মিহির

বোরো ধান নিয়ে বিপাকে কৃষক

ড: মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে হাওরাঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এটি একটি বিচ্ছিন্ন দুর্গম অঞ্চল যা দেশের ৭টি প্রশাসনিক জেলায় ও ৫৭টি উপজেলার মধ্যে বিস্তৃত যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ভাটি অঞ্চল যা জেলার প্রায় সাড়ে আট লক্ষ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত এবং প্রায় ২০ লাখ কৃষক ও সাধারণ মানুষ হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা। অন্যান্য অঞ্চল থেকে এদের জীবনযাত্রা ভিন্ন প্রকৃতির। এখানকার কৃষি ব্যবস্থা, জীবন ও জীবিকা, এখানকার সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ভিন্ন। বছরের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি সময় এখানে পানি থাকে। যোগাযোগের মাধ্যম হলো নৌকা। এক ফসলি বোরো ধান হাওর অঞ্চলের কৃষকদের প্রাণ। এখানে মূলত বোরো ধানেরই উৎ্পাদন হয় ভালো। বর্ষার পলিমাটি হাওরের নিম্নাঞ্চলে জমাট হয়ে কৃষির উৎ্পাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এই পুরো অঞ্চলে ধানের উৎপাদন হয় প্রায় ৫৫ লক্ষ মেট্রিক টন যা দেশের মোট বোরো উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। হাওরাঞ্চলে সাধারণত একটা ফসল হয় বাংলাদেশে মোট চাল উৎপাদনের জমির পরিমাণ প্রায় সোয়া কোটি হেক্টর, যার মধ্যে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর বা ১৫ শতাংশ হাওরাঞ্চলে। এক অর্থে দেশের মোট চাল উৎপাদনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসে ওখান থেকে। হাওরের চাল নষ্ট হওয়া মানে ১৭-১৮ লাখ টন চাল আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকা বৈদেশিক মুদ্রায় যার মূল্য বিশেষত বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, হাওড়ের ৭টি জেলায় মোট বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমি যার বিপরীতে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। তবে পরিপূর্ণভাবে হাওড় এলাকায় আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৯৬ হেক্টর জমিতে।

যারা জমি চাষ করে তারা প্রান্তিক চাষি- বড় চাষিদের অনেকেই অনুপস্থিত ভূস্বামী, তারা থাকে শহরে। তাদের জমি চাষ করে গরিব কৃষকেরা ও কামলারা। এখানে চাষাবাদে ও ফসল ফলানোর নিবিড়তা কম। অনেক জমি পড়ে থাকে পতিত। ফসল ফলানোর অনিশ্চয়তার কারণে এখানে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি তেমন গড়ে উঠেনি। বাণিজ্যিক চাষাবাদের কথাও খুব বেশি চিন্তা করে না স্থানীয় কৃষকরা। জীবনধারণ পর্যায়ে এখানে চাষাবাদ করা হয়। হাওর শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে গেলে বিলের তলানিতে গিয়ে জমা হয় মাছ। মোট প্রায় ১৩০ প্রজাতির মাছ বিচরণ করে এখানে। মাছ ধরা, প্রাকৃতিকভাবে মাছ পরিবর্ধন করানো এবং মাছ বিক্রি করা এখানকার মানুষের জীবিকার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এক সময় সেখানে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ থাকত। কালক্রমে হাওরের গভীরতা কমে গিয়ে সেখানে হোগলা ও নলখাগড়ার ঝোঁপ গজিয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে প্রচুর জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ যেমন হিজল ও কবোচ জন্মায়। বন্যার পানি চলে গেলে বিভিন্ন হাওরের তলানিতে প্রচুর ছোট মাছ, শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যায়। কৃষকগণ তার ক্রয়দাংশ ভোগ করে, বাকি অংশ বিক্রি করে বাজারে। এটা তাদের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎ্স। হাওরের চাষিরা হাঁস প্রতিপালনে খুবই আগ্রহী। কোনো প্রকার ক্রয়কৃত তৈরি খাদ্য ছাড়াই তারা প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত খাদ্য দিয়ে হাঁস প্রতিপালন করে থাকে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শত শত হাঁস ও ডিম উৎপাদিত হয়। হাঁসগুলো সারাদিন হাওরে চড়ে খাদ্য গ্রহণ করে আর সন্ধ্যায় দল বেঁধে বাড়ি ফেরে। হাওরে উৎ্পন্ন কাঁচা ঘাষ গবাদি পশু ও ছাগলের খাদ্য। কারণ এই হাওরাঞ্চলে বছরের সাত থেকে আট মাস পানির নিচে থাকে এবং বছরের বাকি চার মাস মোটামুটি আয় রোজগারে সারা বছর চলতে হয় এই এলাকার বসতিদের। বাংলাদেশে ৪৭টি বড় হাওর এবং বিভিন্ন মাপের ৬,৩০০টি বিল রয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের শনির হাওর, হাকালুকি হাওর, কাওয়া দীঘি হাওর ও টাঙ্গুয়ার হাওর খুবই ব্যাপকভাবে পরিচিত। এদের মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর দেশে-বিদেশে অনেকের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। একান্নটি বিলের সমন্বয়ে এই হাওর গঠিত। এটি ২০০০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জীব বৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এটি সুনামগঞ্জে অবস্থিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিচু এলাকায় এর অবস্থান। আদিকালের এক ভূ-তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে এলাকাটি ক্রমশ দুই থেকে তিন মিটার নিচে দেবে যায়। কালক্রমে এটি ব্রাহ্মপুত্র নদ এবং অন্যান্য নদী দ্বারা আগত পলির মাধ্যমে অনেকটা ভরাট হয়ে এসেছে। 

হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হতে শোনা যায় এই অঞ্চলে। তাতে কৃষকের পাকা ধান ভেসে যায়। অর্থনীতি খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ায়। এ বছর সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ একর জমির ধান ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। অনেক বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। কৃষক ও এলাকাবাসী দিনরাত বাঁধের পাশে থেকে নিজেরাই বিনা শ্রমে বাঁধে মাটি কাটছেন। ভুক্তভোগী কৃষক তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, যারা প্রকৃত জমির মালিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাঁধ নির্মাণ কমিটিতে রাখা হয় না। সঠিকভাবে বাঁধের কাজ হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ধান। অর্থনীতির মানদন্ডে হাওর অঞ্চল থেকে যে ধান উৎপাদন হয়ে চাল আকারে দেশের কেন্দ্রীয় স্টকে জমা হতো যার আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা যা দেশের জিডিপিতে অবশ্যই একটা প্রভাব ফেলবে নিশ্চয়। কারণ দেশের সার্বিক উন্নয়নে হাওর অঞ্চল থেকে শতকরা ১৮ ভাগ চাউল খাদ্য নিরাপত্তায় সংযোজন হয় এবং শতকরা ২২ ভাগ গবাদিপশু এই অঞ্চলে লালিত পালিত হয়, মৎস্য ভান্ডারে ভরপুর এই অঞ্চল দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান দুটি মাসেই কৃষকরা একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে পাহারী ঢলের বন্যার পানি কখন আসবে যেমন এ বছর এরি মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড় শতাধিক হাওরের মধ্যে ১৫টিতেই সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে পানি। ভাঙছে বাঁধ, ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে আনুমানিক ৭ হাজার হেক্টর বোরো ফসল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১২টি বাঁধ ভেঙে ৪৩৫০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ না করা, অর্থ ছাড় না করা, প্রকৃত কৃষকদের পিআইসির অন্তর্ভুক্ত না করার ফলেই দুর্বল বাঁধের কাজ হওয়ায় প্রথম ধাক্কায় বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে কৃষকদের স্বপ্ন সাধ চুরমার হয়ে গেছে, এমন অভিযোগ সুনামগঞ্জবাসীর। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২টি হাওরে ৭২৭ টিপিআইসি ১৩৫টি ক্লোজারসহ মোট ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের ও সংস্কারের জন্য সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১২১ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে। বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল এসে ফসল রক্ষা বাঁধের সর্বনাশ করে সুনামগঞ্জ বাসীকে চরম উদ্বিগ্ন করে। ইতোমধ্যে সেখানকার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় বিভিন্ন ছোট-বড় হাওরে ধান তলিয়ে গেছে। আর যেগুলো এখনো তলিয়ে যায়নি সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। 

কিছুদিন আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জ এসেছিলেন ভাটির মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে। তিনি বলেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য যে প্রজ্ঞা, মেধা ও সংগ্রামকে লালন করেছেন তা হাওরেরই দান। তাই আজ রাষ্ট্রপতির চেয়ে আমার বড় পরিচয় আমি হাওরী মানুষ। এজন্য তিনি ভালো করেই জানেন এখানকার প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র নির্ধারক হাওরের বোরো ধান। সত্যি কথা বলতে কি, এখানকার মানুষের স্বপ্নের প্রতিটি উপাদানই হাওর কেন্দ্রিক। কিন্তু প্রায় প্রতি বছর এই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় গুটিকয়েক কারণে। সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার, ৪২টি হাওরের প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এই ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর এই কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবারো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এই বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি টাকা। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন ভাটির বুকে একটি কথা প্রচলিত আছে, বাঁধের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয়, সেই টাকা ধাতব মুদ্রায় রূপান্তরিত করে বাঁধ দিলে তা ডুববে না। তারপরেও অধিকাংশ বছরই বাঁধ তলিয়ে যায়। কোনো কোনো বছর ভাগ্য বিধাতা সহায় হলে রক্ষা পায়। হাওর পারের অনেক বাঁধই স্থায়ী ভাবে নির্মাণ করা সম্ভব। বাঁধের ওপর স্থায়ী বসতি স্থাপন ও পর্যটন স্পট গড়ে তোলা সম্ভব। 

এখন বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে, যেমন, বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠাপানি বা হাওর অঞ্চলে। কিন্তু কীটনাশক, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বৃদ্ধি, পানির স্বাভাবিক প্রবাহে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে বাধার ফলে মাছসহ অসংখ্য জলজ, প্রাণীজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, বৃষ্টির পানি কমে যাওয়ার ফলে শুকনো মৌসুমে হাওরের পানির পরিমাণ কমে গেছে, মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত, অতিবৃষ্টিতে হাওর পানিতে ভরে গেলেও পানি স্থায়ী না হওয়া, হাওরাঞ্চলের উদ্ভিদের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নিবিড়, স্বাভাবিক বৃষ্টি ব্যাহত হলে হিজল, করচ, বরুণসহ অন্যান্য উদ্ভিদ বিলীন হয়ে যাবে, বিচিত্র প্রজাতির পাখি তাদের খাদ্য ও আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাওর অঞ্চলে এক সময় গভীর জঙ্গল ছিল, সেখানে এখন ধু-ধু করছে উদাস হাওর।

এখন হাওর অর্থনীতি রক্ষায় কি করনীয় তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে যেমন
 ১.  মেঘালয় ও আসামে যে বৃষ্টি হয় তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হয়ে বাংলাদেশের  হাওরেই এসে জমা হয়। অতএব এ দুর্যোগ ঠেকানো সহজ ব্যাপার নয়। আবার এটাও তো ঠিক যে, সীমান্তের ওপারে বছরে কোন সময়ে কতটুকু বৃষ্টি হয় তার রেকর্ড আমাদের অজানা নয়। আবার সেখানে আগামী কয়েক দিন কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তার আগাম তথ্য জানাও দুই দেশের মধ্যে বন্যা বা আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি থাকার কারণে খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এসব তথ্য জানা থাকলে পাহাড়ি ঢল ঠেকানো না হোক তার কারণে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয় অন্তত সে ব্যবস্থা নেয়া যায় নিশ্চয়ই;
 ২. প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া যেমন সময়ের আবর্তে পলি সংযোজিত হয়ে হাওরের জলাশয়গুলোর ভরাট হওয়ায় অল্প বর্ষায় প্লাবিত হওযার ঝুঁকি নিরসন এবং ডেজিং এর মাধ্যমে এই জলধারাগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি, বাঁধ নির্মানের টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার যার সাথে এই অঞ্চলের ভৌগলিক পরিবেশের সামঞ্জস্য থাকবে, পানি ব্যবস্থাপনায় এলাকার বাসিন্দাদেরকে সম্পৃক্ত করে কর্ম পরিকল্পনা তৈরি যা হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া;
৩. হাওর এলাকায় প্রাণপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত নদী ও খালগুলো খনন করা, হাওরে পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করে যত্রতত্র রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ, বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষের সম্মিলিত পরামর্শে নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন ও প্রয়োজনমাফিক উঁচু করতে হবে, মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ (অনেক বিলুপ্ত প্রায় মাছ ও জলজ সম্পদ) রক্ষার্থে হাওরের বিলগুলোর সরকারি ইজারা পদ্ধতি সংস্কার করতে হবে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি, দায়িত্বে গাফিলতি ও উদাসীনতা বন্ধ করে নজরদারি বাড়াতে হবে, হাওর এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি ও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে হবে;
৪. একমাত্র নির্ভরশীল ফসল ধান চাষের বাইরে বিকল্প কৃষিশিল্প অর্থনীতি ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, হাওর ও বিল সংলগ্ন এলাকায় খাসজমি বরাদ্দ বন্ধ করে সরকারিভাবে স্থানীয় জলজ উদ্ভিদ ও বৃক্ষের সমারোহে সবুজায়নের উদ্যোগ নেওয়া দরকার কেননা ফসলের বাইরেও হাওরাঞ্চলে প্রাণ ও প্রকৃতির একটা বিশাল জগৎ আজ বিপন্নপ্রায়, হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে আরও সক্রিয় ও গতিশীল করতে হবে, হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রয়োজনে হাওর উন্নয়নে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে যেখানে হাওরের মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের যোগ্য নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে; 
 ৫. এই কৃষি যান্ত্রীকিকরনের যুগে ৭টি জেলা বেষ্টিত হাওর এলাকার ১ ফসলা জমিতে কেন এতদিন কৃষকদের যান্ত্রীকীকরনের ছোয়া (চাষাবাদ, মাড়াই, বাজারজাতকরন) লাগেনি তা খোদ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের ব্যক্তব্যেও আসেনি অথচ এই হাওর অঞ্চল জাতীকে শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই (চাউল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ) দেয়নি, তাদের সাথে দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির অপরুপ এক সুন্দর লীলাভুমি যা মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের এক অপূর্ব ক্ষেত্র  সে দিকে নজর দিতে হবে;
 ৬. শুধু হাওরই নয়, সারাদেশে কৃষিকাজে শ্রমিক সংকট একটি সাধারন চিত্র হয়ে দাড়িয়েছে যা সনাতনী ধারার কৃষির জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জত বটেই। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও বিভিন্ন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গ্রাম থেকে শহরেও মানুষের চলাফেরা গতি অনেক বেড়েছে তার সাথে রয়েছে কর্মের বহুমুখিতা। ফলে শ্রমিকরা কৃষিতে আর আগের মত তাদের নিয়োজনের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখছেনা বিশেষত: উন্নত জীবনের আশায়। এখন এই সমস্যার সমাধানের বিকল্প হতে পারে কৃষিযন্ত্রীকরন যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন, সংগঠন, প্রশিক্ষন ও অর্থায়ন জরুরি, বিশেষত: হাওর অঞ্চলের জন্য যা নিয়ে সেই সকল অঞ্চলের উন্নয়ন সংগঠন প্রশাসনসহ কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন দফতর, সুশীল সমাজ, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার;
 ৭. দেশের বিশেষত: উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে যে সকল মৌসুমি কৃষি শ্রমিক হাওর অঞ্চলে আসে তাদের সম্বর্ধনা, আবাসন, খাওয়া দাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য একটি শক্তিশালী আয়োজন  থাকা প্রযোজন। উদাহরনস্বরুপ বলা যায় হাওরে ধান মাড়াইয়ের জন্য খলা তৈরি করা হয় এবং জমি থেকে ধান কেটে খলায় নিয়ে আসা হয় যা অনেক ক্ষেত্রে টিনের সেড কিংবা ত্রিপল দ্বারা বেষ্টিত বিশেষত: অকাল বৃষ্টির হাত থেকে ধান রক্ষা করার জন্য। এখানে কৃষি শ্রমিকরা ধান মাড়াই, শুকানো ও বাজারজাত করনের প্রক্রিয়াটি শুরু করতে থাকে। এই ধরনের খলা তৈরিতে একক কৃষকের পক্ষে সম্ভব হবে না প্রয়োজন কৃষক সংগঠন যার অনুপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে এলাকার সম্পদশালী অনুপস্থিতি জমির মালিক যারা জমি বর্গা দিয়ে শহরে বসবাস করছেন তাদের সাথে সেখানে মৌসুমি শ্রমিকদেরও আবাসনের থাকা খাওয়া চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে এবং কাজ থেকে ভাগের ধান নিয়ে নিরাপদে বাড়ী ফিরতে পারে এর জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা প্রয়োজন রয়েছে;

সর্বশেষে বলা যায় হাওরের ধান পাকবে, বন্যার শঙ্কা থাকবে, কৃষি শ্রমিকের সংকট থাকবে ও চরম দুশ্চিন্তায় কৃষক থাকবে। এই সব সকল সংকটের গ্রহনযোগ্য সমাধান প্রয়োজন দেশের কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে।

লেখক: উন্নয়ন গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি।


Comment As:

Comment (0)