ক্রুজ শীপে সুন্দরবন

ক্রুজ শীপে সুন্দরবন ভ্রমণ (পর্ব-০১)

শামীম আল মাসুদ: সমুদ্রে ভাসমান যানে পূর্ণিমা রাত্রি যাপনের শখ অনেক আগে থেকেই। কিন্তু সময়-সুযোগের অভাবে কিছুতেই যেন হয়ে উঠছিল না। এবার সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো মামুন ভাইয়ের ফোন পেয়ে। বলছিলাম সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেডের কোম্পানি সচিব আজহারুল মামুন ভাইয়ের কথা। গত ১৪ নভেম্বর বিকেলে মোবাইল ফোনে তিনি জানালেন ১৬ নভেম্বর থেকে দু/তিন দিন সময় হবে কিনা। সুন্দরবন এলাকায় সী পার্লের ক্রুজ শীপ চালু করা হবে। পর্যটন ব্যবসায় আরও সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে এ ব্যবসায় যুক্ত হতে যাচ্ছে তাদের কোম্পানি। সেখানে অতিথিদের মধ্যে আমিও একজন। মূহুর্তেই রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, একেতো পূর্ণিমার সময়, আবার ক্রুজ শীপে সুন্দরবন ভ্রমণ!

 

১৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় গ্রীণ লাইনের গাড়িটি ঢাকার রাজারবাগ থেকে ছেড়ে কল্যাণপুরে আরও সঙ্গীদের নিয়ে রাত ১১:৩০ মিনেটে রাজধানী ছাড়ে। পথিমধ্যে দৌলদিয়া ঘাটে কয়েক ঘন্টা ফেরি পারাপারের অপেক্ষা। বিরক্তিকর একটা ব্যাপার! এখানে একটি সেতুর বাস্তবায়ণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

 

যাইহোক, গাড়ি খুলনায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল প্রায় ১০টা। আমরা খুলনা শহরে আর দেরি না করে জেলখানা ঘাটে অপেক্ষমান ছোট নৌকায় করে জাহাজের উদ্দেশে রওণা দেই। সফরসঙ্গীদের মধ্যে আমাদের সহকর্মী আমিনুল ইসলাম বাবু, রাহাত মেহেদী, নিয়াজ মাহমুদ সোহেল, ইব্রাহীম হোসেন রেজোয়ান, গিয়াস উদ্দিন, আলী রিয়াজ, ফয়সাল হাসান, শ্যামল দাসসহ আরও অনেকেই রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর কোম্পানির প্রতিনিধিসহ মোট ৫২জন পর্যটক নিয়ে সী পার্ল ক্রুজ-০৩ নামক জাহাজটি উদ্বোধনী যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। ছোট নৌকায় খানিক দূর গিয়েই আমরা ক্রুজ শীপে আরোহণ করি। সেখানে পূর্বনির্ধারিত কেবিনে নিজের ব্যাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়েই দৌড় নাস্তার টেবিলে। লঞ্চ ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। প্রায় ঘন্টাখানেক এগিয়ে সী পার্ল গ্রুপের কটেজে খানিক যাত্রা বিরতি। এই স্থানটি অত্যন্ত চমৎকার ও সম্ভাবনাময়। নদীর ধারে বেশ কয়েক বিঘা বাউন্ডারিবেস্টিত ছিমছাম রেস্টহাউজ। ভেতরে বেশ কিছু প্রজাতির পশু-পাখির মিনি চিরিয়াখানা, খেলাধুলা করার মাঠ আর কটেজে বেশ কিছু ছোট বড় গেস্টরুম। বিল্ডিংয়ের ছাদে বা বারান্দায় বসে সামনে তাকালে রূপসা নদী। যেখানে ছোট বড় অসংখ্য জাহাজ, লঞ্চ ও নৌকার চলাচল। এককথায় চমৎকার জায়গা! এখানে আরো আধুনিকায়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সী পার্ল গ্রুপ। কটেজে চা-কফি খেয়ে আবরো ক্রুজ শীপে সুন্দরবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু। জাহাজে সী পার্ল গ্রুপের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির সেলস এন্ড মার্কেটিং ডিরেক্টর রাসেল ভাই, গ্রুপ ম্যানেজার আজিম শাহ, কোম্পানি সচিব আজহারুল মামুন, হেড অব সেলস এন্ড মার্কেটিং আসাদ ভাইসহ বেম কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন। তাদের মধ্যে গ্রুপ ম্যানেজার আজিম শাহ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলেও বাংলাদেশে বিয়ে করার সুবাধে তিনি বাংলাদেশেই দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। হোটেল এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায় তার রয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা। অত্যন্ত সদালাপি ও হাসিখুশি এই মানুষটি পুরো সময়জুড়ে আমাদেরকে নানা অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন।

 

বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ক্রুজ শীপের ধারণা নতুন। আর যতদূর জানতে পেরেছি সুন্দরবন অঞ্চলে ৫০ মিটারের চেয়ে বড় পর্যটক জাহাজ চলাচলের অনুমতি নেই। তাই শী পার্লের জাহাজগুলোও এই সীমার মধ্যেই। প্রাথমিকভাবে তারা দুটি জাহাজ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। আরও দুটি বিলাশবহুল জাহাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব জাহাজে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকছে। 

 

আমাদের মাঝাড়ি গোছের জাহাজটি এগিয়ে চলছে সুন্দরবণের প্রাকৃতিক লীলাভূমিতে। এরইমধ্যে দুপুরের খাবারের ডাক। শীপের উপরের তলায় সুন্দর ছিমছাম ডাইনিং। চোখ জোড়ানো প্রকৃতি আর সুস্বাদু সব খাবারের সমাহার আমাদেরকে আরও মুগ্ধ করেছে। খাবার শেষে নিজ রুমে বিশ্রামের জন্য আসলাম। যেহেতু রাত জেগে জার্ণি করেছি, তাই শরীরের ক্লান্তি কাটাতে খানিক বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। বিছানায় শুয়ে একটু চোখ লাগতেই ঘোষণা এলো- আমাদের জাহাজ থেকে একটি কুমির দেখা যাচ্ছে, তীরে উঠে বিকেলের রোদ তাপাচ্ছে, যাদের ইচ্ছে দেখতে পারেন। একথা শুনে আর দেরি নয়। মূহুর্তেই উঠে দৌড় জাহাজের ওপরের তলায়! ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গীদের অনেকেই এই দৃশ্য দেখতে ভীড় জমিয়েছেন! অনেকে ছবি বা ভিডিও করতে শুরু করেছেন।

 

আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে। আমরা জাহাজের উপরের তলায় বসে চা-কফি পান আর জমপেস আড্ডায় মেতে উঠেছি। আর সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে চলেছি।

এরইমধ্যে বিকেলে পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জাহাজ চলছে। সন্ধ্যার দিকে জাহাজটি কচুখালি নামক স্থানে নোঙ্গর করেছে। এখান থেকে আমাদের জাহাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সুন্দরবনের অলিগলিতে ভ্রমনের জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিতে চলে গেলেন। আর আমাদের গাইড ঘোষণা দিলেন তারা ফিরে আসলেই এখান থেকে ছোট নৌকায় করে আমরা একটি নদীতে প্রবেশ করবো। সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট আর টর্চলাইট থাকবে। এখন জোয়ারের সময়। আমরা নদীতে যেতে যেতে টর্চলাইটের আলোতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর সন্ধান করবো। যেই কথা-সেই কাজ। জাহাজের সঙ্গে নিয়ে আসা ট্রলারে চড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ট্রলার চলছে কঁচুখালি এলাকার নদীর একপাশ বেয়ে। আমরা টর্চ লাইটের আলোতে পশু-পাখির সন্ধান করছি। বেশ কিছু ভেতরে প্রবেশের পর আমাদের ট্রলার দুটি বন বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের চোখে পড়ল। তারা আমাদেরকে ফলো করতে লাগলেন। একপর্যায়ে তারাও একটি নৌকায় করে আমাদের কাছাকাছি চলে আসলেন। জানতে চাইলেন এতো রাতে জোয়ারের সময় আমরা ভেতরে কেন যাচ্ছি? আমাদের ট্রলারে অবস্থান করা বন বিভাগের গানম্যান তাজুল ইসলাম ভাই তাদেরকে জানালেন যে আমাদের অনুমোদন নেওয়া আছে। তারা তখন আমাদেরকে রাতের বেলায় এতো গভীর বনাঞ্চলে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফিরে গেলেন। আমরাও আর বেশি দূর না গিয়ে জাহাজের উদ্দেশে ব্যাক করলাম।

 

জাহাজে ফিরে ফ্রেস হয়ে জানলাম রাতের খাবার রেডি। আমরা রাতের খাবার খেতে জাহাজের উপরের তলায় হাজির। একটা কথা না বললেই নয় যে, আমাদের জাহাজের সেফ এর হাতের রান্না অত্যন্ত চমৎকার ও সুস্বাদু। হরেক রকমের সবজি, সামুদ্রিক মাছসহ নানা ধরনের খাবার আমাদের মুখরিত করেছে।

 

খানাপিনা শেষে জাহাজের গাইড পরের দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিলেন।

তিনি জানালেন, আমরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে লেবুখালি এলাকায় ছোট নদী দিয়ে গহীণ বনের ভেতরে প্রবেশ করবো। সেখানে জঙ্গল ট্র্যাকিং হবে। রাতের শেষ দিকে জোয়ারের পানি নেমে যাবে। তাই কিছুটা কাদাযুক্ত মাটিতে হাটা লাগবে। সেখানে বনের ভেতরে হরিণ-বাঘ-বানরসহ নানা প্রজাতির পশু-পাখির দেখা মিলতে পারে। তাই বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সবাইকে দল বেধে চলতে হবে।

 

চলবে……………..

 

(এসএএম/১১ ডিসেম্বর ২০২১)

 

 


Comment As:

Comment (0)