বুকবিল্ডিং ও মার্জার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার নতুন কৌশল: আবু আহমেদ

শামীম-আল-মাসুদ, হেড অব নিউজ, বিনিয়োগবার্তা: বুক বিল্ডিং পদ্ধতি ও মার্জার ব্যবস্থাকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার নতুন কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ।

তিনি বলেন, বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির ফন্ডামেন্টাল বা মৌল ভিত্তি বিশ্লিষণ করে শেয়ার দরের প্রস্তাব করা। কিন্তু তা না করে গুটিকয়েক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নিজেদের অতিমূনাফার উদ্দেশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ারের অধিক মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব করছে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের সঙ্গে সখ্যতার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যাচাই বাছাই ছাড়াই অধিক মূল্য নির্ধারন করছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন।

অন্যদিকে নতুন পাবলিক ইস্যু রুলসে বুক বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সাসাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা কমানো হয়েছে। এটিও ঠিক হয়নি।

আবার মার্জার ব্যবস্থার মাধ্যমেও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে।

তালিকাভূক্ত হওয়ার দু এক বছর যেতে না যেতেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে একীভূত করার মাধ্যমে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মোটা অঙ্কের অর্থ বাগিয়ে নিচ্ছে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা সঠিক ভ্যালুয়েশন না করেই কোম্পানিগুলোকে এ ধরনের সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে।

এসবের কারণে বারবার প্রতারিত হচ্ছেন পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

সম্প্রতি বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে দেশের শেয়ারবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন প্রবীন শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বিনিয়োগবার্তার হেড অব নিউজ শামীম আল মাসুদ। এ সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

শেয়ারবাজারের বর্তমান সম্পর্কে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজার পরিস্থিতির কথা বলতে গেলে প্রথমে বলতে হবে বর্তমান বাজার খুব ভালো যাচ্ছে না। সবার প্রত্যাশা ছিলো ২০১৬ পুঁজিবাজারবান্ধব বছর হবে। কিন্তু এখন বাজারে ধারাবাহিক দরপতন হচ্ছে। আবার দু একদিন ভালো থাকলেও সূচক লেনদেন  খুব বেশি বাড়ছে না। এর মূল কারণ অনিয়ম আর নানা অপকৌশলে বাজার থেকে অর্থ বেড়িয়ে যাচ্ছে। রেগুলেটরের ব্যর্থতায় বোনাস শেয়ার ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এবং মার্জারের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা বাহিরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে রেগুলেটরদের কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা নেই।

তিনি বলেন, আইপিওর মাধ্যমে বাজারে নতুন কোম্পানিগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই অধিক প্রিমিয়াম নেওয়ার উদ্দেশে অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে আসছে। আর রেগুলেটররা যাচাই বাছাই না করেই এসব কোম্পানিকে মূলধন সংগ্রহের অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে বাজারে আসার পর প্রথম কয়েক মাস তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে শেয়ার বিক্রি হলেও পরে তা ফেসভ্যালুতে আবার অনেকগুলো তার নিচে নেমে আসছে। এতে করে একদিকে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

আবু আহমেদ বলেন, নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসার আগে তিন-চার বছর তেমন কোনো ডিভিডেন্ড না দিলেও বাজারে এসেই বোনাস শেয়ার ইস্যু করছে। আর তাদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা সেই বোনাস শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। কিন্তু পুনরায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে না। ফলে বাজারে শেয়ার মূল্য পতন হচ্ছে। আর এভাবে অর্থ চলে গেলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে কিভাবে।

এছাড়াও বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর আরো একটি উপায় বের করেছে প্রতারকরা। তা হলো মার্জার প্রতারণা।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মার্জার (একীভূত) করছে। এতে কোম্পানির ইকুইটি বেজ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ফলে শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হয়। আর এসব কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা আনুপাতিক হারে শেয়ার নিয়ে বাজারে বিক্রি করে টাকা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে মনে করেন শেয়ারবাজারের এ বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, মার্জারের নামে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ইকুইটি বেজকে কয়েক গুণ বাড়তে দিলে শেষ পর্যন্ত তার ভার বহন করতে হয় বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

বাজার উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থার করণীয় সম্পর্কে আবু আহমেদ বলেন, রেগুলেটরদের অনেক কিছু করণীয় আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের জন্য বোনাস শেয়ারের ক্ষেত্রে (Lock-IN) লক-ইন সময় বেঁধে দেওয়া। আর এই লক-ইন সময় করতে হবে বোনাস ইস্যু করার প্রথম দুই বছর পর্যন্ত। যাতে করে উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা বোনাস শেয়ার বিক্রি অর্থ তুলে নিতে না পারে।

তিনি বলেন, বর্তমানে নতুন কোম্পানির প্রসপেক্টাস প্রকাশনার তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছর উদ্যোক্তা-পরিচালক জন্য লক-ইন দেওয়া আছে। প্রসপেক্টাস প্রকাশনার তারিখ না ধরে কোম্পানির বোনাস ইস্যু করার প্রথম দুই বছর পর্যন্ত লক-ইন দেওয়া প্রয়োজন।
এছাড়াও আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আরো বেশি যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে প্রিমিয়াম নির্ধারণ কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার বিবেচনা করে দেয়া উচিত।

মার্জার সম্পর্কে তিনি বলেন, একই ধরণের পণ্য উৎপাদনে আছে এমন দুটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, যাদের শেয়ার আছে বাজারে, তাদের মধ্যেই কেবল মার্জারের অনুমোদন বিবেচনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে যে দুই কোম্পানি মার্জার (একীভূত) হবে সেই কোম্পানির লাভ-লোকসান কত? লাভ হলে ট্যাক্স দিয়েছে কিনা, তার দালিলিক প্রমাণ দেখা এবং দুই কোম্পানির সম্পদ মূল্য নতুন করে যাচাই-বাছাই করে রেগুলেটরের অনুমোদন দেওয়া উচিত।

বাজারে ভাল মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার  আসছে না উল্লেখ করে আবু আহমেদ বলেন, কোয়ালিটি সম্পূর্ণ শেয়ারবাজারে আনতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার আরো শক্তিশালি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে যে সব মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি রয়েছে যেমন: ইউনিলিভার, নেসলে, বাংলালিংক, রবিসহ অন্যান্য কোম্পানিকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে বাধ্য করতে হবে। তারা ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে কিন্ত আমাদের কি দিচ্ছে? তারা শুধু আমাদের ভোক্তা বানাচ্ছে। ইউনিলিভার, নেসলে প্রতিবেশি দেশগুলোর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাহলে আমাদের এখানে তালিকাভূক্ত হলে সমস্যা কি?  আর এ জন্য রেগুলেটর একা পারবে না, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাজারে না আসলে তাদের ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়া উচিত।

দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে নিজের প্রত্যাশা ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাজারের এখন যে অবস্থা তা বিনিয়োগযোগ্য। তবে এজন্য রেগুলেটরের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে বাজার উন্নয়নে সরকারের যেসব পলিসি সাপোর্ট রয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যক্তির লভ্যাংশের ওপর ট্যাক্স কমাতে হবে। একইসঙ্গে সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকে একক গ্রাহক ঋণ সমন্বয়ের সময় (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) বাড়াতে হবে।

আর বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো যে কোম্পানির শেয়ার আপনি কিনছেন সেই শেয়ার আপনার সম্পদ। আর এ সম্পদ কেনার আগে আপনাকেই বিবেচনা করতে হবে। তবে আমি বলবো আপনারা (বিনিয়োগকারীরা) জং শেয়ার (যে শেয়ারের দর আগে ৩০ টাকা ছিলো এখন ১০ থেকে ১৫ টাকায় নেমে গেছে) কিনবেন না। কোম্পানির বিগত দিনের ডিভিডেন্ড, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, ওভারঅল পারফরমেন্স দেখে বিনিয়োগ করবেন। সর্বপরি, শেয়ারবাজারে দর ওঠানামা থাকবেই। তাই হুজুগে পড়ে নয়, জেনে-বুঝে ও চিন্তাভাবনা করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আসবেন।

(শামীম/ ০৯ এপ্রিল ২০১৬)


Comment As:

Comment (0)