রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা সকল ইস্যুয়ারদেরকেই দেওয়া উচিত: মো: ছায়েদুর রহমান

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত করতে কাজ করার ক্ষমতা সকল ইস্যু ম্যানেজারদের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংক এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ছায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, যেহেতু পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ন্ত্রনের জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন রয়েছে। আর এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে অর্ধশতাধিক ইস্যু ম্যানেজারকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক দক্ষ লোকবল রয়েছে। সুযোগ পেলে তারা এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করতে পারবে। আর যদি তাই হয়, তাহলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আনার প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হয়ে উঠবে। সার্বিকভাবে বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই বিষয়টি লাভজনক হবে।

বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিনিয়োগবার্তা’র হেড অব নিউজ শামীম আল মাসুদ। ছবি তুলেছেন বিনিয়োগবার্তার ফটো সাংবাদিক মঞ্জুরুল রেজা। তার দেওয়া সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।

 

বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন।

ছায়েদুর রহমান: পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা এখন খুবই ভালো। কারণ, বাজারে এখন কোনো প্রতিবন্ধকতা নাই। এখানে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসছে। তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে নতুন ফান্ড ঢুকছে। এখন পুঁজিবাজার অনেক গতিশীল হয়েছে। বাজার আগামী দিনে আরও ভাল হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

 

বিনিয়োগবার্তা: ২০১০ সালের তুলনায় এখনকার অবস্থায় আসার পেছনে কোন কোন ইন্ডিকেশন কাজ করেছে।

ছায়েদুর রহমান: গত দুই বছরের সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সমন্বয়ের যে সীমা ছিল তা তুলে নেওয়া, তাদের মূলধনও বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী আসছে, ফান্ড ঢুকছে। ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়ছে। গতবছরের তুলনায় এ বছর এটি বেড়েছে ৭ থেকে ৮ গুন। সবমিলিয়ে সকল ইন্ডিকেশনই ইতিবাচক। সারাবিশ্ব এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। এখন সেই পরিবেশ তৈরী হয়েছে বলে আমি মনে করি।

 

বিনিয়োগবার্তা: রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাভূক্তি সম্পর্কে বলুন।

ছায়েদুর রহমান: দেখুন, বাজারে নতুন ইস্যু না আসলে এর গভীরতা বাড়বে না। এখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক বেশি। সরকারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভূক্ত হলে যেটি হবে তা হলো নতুন নতুন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে। বিদেশীদের আগ্রহও বাড়বে। সরকারের ভেতর থেকেও এ বিষয়ে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীও আমাদেরকে এ বিষয়ে জোড়ালো আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তার একার পক্ষেতো আর এ বিষয়ক জটিলতাগুলো দূর করা সম্ভব না। এ বিষয়ে আমলাদের আরও উদারতা লাগবে। সকল ফাইলগুলোতো তৈরী করে মন্ত্রীর কাছে পাঠাতে হবে। কিন্তু এ কাজেই যত বিলম্ব। তবে শিগগীরই এ বিষয়ে জট খুলবে বলে আমরা আশাবাদী।

 

বিনিয়োগবার্তা: রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্তির কাজ করার জন্য শুধু আইসিবিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আপনি কি মনে করেন কাজটি সম্পন্ন করতে শুধু আইসিবি যথেষ্ট?

ছায়েদুর রহমান: একসময় আইসিবিই ছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্তি করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এখনতো অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে। সরকারের একটি পলিসি হলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ একমাত্র আইসিবিই করতে পারবে। যদি সরকারের পলিসি পরিবর্তন করা না হয় তাহলেতো তাদেরই করতে হবে। এখন তারা পারুক আর নাই পারুক। তবে আমি মনে করি, এখন যেহেতু পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ন্ত্রনের জন্য শক্তিশালী

কমিশন রয়েছে। আর এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে অর্ধশতাধিক ইস্যু ম্যানেজারকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক দক্ষ লোকবল রয়েছে। সুযোগ পেলে তারা এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করতে পারবে। আর যদি তাই হয়, তাহলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আনার প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হবে। আর সার্বিকভাবে বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই বিষয়টি লাভজনক হবে। তাই আামাদের পরামর্শ হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ সকলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া উচিত।

 

বিনিয়োগবার্তা: অনেক ইস্যুয়ার বছরের পর বছর কোন ইস্যু আনতে পারছে না। তাদের ক্ষেত্রে কি কোনো বাধ্যবাধ্যবাধকতা দেওয়া যেতে পারে?

ছায়েদুর রহমান: দেখুন, আমাদের বাজারে বছরে মাত্র ১০-১২টি ইস্যু আসে। কিন্তু এখানে অন্তত ৫৮টি ইস্যু মেনেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। ছোট বাজারে সব কোম্পানি কাজ পাবে কিভাবে। একারনে এখন দুই/তিন ইস্যু ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি মিলে কাজ করতে হচ্ছে। আবার অনেক কোম্পানি লাইসেন্স নিয়ে রেখেছে, ছোট বাজারে অনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে তারা অন্য ব্যবসা করছে।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সাইলেন্ট মুডে ব্যবসা করতে পারে না, তাদের বিভিন্ন রকম জবাবদিহীতার আওতায় আসতে হয়। একারণে অনেক কোম্পানি বাজার আসতে চায় না। এছাড়া পুরোনো বা বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বড় হয়। কিন্তু বাজারে আসতে গেলে তাদেরকে ফেসভ্যালুতে অর্থাৎ ১০ টাকায় শেয়ার ছাড়তে হয়। আর নতুন পদ্ধতি অনুযায়ি তাদেরকে বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে বাজারে আসতে হয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে প্রিমিয়াম দিতে হয়। আর প্রিমিয়াম দিতে গেলেই যত কথাবার্তা শুরু হয়। এসব কারনেও তারা বাজারে আসতে চায় না। বছরের পর বছর ব্যবসা করে কোম্পানিগুলো বড় হয়। আর ১০ টাকায় শেয়ার কিনেই কোম্পানির মালিক বনে যাওয়ার যে প্রবণতা তা আমাদের বিনিয়োগকারীদের বুঝতে হবে।

আমি বলতে চাই, বাধ্যবাধকতা নয়; বরং বাজারের গভীরতা বাড়াতে অধিক ইস্যু আনার সুযোগ করে দিতে হবে। একটি নতুন ইস্যু আনতে আমাদেরকে বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে শুনিয়ে কোম্পানিগুলোকে রাজি করাতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়গুলো বুঝতে হবে।

 

বিনিয়োগবার্তা: অভিযোগ রয়েছে, বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কারসাজির মাধ্যমে দর নির্ধারণ করে থাকে। আপনি কি মনে করেন?

ছায়েদুর রহমান: দেখুন, বুকবিল্ডিং পদ্ধতিটি একটি বিশ্বময় পদ্ধতি। সারা পৃথিবীতেই বড় কোম্পানিগুলো এ পদ্ধতির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসে। আমাদের এখানে এর বিধিবিধানগুলো নতুন হওয়ায় এ নিয়ে কিছু দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু যারা দ্বিমত পোষণ করছে তারা আসলে না ভেবেচিন্তেই এ কাজটি করছে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ওপর দোষারোপ কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় বলে আমি মনে করি। কারণ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কি এতো এ্যানালাইসিস করার ক্ষমতা আছে। এছাড়া তাদের কি এতো পরিমান পুঁজি আছে যে, তারা বড় রকমের ইনভেস্টমেন্ট করবে। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছাড়া বাজার ধরে রাখবে কে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তারাও বাজারে লিস্টেড। তাহলে তারা যদি লাভবান হয়, তাহলেতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই লাভবান হলো। আসলে আর কিছু দিন গেলেই এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা আরো সচেতন হয়ে উঠবে। তখন আর কেউ এসব কথা বলবে না।

 

বিনিয়োগবার্তা: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকাভূক্তি নিয়ে বলুন।

ছায়েদুর রহমান: এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে বলেছি। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করা জরুরী বলে আমরা তাকে জানিয়েছি। তিনিও আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তিনি আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুতই এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। আর এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোরও সমাধান করার ব্যাপারে তিনি দৃঢভাবে জানিয়েছেন। দেশে চার শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানি কাজ করছে। এদের মধ্যে অন্তত ২৫/৩০ শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত হওয়ার মতো। প্রতিবেশি দেশগুলোতেও তারা তালিকাভূক্ত হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। আমরা চাই যেকোনো উপায়ে তারা আমাদের এখানে তালিকাভূক্ত হউক। এ বিষয়ে আমাদের তদারকি অব্যাহত থাকবে।

 

বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

ছায়েদুর রহমান: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে আমার একটাই কথা, আপনারা অতিরিক্ত লোভী হবেন না। আপনারা জেনে বুঝে বিনিয়োগ করুন। নিজে না বুঝলে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে রিসার্চ টিম রয়েছে, তাদের সঙ্গে বিষয়গুলো শেয়ার করুন। তারাতো আপনাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যই বসে আছে। এছাড়া বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই বা বিআইসিএম সকলেই এসব বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি করে আসছে। এসব বিষয়ে মনোযোগী হউন। সব জেনে বুঝে পরে বিনিয়োগ করুন।

একটি কথা হলো- এখন ব্যাংকে এফডিআর করে লাভ নাই, সঞ্চয়পত্রেও একই অবস্থা। আবাসন খাতের অবস্থাও ভাল নয়। তাই জাগতিক ব্যয় মেটানোর পরে আপনার হাতে যদি অতিরিক্ত টাকা থাকে, তাহলে অবশ্যই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবেন। আর বাজারে তালিকাভূক্ত ভাল কোম্পানিগুলোর প্রায় সবাই নিয়মিতভাবে ভাল পরিমানে লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। তাই বুঝে শুনে ভাল কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করুন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনার সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই আপনাকে সুরক্ষা করবে এবং আপনাকে লাভবান করবে।

 

প্রসঙ্গত, ঢাকার সন্তান মো: ছায়েদুর রহমান একাধারে ইবিএল ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংক এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট, ইমপেরিয়াল ক্যাপিটাল লিমিটেডের পরিচালক, ডিএসই ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের (ডিবিএ)সদস্য। দেশের পুঁজিবাজারসহ আর্থিক খাতের সঙ্গে তার রয়েছে দীর্ঘসময়ের পদচারনা।

 

(শামীম/ ১৩ মার্চ ২০১৭)

 

 


Comment As:

Comment (0)