগ্রিক একটি কাজ। এই সংস্থার মূল কাজগুলো হলো- সকল মন্ত্রনালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়ন কাজ তরান্বিত করা।”

একপর্যায়ে উদ্যোক্তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলতেন। এই অবস্থা থেকে উন্নয়নের লক্ষ্যেই বিডার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ওই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্ঠা করছি। আগামীতে এক ছাদের নীচে থেকেই উদ্যোক্তারা আমাদের সব সেবা পেয়ে যাবেন। এতে সরকারের উন্নত দেশ গড়ার পরিকল্পনা আরও দ্রুত বাস্তবায়ণ হবে।

বিনিয়োগবার্তা: আগামীতে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টকে (এফডিআই) আপনারা কোন অবস্থানে নিয়ে যেতে চান?

কে এম আমিনুল ইসলাম: আগামী দিনের বাংলাদেশকে এফডিআইয়ের জন্য একটি বিশ্বমানের গন্তব্যে নিয়ে যেতে চাই। এলক্ষ্যে সকল অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। বিদেশিরা যেন এখানে সহজভাবে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পায়, সেদিকে আমরা সর্বদাই খেয়াল রাখছি। এটি শুধু বিদেশিদের জন্যই নয়, দেশিয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও সহজতর হচ্ছে। আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বলছি- তাদের প্রয়োজনগুলো আমাদেরকে অবহিত করতে। আমরা তাদের অভিজ্ঞতা বা মতামতকে মূল্যায়ণ করে কাজ করতে চাই।

”দেশে শিল্প-বিনিয়োগকে তরান্বিত করতে সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটির কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এসব অঞ্চলের মধ্যে বিদেশিদের জন্য আলাদা জোন করা হয়েছে। ওইসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশিরা সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। ”

শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের যে সকল উদ্যোক্তা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন কিংবা ইমোমধ্যে যারা এখানে বিনিয়োগ করে সফলতা পেয়েছেন; আমরা চেষ্ঠা করছি তাদের মাধ্যমেও বিদেশিদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রভাবিত করতে। মোটকথা, সকল অবকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে এফডিআই’র জন্য বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ ও লাভজনক স্থানে রূপান্তরিত করা আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
আপনারা জানেন, দেশে শিল্প-বিনিয়োগকে তরান্বিত করতে সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটির কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এসব অঞ্চলের মধ্যে বিদেশিদের জন্য আলাদা জোন করা হয়েছে। ওইসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশিরা সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। এলক্ষ্যে আমাদের চেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে সার্বক্ষনিক নজর রাখছেন এবং আমাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি অতি দ্রুতই আমরা এ কাজে আরও সফলতা লাভ করতে পারবো।

বিনিয়োগবার্তা: বিডাকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো কি কি? কি কি প্রক্রিয়ায় এ সকল নির্দেশনা বাস্তবায়ণ করছেন?

কে এম আমিনুল ইসলাম: বিডাকে শিল্প-বিনিয়োগের বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। শিল্পায়নের জন্য যে সকল সুযোগ সুবিধা দরকার তা তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তাবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন। বিডা হওয়ার পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার যখন প্রথম কথা হয়, তখনই তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন বিডাকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সকল পদক্ষেপ নিতে। এক্ষেত্রে তিনি সকল সহযোগিতা দেবেন বলেও উল্লেখ করেছেন। আমরা তারই আলোকে কাজ করছি। গত বছরের ০১ সেপ্টেম্বর বিডা প্রতিষ্ঠার দুই মাসের মাথায় আমরা প্রথম বোর্ড সভা করেছি। ওই সভায় তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত দিক নির্দেশনা ও কর্মকৌশল দিয়েছেন।

‘‘শিল্প-বিনিয়োগের বিষয়টি যেন ঢাকা বা চট্টগ্রাম কিংবা বিশেষ কোনো অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এটিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করে দিতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উদ্যোক্তা তৈরী করে আনতে হবে।’’
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের যেসব বড় বড় অর্জন রয়েছে সেগুলোকে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবো। পাশাপাশি যেই সকল বিষয়ে আমাদের আগ্রহ রয়েছে সেসব বিষয়ে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আর বিনিয়োগকারীদের যেসব বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে সেগুলোকে জাতীয় স্বার্থের আলোকে আমরা বিবেচনা করবো। এছাড়া বিশ্বের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকর্ষণ করার ব্যবস্থা গ্রহন করবো। এছাড়াও দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন, শিল্প-বিনিয়োগের বিষয়টি যেন ঢাকা বা চট্টগ্রাম কিংবা বিশেষ কোনো অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এটিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করে দিতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উদ্যোক্তা তৈরী করে আনতে হবে। এজন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষনের পাশাপাশি তাদেরকে অর্থায়নের বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিতে হবে। পাশাপাশি তারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরোনো, প্রতিষ্ঠিত ও সফল উদ্যোক্তাদের তত্ত্বাবধানের মধ্যে রাখারও নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রশিক্ষন, আর্থিক বা পুঁজির সংস্থান এবং তত্ত্বাবধায়ণ-এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে বলেছেন তিনি। আগামী দিনের সুখী বাংলাদেশ তারাই নির্মান করবেন বলে তিনি দৃঢভাবে বিশ্বাস করেন। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ণে আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি।

বিনিয়োগবার্তা: ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত দেশ’ হতে হলে জিডিপিতে বেসরকারি খাতের অবদান কি হতে হবে?

কে এম আমিনুল ইসলাম: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু উচ্চ আয়ের দেশে হতে হলে আমাদেরকে মধ্য আয়ের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ি এটি হতে হবে ২০২১ সালের মধ্যে।

’’এখন দেশের অর্থনীতির সাইজ হচ্ছে ২৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকে এর পরিমান ১২গুন করতে হবে। এর জন্য আমাদের হাতে সময় আছে ২৪ বছর। তাই প্রত্যাশিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে এখনকার হিসাব নিকাশ যথেষ্ট নয়। এই হিসাব আরও বাড়াতে হবে। আর এজন্য সবাইকে মিলে মিশে কাজ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দলাদলি হানাহানি থাকলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ’’

এখন মধ্য আয়ের সীমানা হচ্ছে ১২ হাজারের ডলারের চেয়ে কিছু বেশি। এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৬শ ডলারের কিছুটা বেশি। আর এ হিসেবে ২০৪১ সালে মধ্য আয়ের সীমাটা প্রায় ১৫ হাজার ডলার হবে। এখন দেশের জনসংখ্যা ১৬০ মিলিয়ন, আর তখন যদি জনসংখ্যা ২০০ মিলিয়নও হয় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাইজ হবে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এখন দেশের অর্থনীতির সাইজ হচ্ছে ২৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকে এর পরিমান ১২গুন করতে হবে। এর জন্য আমাদের হাতে সময় আছে ২৪ বছর। তাই প্রত্যাশিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে এখনকার হিসাব নিকাশ যথেষ্ট নয়। এই হিসাব আরও বাড়াতে হবে। আর এজন্য সবাইকে মিলে মিশে কাজ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দলাদলি হানাহানি থাকলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। গণতান্ত্রিক দেশে একাধিক দল থাকবে, একাধিক মত থাকবে; এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতায় যেই দল বা যেই জোটই থাকুক না কেন, কোনো অবস্থায়ই উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করা যাবে না। আমাদের সবাইকে উন্নয়নের প্রশ্নে একাট্টা থাকতে হবে। তাহলেই কেবল বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আপনারা জানেন, ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আমাদের মাথাপিছু আয় দ্বিগুন হয়েছে। বর্তমান সরকারের ৮ বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ৫গুন বেড়েছে। যদি আট বছরে ৫ গুন হতে পারে, তাহলে ২৪ বছরে ১২ গুন কোনো বিষয় নয়। বাঙ্গালী বীরের জাতি। এ জাতি পারে না-এমন কাজ নেই। সবাই মিলে মিশে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব বলে আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি।

(প্রিয় পাঠক বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান কে এম আমিনুল ইসলামের  সাক্ষাৎকারটির পরের পর্বে থাকছে পুঁজিবাজার নিয়ে তার নিজস্ব মতামত ও পরামর্শ। অপেক্ষা করুন আর থাকুন বিনিয়োগবার্তার সঙ্গেই।)

(শামীম, ০৯ সেপ্টেম্বর, ১২ ডিসেম্বর,২০১৭)


Comment As:

Comment (0)