পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে নিজস্ব বিচার বিশ্লেষণকে কাজে লাগান: মো: রহমত পাশা
‘পুঁজিবাজার হচ্ছে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাজার। তবে তা কার জন্য। যারা বাজার সম্পর্কে বুঝে না তাদের জন্য। অতি তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার জন্য এখানে বিনিয়োগে আসবেন না। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে নিজস্ব বিচার বিশ্লেষণকে কাজে লাগান। অন্যের কথায় এখানে বিনিয়োগ করবেন না। নিজে পুঁজিবাজার সম্পর্কে বুঝতে চেষ্ঠা করুন। কোথায় বা কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবেন তা নিয়ে ভাবুন। কোম্পানির মৌলভিত্তি কিংবা দূর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে চেষ্ঠা করুন। তাহলেই বিনিয়োগে লাভবান হবেন।’
একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো: রহমত পাশা। বিনিয়োগবার্তার পাঠকদের উদ্দেশে তার সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
বিনিয়োগবার্তা: দেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
রহমত পাশা: দেশের পুঁজিবাজার এখন একটি ভাল অবস্থানে রয়েছে। অনেক দিন পর এখন ভলিউম বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই বাজারের ইনডেস্ক ও ভলিউম বাড়ছে। এটা বাজারের খুবই ইতিবাচক। এ অবস্থা আগের বছরগুলোর তুলনায় খুবই ভাল। ২০১০ সালের ধ্বসের আগের সময়টিতে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখবো তখন গড়ে প্রতিদিনই প্রায় ১৬শ কোটি টাকা ট্রেড হতো। ২০১১ সালে এটা ৬শ কোটিতে নেমে এসেছে। এরপরে এটি ৪শ থেকে ৫শ কোটির ঘরে উঠানামা করছে। এরপরের বছরগুলোতেও ঘুরেফিরে ৩-৪শ কোটির ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল লেনদেন। এখন সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাজার। ধীরে ধীরে এই সীমা বাড়তে বাড়তে এখন গড়ে প্রায় ১২-১৪শ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। এটি দেশের শেয়ারবাজারের জন্য মাইলফলক। লেনদেনের এই ধারাবাহিকতা থাকলে অচিরেই আমরা একটি বিনিয়োগবান্ধব পুঁজিবাজার দেখতে পারবো বলে আশা করা যাচ্ছে।
আর ইনডেক্সের বিষয়টিও এখন বেশ ইতিবাচক বলে আমি মনে করি। সদ্য সমাপ্ত বছরে বাজারের ইনডেক্স প্রায় ৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালে ইনডেক্স ছিল ৩৬ শতাংশ নেগেটিভ, ২০১২ সালে ১৯ শতাংশ নেগেটিভ, ২০১৩ সালে বেড়েছে ১ শতাংশ, ২০১৪ সালে বেড়েছে ১৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে নেগেটিভ ছিল ৫ শতাংশ আর ২০১৬ সালে এটি গড়ে বেড়েছে ৮ শতাংশ।
এদিকে সমাপ্ত বছরে মাসিক হিসাবে ইনডেক্সের চিত্রটি ছিল জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নেগেটিভ ছিল। আর মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ধীরে ধীরে ইনডেক্স বাড়তে থাকে। শুধু অক্টোবরে কিছুটা নেগেটিভ ছিল। ওই মাসে প্রফিট টেকিংয়ের প্রবণতা থাকায় এমনটি হয়েছে বলে আমি মনে করি। এছাড়া বছরের বাকি সময়জুড়ে বাজারের সূচক ও লেনদেন ইতিবাচক ধারায়ই ছিল।
এদিকে পিই রেশিও এখন খুব ভাল অবস্থানে রয়েছে। এটি বর্মানে ১৫ এর কাছাকাছি রয়েছে। এতে বুঝা যায়, কোম্পানিগুলোর আর্নিং খুব ভাল হচ্ছে। এটি অবশ্যই ভাল দিক। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যেন, আর কোনো ধরনের অশুভ ছায়া দেশের শেয়ারবাজারে না পড়ে।
আর এ বছর অর্থাৎ ২০১৭ সাল বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক থাকবে বলে আমার কাছে মনে হয়।
বিনিয়োগবার্তা: কেন আপনার কাছে এমন মনে হয়?
রহমত পাশা: আসলে অনেক দিন ধরেই দেশের শেয়ারবাজারে
র একটি সুন্দর সময়ের জন্য বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছিল। ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পর থেকেই মূলত বাজার একটি ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে। এছাড়া ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট অনেক কমে এসেছে, আবাসন খাতের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়, সঞ্চয়পত্রের মুনাফাও কমে এসেছে। এসব কারণে মানুষ বিনিয়োগের জন্য নতুন জায়গা খুঁজছে। আর সেই জায়গাটি যেন শেয়ারবাজার হয়, সেদিকটিতে সংশ্লিষ্ট সকলের লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমি আমার হাউজ দেখেই বুঝতে পারছি যে, বাজারে নতুন টাকা আসছে। অনেকেই হয়তোবা অপেক্ষায় ছিল মার্কেট একটু স্ট্যাবল হলে পুঁজিবাজারে আসবে। বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা বাজারের দিকে ঝুঁকছে। এখন সবাই আস্থার সঙ্গেই বাজারে আসছে বলে আমার কাছে মনে হয়।
বিনিয়োগবার্তা: ইদানিং দেখা যাচ্ছে দূর্বল কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক বাড়ছে। কেন এটি হচ্ছে?
রহমত পাশা: আসলে আমাদের বিনিয়োগকারীরা এতটা বেশি সচেতন এখনো হয়ে উঠে নি। তারা এখনো হুজুগে কিংবা বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে খবর নিয়ে শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করতে চান। আর তারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে আসতে চায় না। এটি ঠিক নয়। বিনিয়োগকারীদের উচিত সংশ্লিষ্ট হাউজগুলোর রিচার্জ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করে কিংবা নজেরা ভালভাবে এ্যানালাইসিস করে শেয়ার কেনা। কিন্তু তারা তা না করে দু/এক জনের পরামর্শ নিয়ে শেয়ার কিনতে চায়। আবার একদিন পরেই তা বিক্রি করেন। এখনও আবার তারা এমনটাই করতে চাচ্ছে। যেসব কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে কোনো ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না,উৎপাদিত পণ্যে কোনো বৈচিত্র আনতে পারছে না কিংবা ভালভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে না, সেসব কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে। আর বিনিয়োগকারীরাও না বুঝে না বিশ্লেষণ করে এসব শেয়ারে ঝুঁকছেন। এ কারনেই তাদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ২০১০ সালেও এমনই হয়েছে। না বুঝে কিংবা হুজুগে খারপ কোম্পানির শেয়ার কিনে তারা আর বের হতে পারেনি। ফলে তারা লোকসানে পতিত হয়েছে। মোটকথা, লক্ষ্যবিহীন বিনিয়োগকারীরাই এ বাজার থেকে ঠকে থাকে।আমি বলতে চাইযে, এ বাজারটি হচ্ছে একটি ক্যালকুলেটিভ বাজার। না বুঝে এখানে বিনিয়োগে আসা ঠিক নয়।
বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে হাউজের পক্ষ থেকে আপনারা কি ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
রহমত পাশা: আমরা প্রতিমাসে বিনিয়োগকারীদের জন্য সচেতনতা মূলক কর্মশালা করে আসছি। এছাড়া আমাদের বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য আলাদা লোকবল বা রিসার্চ টিম রেখে দেওয়া রয়েছে। তারা সবসময়ই বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ম্যান টু ম্যান আলোচনা করে থাকেন। তারা তাদেরকে ভাল শেয়ার ক্রয়ের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমাদের দুটি ব্রাঞ্চেই (ঢাকা ও চট্টগ্রাম) এ কর্মসূচি কার্যকর রয়েছে। তবে ঢাকায়ই এই কার্যক্রম বেশি চলে। এছাড়া আমার দরজাও বিনিয়োগকারীদের জন্য সবসময় খোলা। যেকেউ চাইলে আমার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে পারেন।
বিনিয়োগবার্তা: বিশ্লেষকরা মনে করেন, পিই রেশিও ১৫ এর ওপরে উঠলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এটি কেন?
রহমত পাশা: আমি অনেক বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেছি। আসলে প্রাইস আর্ণিং রেশিও (পিই)’র হিসাবটি তাদের কাছে এরকম নয়। তারা বিবেচনা করে কোম্পানির ফিউচার গ্রোথ কি রকম হবে। যদি ফিউচার গ্রোথ ভাল মনে হয়, তাহলে পিই
বেড়ে যেতে পারে, আর যদি ফিউচার গ্রোথ মন্দ মনে হয় তাহলে পিই রেশিও কমতে পারে। আর এক
টি কথা হলো আমাদের মার্কেট খুবই সেন্সেটিভ। এখানে বিচার বিশ্লেষনের চেয়ে হুজুগ ও প্রেডিকশনের প্রাধান্য বেশি। কিন্তু অনান্য দেশে কিন্তু বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। তবে পিই রেশিওই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগের একমাত্র উপকরণ হতে পারে না।
ভারতের পুঁজিবাজারের বর্তমান পিই রেশিও ১৯, পাকিস্তানে ১২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩০, শ্রীলঙ্কায় ১৩, আর আমোদের এখানে ১৫ এর কাছাকাছি। তাদের সবই ম্যাচিউরড মার্কেট। ওভারঅল হিসাবে আমরাও তাদের চেয়ে খুব দূরে নই।
বিনিয়োগবার্তা: আমাদের বাজারে সমসাময়িককালে যে পরিমান আইপিও আসছে বাজারের গভীরতা বাড়াতে তা কি যথেষ্ট?
রহমত পাশা: আমাদের এখানে ভাল মৌলভিত্তি সম্পন্ন আইপিও কম আসছে। আমরা এই অভাবের মধ্যে আছি। আমাদের এখানে অধিক আইপিওর চেয়ে ভাল মৌলভিত্তি সম্পন্ন আইপিও বেশি দরকার।
আমাদের এখানে গত বছর ৯/১০টি আইপিও এসেছে। ভারতের বাজারে গত বছর ৮৭টি আইপিও এসেছে। কিন্তু আমাদের এখানে নতুন একটি আইপিও আসলে ২০/৩০ গুন আবেদন জমা পড়ে। এতেই বুঝা যায় এখানে আইপিওর যথেষ্ট ডিমান্ড রয়েছে। একটি আইপিও সঙ্গে পরেরটির কিছু গ্যাপ রেখে অনুমোদন দেওয়া উচিত। এটি আসলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাই ভাল বুঝে। তবে বিনিয়োগকারীদের ডিমান্ডের কথা মাথায় রেখে এর পরিমান আরও বাড়ানো উচিত। তবে আমি মনে করি তা হতে হবে বড় সাইজের।
বিনিয়োগবার্তা: রাষ্ট্রায়ত্ত ও বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভূক্তি সম্পর্কে বলুন। অনেকে বলছেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এসব প্রতিষ্ঠান বাজারে আসতে পারছে না। আপনি কি ভাবছেন?
রহমত পাশা: আসলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এটি সরকারের দেখাশুনার বিষয়। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই তারা বাজারে শেয়ার অফলোড করতে বাধ্য থাকবে। আর একটি বিষয় হলো এতোসব জটিলতার পরওতো কিছু সরকারি শেয়ার বাজারে অফলোড হয়েছে। ডেসকো, তিতাস, যমুনা অয়েল, পাওয়ার গ্রীড এসব তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। তাই সবদিক বিবেচনায় এসব প্রতিষ্ঠানকে বাজারে আনার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ডিরেক্ট লিস্টিংয়ের সুযোগ দেওয়া উচিত। অনেক কোম্পানি প্রতিবেশি দেশগুলোতে লিস্টেড হয়ে ব্যবসা করছে আর আমাদের এখানে হচ্ছে না। কেন তারা বাজারে আসতে চায় না, তা খুঁজে বের করা উচিত। প্রয়োজনে তাদেরকে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও বাজারে আনা উচিত বলে আমি মনে করি।
বিনিয়োগবার্তা: ডিএসই অনেক দিন ধরেই স্ট্যাটেজিক পার্টনার খুঁজছে। স্টাটেজিক পার্টনার পাওয়ার পরে কি বাজারের কোনো পরিবর্তন আসব বলে আপনি মনে করেন?
রহমত পাশা: আসলে বাজারের পরিধি বড় করতে এবং বাজারকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পৌঁছাতে বড় বড় কোম্পানির তালিকাভূক্তি দরকার। পাশাপাশি একই ধরনের বিনিয়োগকারীও দরকার। আর স্টাটেজিক পার্টনারের মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ হতে পারে বলে আমার কাছে মনে হয়। আর এ ধরনের পার্টনার আসলে ডিএসইর বোর্ডও নতুন অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। এরফলে এখানে নতুনত্ব আসবে। এটি অবশ্যই আপামোর বিনিয়োগকারীদের জন্য ভাল হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকার সন্তান মো: রহমত পাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট মাস্টার্স করেছেন। আর ভারতের চেন্নাই থেকে এমবিএ কমপ্লিট করেছেন। ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৮৮ সালে দি সিটি ব্যাংকে অফিসার হিসাবে। ওখানে ৮ বছর চাকরী করার পর ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ৫ বছর এলসি ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। এরপর ২০০১ সালে ব্র্র্র্যাক ব্যাংকে প্রায় ১৩ বছর কাজ করেছেন। এরপর ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজে সিইও হিসাবে ৫ বছর কাজ করেন। আর এরপরই ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। সবমিলিয়ে দেশের আর্থিক খাতে মোট ১৮ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
(শামীম/ ১২ মার্চ ২০১৭)