মিশর ও মিশরীয় সভ্যতা
কাজী মোজাহারুল জাহিদ: মানব জাতির ইতিহাসের এক পর্যায়ে মানব সভ্যতার ইতিহাস শুরু হয়। সম্প্রতি মানব সভ্যতার ইতিহাস পড়তে গিয়ে তাতে সভ্যতার ক্রমবিকাশের নানা তথ্য উপাত্ত খুঁজে পাই। মানব >সভ্য >সভ্যতা> সংস্কৃতি>মানবিকতা -এভাবেই সম্ভবত ইতিহাসের অগ্রযাত্রা। ঘাটাঘাটি করে প্রাপ্ত তথ্যগুলো প্রয়োজনীয় এবং যে কারো জানার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
ঐতিহাসিক যুগের পূর্বের সময়কে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ। প্রাগৈতিহাসিক যুগ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও নতুন প্রস্তর যুগ। প্রাচীন যুগে দীর্ঘ সময়ের জন্য বরফে ঢেকে যেত পুরো পৃথিবী। এই সময় অনেক দীর্ঘ হত, একে বলা হত বরফ যুগ।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের বিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মে এবং বিভিন্ন পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। প্রাইমেট, খাড়া মানুষ, জাভা মানব, পিকিং মানব ইত্যাদি বিষয়ে অনেক প্রাচীন তথ্য পাওয়া গেলেও খ্রীস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে নীলনদের উপত্যকায় মানব বসতির সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু খ্রীস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতা স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের লক্ষ-কোটি বছরের মাত্র ৬০০০ বছরই জানি।
খ্রীস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। খ্রীস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এশিয়া থেকে যাযাবর হিকস'রা মিশর দখল করে। খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের কিছু পরে মিশরের রাজা তৃতীয় থাটমোস সিরিয়া,প্যালেস্টাইন, লিবিয়া, নুবিয়া ইত্যাদি অঞ্চল জয় করেন। তিনি দজলা-ফেরাত থেকে নীলনদের দক্ষিনাঞ্চল পর্যন্ত অধিকার করেন। খ্রীস্টপূর্ব ৬৭০ অব্দে এসিরিয়'রা মিশর দখল করে। খ্রীস্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে পারস্যের রাজশক্তি মিশর দখল করে। খ্রীস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে গ্রিকবীর আলেকজান্ডার মিশর দখল করে। তার মৃত্যুর পর সেনাপতি টলেমি মিশরে রাজত্ব করে। পরবর্তীতে রোমান'রা গ্রীকদের কাছ থেকে মিশর দখল করে। সপ্তম শতাব্দীতে রোমানদের বিতাড়িত করে আরব'রা মিশর দখল করে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা.'র যুগে সেনাপতি হযরত আমর ইবনুল আস রা. এর নেতৃত্বে ৬৪১ সনে মিশর জয় করেন। আরবদের পরে তুর্কিরা মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে। তুর্কিদের পরে আসে ব্রিটিশরা, ১৯৫২ সনে নাসেরের সামরিক বিপ্লবের মাধ্যমে মিশরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
আধুনিক গণপ্রজাতন্ত্রী মিশর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। আর ব্রিটিশ সৈন্যরা সম্পূর্ণরূপে মিশর ছেড়ে যায় ১৯৫৬ সনে সুয়েজ খালে সংঘটিত ইসরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স কর্তৃক ত্রিপক্ষীয় আগ্রাসনের পরাজয়ের পরে যা সুয়েজ সংকট নামে পরিচিত। এর পর থেকেই মিশর সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন এবং এর নিজস্ব অধিবাসীদের হাতে শাসিত একটি রাষ্ট্ররূপে পরিগণিত হয়। অভ্যন্তরীণ শাসক জামাল আব্দুন নাসের (১৯৫৬-১৯৭০ নাগাদ রাষ্ট্রপতি) মিশরে অনেক পরিবর্তন আনেন এবং তিনিই সিরিয়ার সাথে স্বল্পমেয়াদী ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক(১৯৫৮-১৯৬১) গঠন করেন। ১৯৬৪ সালের গঠিত প্যালেস্টাইন লিবারেশান ফ্রন্ট (পিএলও)-র প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যামের সংগঠনেও নাসেরের ভূমিকা প্রধান ছিল।
তার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতও (১৯৭০-১৯৮১) মিশরে অনেক পরিবর্তন আনেন।১৯৭৩ সালে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ উদ্ধারের জন্য ইয়ম কিপুর যুদ্ধে তিনি মিশরের নেতৃত্ব দেন। মিশর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তির কারণে আনোয়ার সাদাত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। চুক্তির ফলে মিশর সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পায়।
বর্তমান মিশরের ইতিহাস সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারকের ত্রিশ বছরের শাসন পরবর্তী ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত। ২০১১-র মিশর বিপ্লবের মাধ্যমে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করেন এবং মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন যিনি হলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুহাম্মাদ মুরসি। তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেন এবং ভূরাজনীতিকভাবে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ও বিদ্রোহীদের সাহায্য করেন।
পরবর্তীতে আবদেল ফাত্তাহ সাইদ হুসেন খলিল এল-সিসি মিশরের ষষ্ঠ এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ২০১৪ সালে। তিনি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক, প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং প্রাক্তন জেনারেল। এই হল মিশরের হাজার বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনে মিশরীয়দের রয়েছে নানা অবদান। সর্বপ্রথম সেচ ব্যবস্থার উৎপত্তি হয় মিশরে। মিশরের শাসকদের বলা হত ফারাও বা ফেরাউন। মিশরীয় 'রা সূর্য দেবতায় বিশ্বাসী ছিল।
খ্রীস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে পৃথিবীর প্রাচীন লিপি হায়ারোগ্লিফিক উদ্ভব হয় প্রাচীন মিশরে। মিশরের প্রাচীন আকর্ষণ হল পিরামিড, যা পৃথিবীর সপ্তা আচার্যের একটি হিসেবে বিবেচিত। সবচেয়ে বড় পিরামিডটি ফারাও খুফুর পিরামিড। এর উচ্চতা ৪৮০ ফুট। সিংহের দেহের উপর মানুষের মুখের যে বিখ্যাত মূর্তি মিশরে রয়েছে তার নাম স্ফিংস। এটি শক্তধর ফারাওদের সাহসের প্রতিক বলে মিশরীয়দের বিশ্বাস।
লুব্ধক নক্ষত্র থেকে ৩৬৫ দিনে বছর প্রথার উদ্ভাবন করেন মিশরীয়'রা। যোগ,বিয়োগ, গুন,ভাগের প্রচলন হয় প্রাচীন মিশরে। এমনকি ত্রিভুজ-চতুর্ভুজের জ্যামিতিক ধারণা গুলোর উৎপত্তিও হয় মিশরীয় সভ্যতায়।
মোটকথা, মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে মিশরীয়'রা খুব সম্ভবত প্রথম জাতি, যারা সভ্যতার সোপানে পা দিয়েছিলেন।
লেখক: ব্যাংকার।