রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনীতিতে প্রভাব
ড: মিহির কুমার রায়: ২০১৯ সালে ইউক্রেন পশ্চিমাপন্থি আমেরিকার মদদপিষ্ঠ নূতন সরকার ক্ষমতায় আসে এবং রাশিয়ার নিষেধ উপেক্ষা করে ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়ার চেষ্ঠা চালায়। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল ডনবাসে দুটি শহর দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এ সশস্ত্র আন্দোলনরত রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাশিয়ার সহযোগিতায় এপ্রিল মাসে এই দুটি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যার ফলশ্রুতিতে গত ৭ বছর ধরে এ অঞ্চল দুটিতে চলা ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘাতে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন গত ২১ ফেব্যুয়ারি সেই বিতর্কিত অঞ্চল দুটিকে একতরফাভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে গণহত্যা বন্ধে ‘শান্তি রক্ষার জন্য’সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেন এবং আকস্মিকভাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলোতে পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে জল, স্থল ও আকাশ পথে ব্যাপকভাবে হামলা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমাপন্থিদের বিক্ষোভ ও সহিংস আন্দোলনের মুখে ইউক্রেনের রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পতন হয় এবং তিনি দেশ ছেড়ে রাশিয়া পালিয়ে যান। এর কিছুদিন পর কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপে রুশপন্থি সেনাবাহিনী সরকারি দপ্তর দখল করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্যাপক গোলযোগ সৃষ্টি হলে সেনা অভিযানের মাধ্যমে ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
এই ঘটনার জের ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় বিশেষত এশিয়া ও ইউরোপিয় মহাদেশের দেশগুলোতে যা আমরা মিডিয়ার বদৌলতে অবলোকন করছি প্রতিনিয়তই এবং ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত খসড়া নিন্দা প্রস্তাবে ১১টি দেশ পক্ষে এবং চীন, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে ভোট দানে বিরত থাকে। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ জারি করেছে। অনেকেই মনে করেন, পশ্চিমারা বিভিন্ন অবরোধ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও রাশিয়াকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। কারণ রাশিয়া জানে ইউক্রেনে হামলা করলে তাকে সম্ভাব্য পরিণতি ভোগ করতে হবে এবং আর সেজন্যই রাশিয়া কয়েক বছর ধরে ব্যাপক সামরিক উন্নয়ন ও দেশের অর্থনীতির রিজার্ভ মোটামুটি স্থিতিশীল করেছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবরোধে রাশিয়ার পাশে চীন এগিয়ে আসবে বলে মনে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্নায়ু যুদ্ধে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রসমূহ অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ তার মিত্রসমূহের মধ্যকার টানাপড়েন মেটাতে ১৯৪৯ সালে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও ন্যাটো জোট পশ্চিম থেকে ক্রমাগতভাবে পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। শুরুতে ন্যাটো জোটে ১২টি দেশ থাকলেও বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে সদস্য ৩০টি দেশ হয়েছে। পরবর্তীকালে তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রভুক্ত কিছু দেশ ন্যাটোভুক্ত হয়। রাশিয়ার নিষেধ সত্বেও ইউক্রেন ন্যাটোজোটে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করলে রাশিয়ার জন্য তা হুমকি তৈরি করে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন ন্যাটো সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যাবেনা এই ভেবে যে ইউক্রেন ন্যাটোজোটের সদস্য না।
এমনিতে করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম ঊর্ধ্বগতিসহ মূল্যস্ফীতি রয়েছে এবং এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কাজেই বিশ্ব পরিস্থিতি সবদিক বিবেচনা করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য এবং জ্বালানি তেল ও দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখতে হবে। এ প্রেক্ষাপটেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান বলছেন, যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে যদি তা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকে, বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিঘ্নিত হবে ও অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকিও বাড়বে। অনেক ‘ফান্ড’ ‘ডাইভার্ট’করতে হবে ইউক্রেনের জন্য-সাহায্যের জন্য। দেশের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও অর্থনীতিবিদরা নানাভাবে সতর্ক করছেন বর্তমান সরকারকে। জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৬০-৭০ ডলারে এসে স্থিতিশীল হবে বলে মনে করা হলেও বর্তমানে ব্যারেল প্রতি দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ১২০ ডলারে রয়েছে যেখানে তেল ও গ্যাসের বড় সরবরাহকারি দেশ হলো রাশিয়া। চলতি বছরে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র ৪৮ হাজার কোটি টাকা যা যুদ্ধের কারনে এর পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১ লাখ কোটি টাকার উপরে যদিও এরি মধ্যে কৃষিতেই ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে চার গুণ। বাংলাদেশে গম আমদানি হয় বছরে ৬০-৭০ লাখ টন যার ৩০ শতাংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে যা আমাদের খাদ্য তালিকায় ধানের পরেই স্থান করে নিয়েছে। এই গমের আমদানি যদি বিঘ্নিত হয় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারনে, তাহলে খাদ্যের সংকট সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে বলে প্রতিয়মান হয় যা কাম্য নয়। কারণ আমদানি ব্যয় বাড়লে জাহাজের পরিবহণ খরচ বাড়বে, ডলারের উপর চাপ আছে, ডলারের বিপরিতে টাকার মূল্যমান ৯০ টাকায় উঠেছে যা আমদানীকারকদের জন্য মোটেই সুখবর নয় এবং ৫০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ যা বর্তমানে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে যা দিয়ে কয়মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে তা সময়ই বলে দেবে, তাছাড়াও যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে তার প্রভাব পড়বে পোশাক রপ্তানি খাতে, কাঁচামাল সরবরাহে, রপ্তানি ও আমদানি বানিজ্যে, লক্ষাধিক কোটি টাকার ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে’, করোনা-উত্তর পুনরুদ্ধার কাজে ইত্যাদি। রাশিয়ার ওপর ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নিষেধাজ্ঞায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে হয়তো সমস্যা হবে না, যেহেতু রিঅ্যাক্টরসহ সবকিছু মোটামুটি পৌঁছে গেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন এবং পরিচালনায় সমস্যা হতে পারে। তবে মূল সমস্যাটা হবে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ এগিয়ে নেওয়ার বেলায়। রাশিয়ার ওপর চিপ রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে ভেস্তে যেতে পারে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ প্রকল্পও।
দেশে বর্তমানে চলমান ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটের ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকাই ঘাটতির (৩৫ শতাংশ) মুখে আছে, এদিকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার অতি উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে মোট ঘাটতি প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে। অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির পর জিনিস পত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে বলে অর্থনীতিতে নতুন একটা স্থবিরতা কাজ করতে পারে। এমনিতেই নির্মাণ সামগ্রীর দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বা এডিপি বাস্তবায়নের গতি কমে গেছে। ফলে এসব খাত থেকে ভ্যাট ও শুল্ক কমে যাওয়ায় রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়েছে। যুদ্ধের ফলে স্থবিরতাটা আরও বাড়বে, এতে সরকারের রাজস্ব আয় আরও কমে যেতে পারে। আর রাজস্ব কমার অর্থই হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ঋণ, ব্যাংক ঋণসহ বৈদেশিক ঋণের প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা বাড়া, যেহেতু সরকারের জন প্রশাসন খরচ, উন্নয়ন খরচ, ভর্তুকি খরচ এবং যাবতীয় অপখরচ কমছে না।
যুদ্ধ স্থানীয় হলেও তার অভিশাপ বিশ্বব্যাপী। এমতাবস্থায় সরকারকে অপখরচের লাগাম থামিয়ে, দ্রব্যমূল্য কমাতে শুল্ক কমানোর ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। শুল্ক কমাতে গেলে যেহেতু রাজস্ব আরও কমে, বাজেটের ঘাটতি আরও বাড়বে, তাই একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা আনতে হবে, অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধি ও অপব্যয় দুটোই থামাতে হবে। অন্যথায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ জ্বালানি মূল্য, কঠিনতর আন্তর্জাতিক সরবরাহ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে অযাচিত বিভীষিকা তৈরি করতে পারে। সাধু সাবধান!
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ