সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের মধ্যেই হারানো গৌরব ফিরে পাবে পুঁজিবাজার: খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন মুন্নী
সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরটি অর্থাৎ ২০১৭ সালটি পুঁজিবাজারবান্ধব বছর হয়ে উঠবে বলে মনে করেন দেশের অন্যতম নারী বিনিয়োগকারী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক, ডিএসই ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সহ-সভাপতি ও মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন মুন্নী।
তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত সেনসেটিভ বাজার। দেশের যেকোনো মন্দা পরিস্থিতির ব্যাপক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নতুন শিল্প-বিনিয়োগের পরিবেশ এবং শেয়ারবাজার বিষয়ক নতুন নিয়ম-নীতি বা আইন কানুনসহ আনুসঙ্গিক সকল প্যারামিটার ঠিক থাকলে এ বছরের মধ্যেই পুঁজিবাজার তার আগের গৌরব ফিরে পাবে বলে মনে করেন তিনি।
সম্প্রতি বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে এ সম্ভাবনার কথা বলেন তিনি। পাঠকদের উদ্দেশে তার সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন: পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থাকে ইতিবাচক বলা যায়। কারণ ১৯৯৬, ২০১০ এর পর ২০১৫ সালের শুরু থেকেই বাজারে একটি দারুণ মন্দাবস্থা বিরাজ করেছে। এই সময়ে বাজারে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি, গড় টার্ণওভার খুবই কম হয়েছে। অনেক সময় ৩০০ কোটি টাকারও কম লেনদেন হয়েছে। এই অবস্থা ২০১৬ সালেরও প্রায় অর্ধেক সময়জুড়ে চলেছে। এরফলে শুধু বিনিয়োগকারীরাই নয়, আমরা যারা এ বাজারের ব্রোকার হিসাবে রয়েছি আমরাও অত্যন্ত বেকায়দায় পড়েছি। কোটি কোটি টাকা হাউজের খরচ নির্বাহ করতে আমাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেকে তাদের মেম্বারশীপও বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে গত বছরের শেষ দিকে এসে সরকারের কিছু ঘোষণায় বাজার কিছুটা ঘুরে দাড়িয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট সংক্রান্ত নীতিমালা শিথিল করায় বাজারে একটা দারুণ প্রানচঞ্চলতা ফিরে এসেছে। এতোদিন ব্যাংকের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের প্রতি কিছুটা বিমুখ থাকলেও এখন আর সেটা থাকছে না। পাশাপাশি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠছে। তাই আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতি বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারে সরকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকাভূক্তি সম্পর্কে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন: সরকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে প্রতি বিনিয়োগকারীরা খুবই আকৃষ্ট। আমরাও সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় অধিকহারে সরকারী শেয়ার ছাড়ার অনুরোধ করেছি। ২০১০ সাল থেকে আমরা ২৬টি সরকারী প্রতিষ্ঠান বাজারে আনতে সরকারকে জোড়ালো দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এখনো এসব শেয়ার বাজারে আসেনি। সরকার কিভাবে শেয়ার ছাড়বে সেটা বড় কথা নয়, সরকার শুধু সম্মতি দিবে। আর বাকি সব কিছুতো প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই হবে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে সরকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুঁজিবাজারে আসছে না। এ বিষয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসলে মার্কেটের গভীরতা আরো বাড়বে। এরফলে বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, সরকার-রাষ্ট্রসহ সকল পক্ষই লাভবান হবে। তবে আশার কথা হলো- আমরা ডিবিএর নির্বাচনের পর মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন এ বিষয়ে খুব শিগগিরই কার্যকরি উদ্যোগ নেবেন। ইতোমধ্যে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের নিয়ে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন বলেও আমরা জেনেছি। আশা রাখছি এবার এসব বিষয়ে কার্যকরি ফল পাওয়া যাবে।
বিনিয়োগবার্তা: দেশের অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপের পুঁজিবাজারে আসতে অনিহা রয়েছে। কিন্তু কেন?
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন: পুঁজিবাজারে কোন কোম্পানি আসলে নানা ধরনের অডিট ও জবাবদিহীতা করতে হয়। এসকল কারনে হয়তো অনেক কোম্পানি বাজারে আসতে চায় না। কিন্তু এটা ঠিক নয়। বড় কোম্পানি বাজারে আসলে বাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ আরো বাড়বে, বাজারে আস্থার সংকট থাকবে না, তারল্য সংকট থাকবে না। আসলে সরকারের উচিত তাদেরকে বিভিন্নভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে হলেও বাজারমুখী করা।
এ বিষয়ে সরকারেরও বেশ দায়িত্ব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি নির্ধারিত সময়ের পরে কিংবা একটি নির্দিষ্ট পরিমান পেইড আপ ক্যাপিটালের ওপরে হলে বাধ্যতামূলকভাবে সেই কোম্পানিকে বাজারে আসার নিয়ম করে দেওয়া উচিত। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতো তাই করছে। আর এটি না হলে এ বাজারের বিস্তৃতি ঘটবে কেমন করে।
বিনিয়োগবার্তা: মার্কেটের গতি ও লেনদেন প্রসঙ্গে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন: সম্প্রতি সরকার পুঁজিবাজার বিষয়ে বেশ কিছু সংস্কার করেছে। ট্যাক্স কমিয়ে আনা, ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা, এডিবির কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহ, ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং এ্যাক্ট বাস্তাবায়ন, সর্বশেষ ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট শিথিল করা- এসব কিছুই বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক। ইতোমধ্যেই এসবের সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। বাজার এখন অনেক স্থিতিশীল ও গতিশীল। আর এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আমরা একটি সমৃদ্ধ, সুন্দর, স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পুঁজিবাজার দেখতে পারবো।
বিনিয়োগবার্তা: বাজারে দূর্বল কোম্পানির তালিকাভূক্তি সম্পর্কে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন: পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়ার আগে কোম্পাগিুলোর সার্বিক বিষয়াদি অবশ্যই ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে দেওয়া উচিত। কোম্পানির মৌলভিত্তি, ইপিএস, ম্যানেজমেন্ট, করপোরেট গভর্নেন্স, সুনাম সবকিছু বিচার বিবেচনা করে অনুমোদন দেওয়া উচিত। আর প্রিমিয়াম দেওয়ার ক্ষেত্রেতো এ বিষয়গুলো আরো জরুরী। বাজারে আসার আগে অডিটরদের মাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটি ফিনান্সিয়াল স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়ে কোম্পানি তালিকাভূক্তির অনুমোদন করিয়ে নিল, আর বাজারে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই কোম্পানির শেয়ার দর ইস্যু মূল্যের নীচে নেমে গেল- এসব হতে দেওয়া যাবে না। এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আরো সতর্ক হতে হবে।
বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন মুন্নী: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ বাজার সবার জন্য নয়। এখানে বিনিয়োগ করার আগে শিখতে হবে, বুঝতে হবে এবং বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তারপর বাজারে আসতে হবে।
তিনি বলেন, নিজের এবং পরিবারের বরণ পোষণের পর অতিরিক্ত টাকা থাকলে তা নিয়ে পুঁজিবাজারে আসুন। কখনই ধার করা টাকায় বিনিয়োগ করবেন না। আর এ বাজারই যেনো উপার্জনের একমাত্র উৎস না হয়। সর্বোপরি আর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে চাইলে দীর্ঘমেয়াদে ভাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন।
প্রসঙ্গত, জামালপুরের মেয়ে খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন (মুন্নি) দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রথম নির্বাচিত নারী পরিচালক। এছাড়া ডিএসই ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি। তিনি মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ১৯৯৯ সালে মাত্র ৫০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি পুঁজিবাজারে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ ১৭ বছরের সম্পৃক্ততায় পুঁজিবাজারের বিভিন্ন চড়াই উৎরাই দেখেছেন তিনি। কিন্তু এরমধ্যেও হাল ছাড়েননি তিনি। সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করলে সফলতা আসবেই বলে মনে করেন দেশের অন্যতম এই নারী বিনিয়োগকারী।
(শামীম/ ১৭ এপ্রিল ২০১৭)