কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসছে না, তা খুঁজে বের করা দরকার: মাহবুব এইচ মজুমদার
দেশে চার শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানি দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে। এদের মধ্যে অনেক কোম্পানি প্রতিবেশি দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হয়ে ব্যবসা করছে। অথচ আমাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হতে তাদের যত তালবাহানা। এসব কোম্পানি বাজারে আসলে দেশের পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়বে, বাজারও আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পৌঁছাবে। পাশাপাশি, দেশের মানুষ এসব কোম্পানির আয়-ব্যয় ও মুনাফা সম্পর্কে জানতে পারবে। সরকারের উপর মহল থেকে কোম্পানিগুলোকে বহুদিন ধরে তালিকাভূক্ত হওয়ার তাগিদ দিয়ে আসলেও তারা নানা অযুহাতে বাজারে আসতে অপরাগতা দেখিয়ে আসছে। কিন্তু কেন? সমস্যাটি আসলে কোথায়? কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় এসব বহুজাতিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে চায় না, তা খুঁজে বের করা দরকার। এখন সময় এসেছে এসব বিষয় নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণের।
বিনিয়োগবার্তা’র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলছিলেন, দেশের অন্যতম মার্চেন্ট ব্যাংক এএফসি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী মাহবুব এইচ মজুমদার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শামীম-আল-মাসুদ ।
বিনিয়োগবার্তা: জিডিপিতে ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান নিয়ে বলুন। আগামী দিনে কিভাবে এ অবদান বাড়তে পারে?
মাহবুব এইচ মজুমদার: আমাদের জিডিপিতে ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান খুবই নদন্য। আগে এই অবদানের কিছুটা বেশি থাকলেও ইদানিং তা কমে এসেছে। ২০১০ সালে জিডিপি এবং মার্কেট ক্যাপটালের অনুপাত ছিল ৫০.৭০ শতাংশ, ২০১১ সালে এটি কমে গিয়ে ৩৩ শতাংশে দাড়িয়েছে, ২০১২ সালে আরও কমে দাড়িয়েছে ২৬ শতাংশে, ২০১৩ সালে এটি কমে দাড়িয়েছে ২৫ শতাংশে, ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০১৬ সালে জিডিপির সঙ্গে মার্কেট ক্যাপিটালের অনুপাত নেমে এসেছে ১৯ শতাংশে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ এটি ১০/১২ শতাংশে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জিডিপিতে দিন দিন ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান বাড়তে থাকে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে জিডিপির সঙ্গে পুঁজিবাজারের অবদান প্রতিবছরই আনুপাতিকহারে বাড়তে থাকে। আমাদের এখানেও এমনটিই হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না হয়ে এখানে প্রতিবছরই এই অনুপাত কমে আসছে।
তিনি বলেন, আমাদের জিডিপি বাড়ছে। অর্থনীতির সাইজ বড় হচ্ছে। মানুষের আয় বাড়ছে। দেশ উন্নত হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্থাৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে। এটি ঘুরে ফিরে পৃথিবীর সব দেশেই হয়। আবার এটি বেশ কয়েক বছর স্থায়ী হয়। এখন আমাদের দেশে এমন অবস্থা চলছে। এটি অবশ্যই দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। কিন্তু সবকিছু বাড়লেও আমাদের পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়েনি। আর এ কারনেই জিডিপিতে ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান বাড়ছে না। বাজার বড় না হলে জিডিপিতে কিভাবে ক্যাপিটাল মার্কেট অবদান রাখবে।
বিনিয়োগবার্তা: নতুন আইপিও সম্পর্কে বলুন। পুঁজিবাজারের পরিধি বাড়াতে এ পরিমান আইপিও কি যথেষ্ট?
মাহবুব এইচ মজুমদার: দেখুন, ২০০৭ সালে দেশের পুঁজিবাজরে আইপিও এসেছে ১৪টি, ২০০৮ সালে বাজারে আইপিও এসেছে ১২টি, ২০১০ সালে ১১টি, এরপর থেকে প্রতিবছরই ঘুরেফিরে এই ১০/১২টি করে আইপিও বাজারে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পরিমান আইপিও বাজারের জন্য যথেষ্ট নয়। এটি আরও কয়েকগুন বাড়ানো উচিত। যদি আইপিওর পরিমান না বাড়ে তাহলে বাজার বড় হবে কেমন করে।
আমি বলতে চাই বাজারের গভীরতা বাড়াতে অধিকহারে নতুন এবং ভালো কোম্পানির আইপিও দিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনার কার্যকরি উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে আমাদের বাজারে নতুন ইস্যু আনতে রাষ্ট্রায়ত্ত আইসিবি ছাড়াও অন্তত অর্ধশতাধিক ইস্যু ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। কিন্তু যে পরিমান আইপিও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে তাতে সবাই সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারনে অনেক ক্ষেত্রে দুই/তিন কোম্পানি মিলে একটি করে ইস্যু আনতে হচ্ছে। তাই আইপিওর পরিমান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নাই বলে আমি মনে করি।
বিনিয়োগবার্তা: রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়?
মাহবুব এইচ মজুমদার: পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশেই সরকার ব্যবসা করে এমন নজির নাই। কিন্তু আমাদের এখানে এর নজির আছে। দেশের অনেক বড় বড় সেক্টর-করপোরেশন রয়েছে যেগুলো থেকে স্বয়ং সরকারই ব্যবসা করে যাচ্ছে। যেমন- ডিআইটি, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি করছে সরকার। এটা কেন করবে? তাহলে সাধারণ ব্যবসায়িরা কি করবে? সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশনের মতো বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসলে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়া দেশের অনেক বড় বড় প্রকল্পের অর্থের যোগানদাতা হিসাবেও ভূমিকা রাখতে পারে পুঁজিবাজার।
এসব প্রকল্পগুলো তালিকাভূক্ত হলেও এখানে সাধারণ জনগনের অংশগ্রহন বাড়বে, অর্থের যোগান পাওয়া যাবে, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, কর্পোরেট গভর্নেন্স বাড়বে, সচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বাড়বে, প্রকল্পগুলোও লাভজনক হবে। কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল এ বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে বিদেশী সাহায্যের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ বিমান, দেশের সারকারখানাগুলোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও দেশের জনগণের সম্পদ। এগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। এসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসলে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারে আনতে কাজ করার ক্ষমতা শুধু ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইসিবির কি এতো এক্সপার্ট লোকবল আছে? তারা কিভাবে একা এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করবে? আমার কাছে মনে হয়, এসব বিষয়ে সরকারের দৃষ্ঠিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া উচিত। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানই লাভে রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজারে আনতে ‘ব্যুরোক্র্যাসি’ থেকে বের হতে হবে। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী মহলকে আরও সহনশীল ও জোড়ালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিনিয়োগবার্তা: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকাভূক্তি নিয়ে বলুন। কেন তারা বাজারে আসতে চায় না?
মাহবুব এইচ মজুমদার: দেশে অন্তত চার শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে দাপটের সঙ্গে কাজ করছে। প্রতিবেশি দেশসহ বিশ্বের অনান্য দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হয়ে কাজ করলেও আমাদের এখানে তালিকাভূক্ত হতে তাদের যত তালবাহানা। আমরা তাদের কাছে শুধু কনজ্যুমার হিসাবেই রয়ে যাচ্ছি। তারা আমাদের দেশ থেকে কি নিচ্ছে আর বিনিময়ে আমাদেরকে কি দিচ্ছে, তা কেউ জানতেও পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বারবার বলা হলেও কোনো কার্যকরি ফল বিনিয়োগকারীরা দেখতে পাচ্ছে না। মাননীয় অর্থমন্ত্রীও এ বিষয়ে বারবার তাগিদ দিয়ে আসছেন। তিনি এও বলেছেন, প্রয়োজনে আইন কানুনের কিছুটা পরিবর্তন করে হলেও তাদেরকে বাজার আসার সুযোগ করে দেবেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তারা এরপরও বাজারে আসছে না। তাহলে কার স্বার্থ হাসিলের জন্য, কোন বিশেষ মহলের ইন্ধনে তারা পুঁজিবাজারে আসছে না, এখন সময় এসেছে তা খুঁজে বের করার।
তিনি বলেন, বড় বড় এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসলে দেশ ও দেশের জনগণ সবাই লাভবান হবেন। এসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন অনেক। একটি নির্দিষ্ট অংকের শেয়ার ছেড়ে বাজারে তালিকাভূক্ত হলে বাজার মূলধনের উস্ফলন ঘটবে, বাজারের আকার বড় হবে। সরকারও বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে।
আরেকটি বিষয় হলো- তারা পুঁজিবাজারে আসলে আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ হবে, বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ লোকসান নিয়ে প্রশ্ন করবে, করপোরেট গভর্নেন্স বাড়বে, অধিক হারে কর দিতে হবে, নানা ধরনের অডিট হবে। এসবের কারণেই মূলত তারা পুঁজিবাজারে আসছে না।
বিনিয়োগবার্তা: বাজারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
মাহবুব এইচ মজুমদার: দেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা বর্তমানে অনেকটা ভালো বলে আমি মনে করি। বাজার এখন অনেক স্থিতিশীল রয়েছে। এই অবস্থায় এখানে বিনিয়োগ করা যায়।
আর বিনিয়োগকারীদের জন্য আমার পরামর্শ হলো-আপনারা স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগ করতে পুঁজিবাজারে আসবেন না। আগের দিন শেয়ার কিনবেন, আর পরের দিন বিক্রি করবেন-এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসুন। ভাল কোম্পানি দেখে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করুন। আর বিনিয়োগের আগে কোম্পানির শেয়ার দরের দিকে না তাকিয়ে এর অভ্যন্তরে কারা রয়েছে, উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের বেকগ্রাউন্ড কি, কোম্পানির ডিভিডেন্ড হিসট্রি কি, সম্পদ কি রকম এগুলো দেখে, বিচার-বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করুন। তাহলেই এ বাজার থেকে লাভবান হবেন।
(শামীম/ ২২ মার্চ ২০১৭)