পোশাকে আমার বর্ণমালা

বিনিয়োগবার্তা ডেস্ক, ঢাকা: বইমেলায় বসে আছেন দুই কবি শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন। হঠাৎ শামসুর রাহমান বললেন, ‘দেখুন, একটি শাড়ি হেঁটে যাচ্ছে।’
ফজল শাহাবুদ্দীন দেখলেন দারুণ একটা সাদা শাড়ি। তিনি বলছেন, ‘আমি তাকিয়ে দেখি সাদা সেই শাড়ি বাংলা বর্ণমালায় ভরা। তা পরে হেঁটে চলেছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম, পোশাকেও এমন দেশপ্রেম হতে পারে!’
সালোয়ার–কামিজ, শাড়ির আঁচল ও জমিনে একুশের গান ও কবিতা।

২০১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের একটি প্রদর্শনীতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। সেখানে এই প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘তাঁর (জাহানারা ইমাম) সেই শাড়িতে কালো আর লালচে রঙে বাংলা বর্ণমালা আঁকা ছিল। অনেকেই সেদিন মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন জাহানারা ইমামকে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অনেক আগে থেকেই পোশাকের নকশা করতে দেখা গেছে। আমাদের এখানেও অনেক বছর ধরে ডিজাইনাররা পোশাকে তুলে আনছেন বাংলা ভাষা। শব্দ ও বর্ণমালা দিয়ে নকশা করা হচ্ছে শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবি বা টি-শার্ট। একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই সাদা-কালো পোশাক। আর তাতে বাংলা গান, কবিতা, ছড়া, স্লোগানের ব্যবহার।

ডিজাইনার ও গবেষক চন্দ্রশেখর সাহা জানালেন, ১৯৮২ বা ৮৩ সালের দিকে ফ্যাশন হাউস আড়ংয়ের হয়ে বর্ণমালার নকশা দিয়ে পোশাক ডিজাইন করেছিলেন তিনি। শাড়ি, শার্ট ও পাঞ্জাবিতে ব্যবহার করেছিলেন বাংলা বর্ণমালা।
ধীরে ধীরে পোশাকের জমিন ভরে উঠছে বর্ণমালায়। জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ফ্যাশন ডিজাইনাররা বাংলা কবিতা, গান বা একুশের স্লোগান দিয়ে করেছেন পোশাকের নকশা। এখনো চলছে সেই ধারা।

এবার দেশের অনেক ফ্যাশন হাউস সাদা আর কালো রঙের পোশাক এনেছে বাজারে। শাড়ির আঁচল ও জমিনে উঠে এসেছে অমর একুশের গান ও কবিতা। গোটা গোটা অক্ষরে পোশাকের জমিনে লেখা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলা’। ফ্যাশন হাউস সাদাকালোর ডিজাইনার তাহসিনা শাহিন বলেন, ‘সাদাকালো যাত্রা শুরুর পর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশেষ ভাবনায় রেখে পোশাকের নকশা করে। এবার আমরা বেছে নিয়েছি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর লেখা একুশের প্রথম কবিতাটিকে। পুরো কবিতাটা একটা জায়গায় ব্যবহার করে শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবি ও শিশুদের পোশাকের নকশা করা হয়েছে।’

আছে একুশের স্লোগান দিয়ে করা ফতুয়া, টি-শার্ট ও পাঞ্জাবি। ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’ বা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
ভাষার দাবিতে রাজপথের মিছিলের ছবির ছাপও দেওয়া হয়েছে অনেক ফ্যাশন হাউসের পোশাকে। শাড়ির জমিনে, আঁচলে, পাড়ে আছে এক লাইনের বিশেষ লেখা। পাঞ্জাবির বাটন প্লেট, হাতার মুখে বা বুকের পাশে ব্যবহার করা হয়েছে একুশের কবিতা। ‘সাদা ও কালো কাপড়ে তৈরি শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবিতে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। শাড়ির ক্ষেত্রে এই লেখাটি হাতে এঁকে তারপর স্ক্রিনপ্রিন্ট করা হয়েছে। সাদা, কালোর বাইরে হালকা লাল রং ব্যবহার হয়েছে কোথাও কোথাও।’ জানালেন ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার ডিজাইনার লিপি খন্দকার। ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিবিয়ানায় আবারও পাওয়া যাচ্ছে লেখক আনিসুল হকের ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি’ কবিতার লাইন দিয়ে করা পর্দা।

অনেক আগে থেকেই টি-শার্টের ডিজাইনে বাংলা বর্ণমালা এবং নানা ধরনের কবিতা ব্যবহার করেছে নিত্য উপহার। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান জানালেন একুশের অসংখ্য কবিতার লাইন সংগ্রহ করে নিত্য উপহারের চাদর করা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘এবার গানের লাইন দিয়ে শাড়ির নকশা করা হয়েছে। বর্ণ ও শব্দমালা দিয়ে করা হয়েছে টি-শার্ট। সামনে আরও বড় পরিসরে একুশের আবহে নকশা করব।’
নিজের মায়ের ভাষা বাংলাকে পোশাকে তুলে আনার কাজটি করছেন দেশের ডিজাইনাররা। আর সেই ভাষার বর্ণমালা, লেখামালাকে পরম মমতায় পোশাকে ধারণ করছেন বাঙালিরা।

(এমআইআর/ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)


Comment As:

Comment (0)