কাজী মোজাহারুল জাহিদ

মেসোপোটেমিয়া সভ্যতাঃ ইরাক

কাজী মোজাহারুল জাহিদ: আরব মরুভূমির পূর্ব দিকে পারস্য উপসাগরের উত্তর পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে উত্তর দিকে ব্যাবিলনীয়া মেসোপোটেমিয়া হয়ে পশ্চিম দিকে বেকে সিরিয়া প্যালেস্টাইন হয়ে আবার দক্ষিণে ঘুরে ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেষে সিনাই মরুভূমি পর্যন্ত  বিস্তৃত হয়েছে যে অঞ্চল- তা মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত এই সভ্যতাকে মিশরীয় সভ্যতার সমসাময়িক বা কিছুকাল পরের সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়

এই অঞ্চলে মানব সভ্যতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যেমন সুমেরীয়, আকাদীয়, ব্যাবিলনীয়, এসিরীয়, ক্যালিডীয়, ফিনিসীয় ইত্যাদি এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে  মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভূখণ্ডের অবদান অপরিসীম  তাই অঞ্চলকে মানব সভ্যতার সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে

মেসোপোটেমিয়া অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তীদেশ তাইগ্রিস (দজলা) ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর মধ্যবর্তী জায়গা টি মেসোপোটেমিয়া নামে অভিহিত

মেসোপোটেমিয়া অঞ্চলে যেকয়টি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন  সুমেরীয়'রা ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানত সুমেরীয়দের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক লাঙল দিয়ে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে সুমেরীয়'রা সর্বপ্রথম চাকার আবিষ্কার করে সুমেরীয়'রা

সুমেরীয় সভ্যতার বিশেষ অবদান হল তাদের আইন ব্যবস্থা  'চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত' এই বিধান গুলো চালু করেন সুমেরীয় রাজা হাম্বুরাবি সুমেরীয়দের লিখন পদ্ধতির নাম ছিল কিউনিফরম

মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার উল্লেখযোগ্য একটি সভ্যতার নাম ব্যাবিলনীয় সভ্যতা ব্যাবিলনে জ্যোতিষ শাস্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে   সর্বপ্রথম সাত দিনে এক সমাপ্ত গণনা শুরু হয় ব্যাবিলনে বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করেন ব্যাবিলনীয়'রা

ব্যাবিলনের ৩০০ মাইল উত্তরে টাইগ্রিস নদীর উপকূলে অবস্থিত ভূখণ্ডের নাম এসিরিয়া এসিরীয়'রা সম্রাজ্য সিরিয়া, ব্যাবিলন, প্যালেস্টাইন, ফিনিসিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন একসময় তারা মিশরও দখল করেছিলেন  এসিরীয় সমাজ  পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল এসিরীয়দের ভাষা ছিল দুইটিআরমেনিয় আর এসিরীয়

এসিরীয়দের পতনের পর ক্যালদীয়'রা মেসোপোটেমিয়ায় নতুন এক সম্রাজ্য স্থাপন করেনক্যালদীয় সম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন নেবুচাদনেজার তার সময়ে ব্যাবিলনকে পৃথিবীর সুন্দরতম নগরীতে পরিনত করেন রাজা নেবুচাদনেজারের অক্ষয় কীর্তি ছিল ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান  ক্যালদীয়'রা দিন কে ১২ জোড়া ঘন্টায় ভাগ করেন

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার অবদান ছিল অপরিসীম খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ থেকে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়া পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল কিন্তু পরে এই ভূখন্ডের আধিপত্য নিয়ে রোমানদের সাথে যুদ্ধ হয় এবং রোমানরা এই অঞ্চল ২৫০ বছরের বেশি শাসন করতে পারে নি দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে পার্সিয়ানরা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চল তাদের শাসনেই থাকে, এরপর মুসলিম শাসনামল শুরু হয় মুসলিম খিলাফত শাসনে এই অঞ্চল পরবর্তীতে ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে

৭ম শতাব্দীতে ইসলামী খেলাফতের ফতেহের মাধ্যমে খলিফা রাশিদূন সাসানিড সাম্রাজ্যটি ধ্বংস করেন ৯ম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খেলাফতের সময়ে বগদাদ শহর "ইসলামী সোনালী জমানার" কেন্দ্রে পরিনত হয়ে ওঠে ১০ম শতাব্দীতে বাওয়াহীদ সেলজুক আক্রমণ ফতেহের ফলে বাগদাদের আয়তন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলেরা বগদাদ আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে এর সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায় তুর্কি-মঙ্গোল ইরাক মিলে একটি সুবাহ গঠিত করে

ইরাক; সরকারিভাবে ইরাক প্রজাতন্ত্র, একটি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র বাগদাদ ইরাকের রাজধানী ইরাকের দক্ষিণে কুয়েত এবং সৌদি আরব, পশ্চিমে জর্ডান, উত্তর-পশ্চিমে সিরিয়া, উত্তরে তুরস্ক এবং পূর্বে ইরান (কোর্দেস্তন প্রদেশ (ইরান)) অবস্থিত

উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২১ সালের ২৩ আগস্ট ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে গঠিত হয়েছিল ইরাক প্রজাতন্ত্র লীগ অব নেশনসের মেন্ডেটের পর ১৯২০ সালে এটি ব্রিটেনের হস্তগত হলেও সেবছরের বিদ্রোহের কারণে মূল মেন্ডেট পরিকল্পনা বদলে ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের মিত্র হাশিমিদের অধীনে একটি অর্ধস্বাধীন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি (১৯৩০) স্বাক্ষর হয় ১৯৩২ সালে ইরাক রাজতন্ত্র পূর্ণ স্বাধীনতা পায়

১৯৩৩ সালে বাদশাহ ফয়সাল বিন হুসাইন মারা যাওয়ার পর তার ছেলে গাজি তার আসনে বসেন ১৯৩৯ সালে একটি মোটর দুর্ঘটনায় গাজি মারা যান হাশিমি শাসকদের অধীন স্বাধীন ইরাক রাজতন্ত্র তার পুরো সময়জুড়ে বেশ অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে গেছে সুন্নি শাসিত ইরাকে এসিরিয়ান, ইয়াজিদি শিয়ারা অসন্তুষ্ট ছিল ১৯৩৬ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়জুড়ে কয়েকটি অভ্যুত্থান ঘটে এবং ১৯৪১ তা চরমে পৌছায়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রশিদ আলি আল-কাইলানির নেতৃত্বে গোল্ডেন স্কয়ার অফিসাররা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজার অভিভাবক আবদুল্লাহর শাসন উৎখাত করে নাৎসিপন্থি ইরাক সরকার ১৯৪১ সালের মে মাসে ইঙ্গ-ইরাকি যুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয় ইরাক এরপর মিত্রশক্তির ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে একই সময় কুর্দি নেতা মোস্তফা বারজানি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন এটি ব্যর্থ হলে বারজানি তার অণুসারিরা সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যান

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইরাক জাতিসংঘে যোগ দেয় এবং আরব লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয় ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের সাথে সরকারের চুক্তির বিরুদ্ধে বাগদাদজুড়ে আল ওয়াসবাহ আন্দোলন নামক প্রতিবাদ শুরু হয় কমিউনিস্টরা এতে সমর্থন দেয় এতে সমর্থক বাড়তে থাকে কিন্তু আরব লীগের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ইরাকও ১৯৪৮ আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধে যোগ দেয়ার পর সামরিক আইন জারি হলে তা বাধাগ্রস্ত হয়

১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জর্ডানের বাদশাহ হুসাইন বিন তালাল আবদুল্লাহ বিন আলি মিশর সিরিয়ার নতুন গঠিত ইউনিয়নের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে দুই হাশিমি রাজতন্ত্রের মধ্যে ইউনিয়ন গড়ার প্রস্তাব করেন এর ফলে সে বছরের ফেব্রুয়ারি আরব ফেডারেশন গঠন করা হয় একই বছর আবদুল করিম কাসেমের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্র উৎখাত হলে আরব ফেডারেশনের সমাপ্তি ঘটে

সাদ্দাম হোসেন ১৬ জুলাই ১৯৭৯ থেকে এপ্রিল ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রথমে সাদ্দাম হোসেন জেনারেল আহমেদ হাসান আল বকরের উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন সেই সময় সাদ্দাম দৃঢ় ভাবে সরকার সামরিক বাহিনীর মধ্যকার বিরোধের অবসান ঘটান এই উদ্দেশ্যে তিনি নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করেন ইরাকের রাষ্ট্রপতি বাথ পার্টির প্রধান হিসেবে সাদ্দাম হোসেন আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক ইরাক গড়ে তুলতে প্রয়াস নেন সাদ্দাম এক দলীয় শাসন কায়েম করেন এসময়ই সাদ্দাম ইরানের সাথে বছরের যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন (১৯৮০-১৯৮৮)

নব্বইয়ের দশক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতার মাধ্যমেই মূলত দেশটির রাজনৈতিক স্থবিরতা শুরু হয় ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাক কুয়েতে আগ্রাসন চালায় এবং কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ ঘোষণা করে ইরাকের দখলদারি থেকে কুয়েতকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মার্কিন নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে ২রা আগস্ট ১৯৯০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত 'অপারেশন ডেজার্ট স্ট্রম' নামক অপারেশন পরিচালনা করে এটি প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ নামেও পরিচিত

এর প্রায় এক দশক পর ইরাকে মারাত্নক বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে কারণ দর্শিয়ে ইরাকে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে অভিযান পরিচালনা করে মার্কিন ইংরেজ যৌথ বাহিনী ইতিহাসে ঘটনা দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত এছাড়া মার্কিন বাহিনী ইরাকের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর 'অপারেশন রেড ডন' নামক আরেকটি অপারেশনও পরিচালনা করে এভাবে গত কয়েক দশকে বিভিন্ন অস্থিরতা যুদ্ধের কারণে ইরাকের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্দশা নেমে আসে

সাম্প্রতিকতম সময়ে আইএসআইএল (ইসলামিক স্টেটস ইন ইরাক অ্যান্ড লেভান্তে) নামক সন্ত্রাসী সংগঠন ইরাকের ভূমিতে গঠিত হয় এবং মসুলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে এছাড়া দেশটির উত্তর সীমান্তবর্তী কুর্দিস্তান প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদ সমস্যাও ইরাকের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ

একটি গণভোটের পর ২০০৫ সালের ১৫ই অক্টোবর দেশটির নতুন সংবিধান পাস হয় ইরাকের জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ২৭৫ ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে এর জন্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়

সিআইএ বিশ্ব ফ্যাক্টবুকের ২০১৫ সালের একটি রিপোর্ট অনুসারে ইরাকের ৬৪৬৯% শিয়া মুসলিম এবং ২৯৩৪% সুন্নি মুসলিম পিউ রিসার্চের ২০১১ সালের একটি জরিপমতে ইরাকি মুসলিমদের ৫১% শিয়া এবং ৪২% সুন্নি হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করেইরাকের সুন্নি সম্প্রদায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের সম্মুখীন হন বলে অভিযোগ রয়েছে

২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর হয় মুস্তফা আল কাদিমি ইরাকের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বারহাম সালিহ দেশের রাষ্ট্রপতি

কীর্তিগাথা মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময় পৃথিবীর সকল সু-প্রাচীন সভ্যতার তালিকা তৈরি করলে, সভ্যতা শীর্ষে স্থান দখল করে নেবে যেন সভ্যতার মোড়কে ঘনীভূত এক ইতিহাস, জীব-জীবনের জানা-অজানা কথা, মানব ইতিহাসের উত্থান-পতনের এক মহাকাব্য বিভিন্ন কারণেই সভ্যতাটির কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে ইতিহাসের পাতায় আজো তা নিয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনের জানার আগ্রহতে একটুও ভাঁটা পড়েনি

লেখক: ব্যাংকার।


Comment As:

Comment (0)