পুঁজিবাজার ও ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে শিল্পোন্নয়ন তরান্বিত হবে: কে এম আমিনুল ইসলাম
পুঁজিবাজার ও ব্যাংক যৌথভাবে শিল্পায়নের পুঁজি সরবরাহ করলে দেশের উন্নয়ন তরান্বিত হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কে এম আমিনুল ইসলাম ।
তিনি বলেন, যে কোনো পুঁজিবাজারের কয়েকটি বিশেষ দিক থাকে। এসবের মধ্যে বাজারের ব্যাপকতা ও গভীরতা অন্যতম দুটি বিষয়। বড় বা ভালো কোম্পানি বাজারে আসতে এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর বড় বা বৃহৎ কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হলেই এর ব্যাপকতা বাড়ে।
”সাধারণ মানুষের এ বাজারের প্রতি আস্থা সৃষ্টি করতে আমাদের কাজ করতে হবে। এখানে দক্ষ লোকবল তৈরী করতে হবে। বিনিয়োগকারীদেরকের সচেতন করে তুলতে হবে। বাজারের প্রতি মানুষের আস্থার পরিবেশ তৈরী করতে হবে।”
দেশের পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে দেশের সাধারণ মানুষের কাছেই যথেষ্ট টাকা রয়েছে। কিন্তু এসব টাকা বাজারে আনতে বাজারের প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা বা আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণ মানুষের এ বাজারের প্রতি আস্থা সৃষ্টি করতে আমাদের কাজ করতে হবে। এখানে দক্ষ লোকবল তৈরী করতে হবে। বিনিয়োগকারীদেরকের সচেতন করে তুলতে হবে। বাজারের প্রতি মানুষের আস্থার পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এদেশের অতি সাধারণ মানুষেরও পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। এই আগ্রহকে কাজে লাগাতে হবে। পুঁজিবাজার এবং ব্যাংক যৌথভাবে শিল্পায়নের পুঁজি সরবরাহ করলে দেশের উন্নয়ন তরান্বিত হবে। সেলক্ষ্যে পুঁজিবাজারকে প্রস্তুত করতে হবে।
বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শামীম আল মাসুদ । ছবি তুলেছেন মঞ্জুরুল রেজা। পাঠকদের সাক্ষাৎকারটির তৃতীয় ও শেষ পর্ব তুলে ধরা হলো।
বিনিয়োগবার্তা: দেশে বিনিয়োগ কম হলে বেকারত্ব বাড়ে, আর্ত-সামজিক বিশৃংখলাসহ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিডায় দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়- সেজন্য আপনার দিকনির্দেশনা ও পদক্ষেপগুলো কি কি?
কে এম আমিনুল ইসলাম: দেখুন, জাতীয় পর্যায়ের অনেক কাজই সফল হয় সবকিছুর সামষ্টিক ফলাফলে। এই দেশের সম্পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য আমরা কাজ করছি। এলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিল্পায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সমস্যা চিহ্নিত করতে।
”দেশে ১০০ ইকোনোমিক জোন বাস্তবায়ণ শুরু হয়েছে। ইপিজেডগুলোকে আধুনিকায়ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পায়রা-বেনাপোল থেকে শুরু হয়ে সিলেটের সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত ইকোনোমিক কডিডোর করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরফলে এসব এলাকার রাস্তার দুপাশে শিল্পায়ণ হবে। এরসঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আর কর্মসংস্থান বাড়লে মানুষের জীবনমানও উন্নত হবে।”
একইসঙ্গে তিনি এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে দেশে ১০০ ইকোনোমিক জোন বাস্তবায়ণ শুরু হয়েছে। ইপিজেডগুলোকে আধুনিকায়ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পায়রা-বেনাপোল থেকে শুরু হয়ে সিলেটের সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত ইকোনোমিক কডিডোর করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরফলে এসব এলাকার রাস্তার দুপাশে শিল্পায়ণ হবে। এরসঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আর কর্মসংস্থান বাড়লে মানুষের জীবনমানও উন্নত হবে। সরকার এসব পদক্ষেপ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নে দৃঢপ্রতিজ্ঞ। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ণ হলে দেশের আর্ত-সামজিক অবস্থার উন্নতি হবে। আর দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়ার কাজটি আরও তরান্বিত হবে।
বিনিয়োগবার্তা: ব্যাংকে জমে থাকা অলস টাকাকে শিল্প-বিনিয়োগে ব্যবহার করতে উদ্যোক্তারা অনেক দিন ধরেই ব্যাংক লোনের সুদ হার কমাতে বলছেন। ইতোমধ্যে এ হার কিছুটা কমলেও তারা এটিকে আরও কমাতে বলছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
কে এম আমিনুল ইসলাম: এ বিষয়ে আমার একটি আলাদা মত রয়েছে। আসলে ব্যাংকে যে পরিমান অলস টাকা, এগুলো প্রকৃত পক্ষে শিল্পায়নের টাকা নয়। ব্যাংকের টাকা অধিকাংশই সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা। গ্রাহকের প্রয়োজনে যখন তখনই এই টাকা ফেরত দিতে হবে। এই টাকা দীর্ঘমেয়াদী শিল্পে বিনিয়োগ করা যাবে না। শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী ফান্ড। পৃথিবীর উন্নত দেশে এ ধরনের ফান্ডের জন্য পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে এখনো সেইরকম কিছু হয় নি। আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটের যে অমিত সম্ভাবনা আছে, তা এখানো বাস্তবায়নের পথ ধরেনি। আমরা এ বিষয়ে বারবার বলে আসছি যে, শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ফান্ড ব্যবস্থা করা হোক। তবে সুদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সুদটা হচ্ছে মূলত ‘রিস্ক প্রিমিয়াম’। যে দেশের অর্থনীতি যত ঝুঁকিপূর্ণ, সেই দেশের সুদের হার তত বেশি, আবার যে দেশের পুঁজির পরিমান যত কম, সেদেশের সুদের হারও বেশি। বাংলাদেশে সুদের হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এখানে ফান্ডের অপ্রতুলতা এবং ব্যবসায়ে ঝুঁকি। এসব দীর্ঘমেয়াদী ফান্ড ও ঝুঁকির পরিমান যত কমে আসবে সুদের হারও তত কমে আসবে। এ বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে কাজ করছে। অচীরেই এর ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিনিয়োগবার্তা: শিল্পায়নে গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহের অগ্রগতি সম্পর্কে বলুন।
কে এম আমিনুল ইসলাম: দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ন। এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫ হাজার ছাড়িয়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের দিকে যাচ্ছে। আগামীতে এটি আরও বাড়বে। এখন শিল্পায়নের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ দিতে পারছি। কিন্তু গ্যাসের বিষয়টিতে একটু দেরি হচ্ছে। এ সমস্যা দূর করতে সরকার এলএনজি টার্মিনাল নির্মানের ব্যবস্থা নিয়েছে। এলএনজি টামিনাল থেকে গ্যাসিফাই করে এসব গ্যাস শিল্পে সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আনন্দের সংবাদ হলো, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে গ্যাসের প্রতুলতা দূর হবে। আর ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি এর সুফল পাবেন বলে আশা রাখছি।
বিনিয়োগবার্তা: বিডার ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ নিয়ে বলুন। কতদিনের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা এর সুফল পাবেন?
কে এম আমিনুল ইসলাম: দেশে শিল্পায়ণ তরান্বিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিডায় ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। এটি হলে এক ছাদের নীচে বিনিয়োগসংক্রান্ত সব সেবা পাবেন উদ্যোক্তারা। আর এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি আইন তৈরী হচ্ছে। শিগগীরই এ আইনটি চূড়ান্ত হবে। আইনটি চূড়ান্ত হলেই আমরা এটি বাস্তাবায়ণ শুরু করবো। ইতোমধ্যে শুধু বিদেশিদের জন্য এটি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে। আশা করি আগামী ৬ মাসের মধ্যে আমরা সকলের জন্য এই সেবা চালু করতে পারবো। আমি বিশ্বাস করি, এরফলে বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিণত হবে ‘বিডা’।
বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
কে এম আমিনুল ইসলাম: এদেশের বিনিয়োগকারীদের আমি আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই। কারন, তাদের সফলতার জন্যই দেশের জিডিপি সাড়ে সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তাদের বিনিয়োগের উপর ভিত্তি করেই দেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে আর অচীরেই উন্নত দেশে পদার্পন করতে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষিত যুব সমাজকে আমি বলবো, আপনারা শুধু চাকুরীর আশায় না থেকে, উদ্যোক্তা হিসাবে আতœপ্রকাশ করুন। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকারের যেসব সুযোগ সুবিধা রয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগান। নিজে প্রতিষ্ঠিত হউন আর অন্যের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করুন। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আমি বিদেশিদেরও সাধুবাদ জানাই। আমি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বলবো, আপনারা বাংলাদেশে আসুন। এটি বিপ্লবীদের দেশ। এদেশের মানুষের সফলতার কথা শুনুন। এখানে শিল্প বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার শ্রম পৃথিবীর অনান্য অঞ্চল থেকে সহজলব্য ও সাশ্রয়ী। আপনার এই সুযোগকে কাজে লাগান। আমরা আপনাদেরকে সর্বাতœক সহযোগিতা করবো।
প্রসঙ্গত, ০১ আগস্ট, ২০১৬ তারিখে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৬’ এর মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড ও বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশন’ একীভূত হয়ে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ নামে আতœপ্রকাশ করে। আইনের আলোকে ২০১৬ সালের ০১ সেপ্টেম্বর নতুন আঙ্গিকে এ সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই বেসরকারি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহদান, শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা প্রদান এবং সরকারি শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও এসবের অব্যবহৃত জমি বা স্থাপনা অধিকতর উপযোগী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রশাসনিক সমন্বয় সাধন ও উন্নততর সেবা প্রদানের নিমিত্তে কাজ করে আসছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আওতাভূক্ত এ সংস্থাটি। মামনীয় প্রধানমন্ত্রী এই দপ্তরের প্রধান বা চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বরত রয়েছেন।
(এসএএম/ এমআই/ ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭)