দেশের জন্য আরো কাজ করার উৎসাহ জাগছে: আব্দুল কাদির মোল্লা
শামীম-আল-মাসুদ, বিনিয়োগবার্তা, ঢাকা: ‘দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সরকারকে কোটি কোটি টাকা কর দিয়ে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু এবার সরকার আমাকে সেরা করদাতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাবতে ভালো লাগছে যে, দেশ ও জাতির জন্য আমি একটা কিছু করতে পেরেছি। সরকার কর্তৃক সেরা করদাতার স্বীকৃতি পাওয়ায় দেশের কল্যানে আরো কাজ করার উৎসাহ জাগছে।’
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে এ কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যক্তি পর্যায়ে দেশের সেরা করদাতা নরসিংদীর কৃতি সন্তান আব্দুল কাদির মোল্লা।
‘যেকথা কেউ বলেনি’ শিরোনামের ওই সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর ব্যবসা বানিজ্যের সফলতাসহ ব্যক্তিগত নানা বিষয়াদি তুলে ধরেন। তাঁর ওই সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশ বিনিয়োগবার্তার পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।
আব্দুল কাদির মোল্লা জানান, ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করায় ছোটকাল থেকেই অভাব ছিল সংসারের নিত্য সঙ্গী। ১৯৭৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর জীবনের শুরুতেই প্রচণ্ড ধাক্কা এলো । তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। বড় ছেলে হিসেবে সংসারের সব দায়িত্বের বোঝা এসে পড়ল আমার ওপর। সে এক বিরাট সংগ্রামের ইতিহাস। একদিকে আমার পড়াশোনা চালানো, অন্যদিকে পরিবারের ভরণ-পোষণ। আমি আর মা কাজ করে কোনো রকমে টেনেটুনে জীবন চালাচ্ছি। প্রান্তিক দারিদ্র্যের সেই জীবন যে কত দুর্বিষহ যন্ত্রণাময়, কত ভয়াবহ হতে পারে, তা ভাবতে গেলে আমি আজও শিহরিত হই !
‘টাকার অভাবে আমার ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ। নিজের মেধা আর শিক্ষার অদম্য আগ্রহ নিয়ে অনেকটা ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে আছি আমি। এলাকায় লজিং থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। ইন্টারমিডিয়েটের ফরম পূরণের সময় এলো। মাত্র ৩৬০ টাকার জন্য পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারলাম না। কত জায়গায়ই তো গেলাম। অনেকের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হলো না। এক দিন বাকি আছে ফরম পূরণের। আমার মনে আছে, সেই রাতে আমি অনেক কেঁদেছি। রাত ভোর হলো। টাকাটা আর জোগাড় হলো না। বুঝে গেলাম, আমার আর পড়ালেখা হবে না। প্রচণ্ড জেদ চাপল। এভাবে জীবন চলে না। বইগুলো আমার চেয়েও গরিব এক বন্ধুকে দিয়ে লজিং বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। এককাপড়ে শূন্যহাতে চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ফ্রি মেরিন ট্রেনিং নিলাম। সেখান থেকেই সুযোগ এলো- সরকারি ভিসায় চলে গেলাম সিঙ্গাপুরে।’
‘সেখানে একটি জাহাজ নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানে টেকনিশিয়ান হিসাবে কাজ করতে থাকি। ভাল টেকনিয়ান হওয়ায় দ্রুত সেখানে আমার পদোন্নতি হতে থাকে। পাশাপাশি বাড়তে থাকে বেতন ভাতাসহ অনান্য সুযোগ সুবিধা। সিঙ্গাপুরে কয়েক বছর এভাবে কাজ করে বেশ কিছু পুঁজি সঞ্চয় করে দেশে চলে আসি। এরপর দেশে ফিরে এসে একটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার খুলে নিজেই আগ্রহী মানুষদের কাজ শেখাতে থাকি। বছর খানেকের মাথায় তিতাস গ্যাসে বিক্রয় সহকারি হিসাবে চাকুরিতে যোগদানের সুযোগ হয়। কয়েক বছর এ পদে চাকুরি করার পর বারবার বদলী আর নানা হয়রানীর কারনে চাকুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।
‘চাকুরি ছাড়ার পর আবারো পুরানো ট্রেনিং সেন্টার চালাতে থাকি। পাশাপাশি অন্য ব্যবসার উদ্দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের ধারস্থ হতে থাকি।’
‘এরই অংশ হিসাবে সর্বপ্রথম অগ্রনী ব্যাংকে লোন নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করি। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রোফাইল দেখে আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। তাই আমার প্রপোজাল ফেরত দেয়। এর কিছুদিন পর সোনালী ব্যাংকে আমার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত প্রোফাইল জমা দেই। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দীরর্ঘদিন এগুলো যাচাই বাছাই করে আমার জন্য ৯৪ লক্ষ টাকা লোন সেংসন করে। সেই টাকা দিয়ে প্রথমে নরসিংদীতে একটি উইভিং ফ্যাক্টরি চালু করি।’
কাদির মোল্লা জানান, ‘শুরু থেকেই আমার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত প্রোডাক্টের জন্য ভাল বায়ার পেয়েছি। আস্তে আস্তে এ ব্যবসায় আমার ভাল প্রোফিট হতে লাগল। ব্যাংক কর্তৃপক্ষও আমার লেনদেনে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে আরো লোন দিতে আগ্রহ প্রকাশ করল। দ্বিতীয় দফায় আমাকে আরো বেশি লোন দিতে সম্মত হলো। এরপর পূনরায় লোন নিয়ে নিজ এলাকা নরসিংদীতে একটি স্পিনিং মিল স্থাপন করি। এমিলের উৎপাদন চালু হওয়ার পর থেকে বিশ্ববাজারে সূতার দাম কয়েকগুন বেড়ে যায়। এরফলে ওই সময় স্পিনিং ব্যবসায় আমি বিশাল অঙ্কের লাভ খুঁজে পাই। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আমাকে আর পিছু তাকাতে হয়নি।
`বর্তমানে বস্ত্র খাতের ১৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আরো ৩টি নতুন মিল স্থাপন প্রসেসিংয়ে আছে। আমার মালকানাধিন মিল ফ্যাক্টরিতে প্রায় ১৭ হাজারের মতো শ্রমিক কর্মরত রয়েছে’।
তিনি জানান, ‘জীবনের শুরুতে শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ার সেই কষ্ট আমাকে তাড়া করে ফিরেছে সব সময়। মনে একটা সংকল্প ছিল-জীবনে যদি কখনো অনেক টাকা রোজগার করি, তাহলে জীবন চালানোর পর যত টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে, তা মানবকল্যাণে ব্যয় করব। টাকার অভাবে শিক্ষাবঞ্চিত হতে দেব না কাউকে। শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করার প্রতিজ্ঞা তখন থেকেই। প্রথম জীবনে আমার না পাওয়ার কষ্ট আজকে আমি অন্যের পাওয়ার মধ্য দিয়ে ভুলে গেছি। আজকে আমার সহযোগিতা পেয়ে যখন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসে আমাকে খবর দেয়, আমি আনন্দে আত্মহারা হই। ভুলে যাই আমার না পাওয়ার দুঃখগুলো।’
কাদির মোল্লা জানান, ‘২০০১ সালের পর থেকে আমার বাবার নামে করা সেচ্ছাসেবি ও সামজিক সংস্থা ‘মজিদ মোল্লা ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এখান থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করছে। নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরেও ৩৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৮৫টি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় কমপক্ষে ২৫-৩০ লাখ টাকা করে এফডিআর করে দিয়েছি। এফডিআরের লভ্যাংশের টাকায় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর যাবতীয় ব্যয় বহন করা হয়। এছাড়া ভবন করে দিয়েছি প্রায় ২৫০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
আমি বিশ্বাস করি, একটি শিক্ষিত জাতি গড়তে পারলে একটি স্বনির্ভর দেশ গড়া যায়। আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই, কিন্তু কোনো একটা বাধা যেন আমাদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না। আমি মনে করি, এটা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ শিক্ষা।’
‘শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়াও চিকিৎসাক্ষেত্রে আমি কাজ করছি। আমার বাবা মজিদ মোল্লার নামে শিগগিরই একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল করার উদ্যোগ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। এ ছাড়া দরিদ্র অসহায় মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে রিকশা, ভ্যান, সেলাই মেশিন, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য অর্থ সহযোগিতা দিয়ে থাকি। ভূমিহীন অসহায় মানুষের জন্য বেশ কিছু বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় করার ইচ্ছা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত, জীবনে বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা, নিজের মেধা ও শ্রমের সমন্বয় আর সততা আমাকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলে আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি’।
(শামীম/০৭ মার্চ ২০১৫)