ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন নানিয়ারচর

ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন নানিয়ারচর

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম:  ঈদ মানেই ছুটি। পরিবারের সঙ্গে সঙ্গ দেয়ার পরে অনেকেই বের হয়ে যান নয়নাভিরাম প্রকৃতির সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে। কেউবা আবার নগর জীবনের একঘেঁয়েমি দূর করতে পুরো পরিবার নিয়েই চলে যান  দূরে কোথাও। তাদের জন্যই আমার আজকের ভ্রমণ গল্প। ঘুরতে ঘুরতে যেনো নৈসর্গিক পরিবেশের সান্নিধ্য পাবার পাশাপাশি,  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধা বীর সন্তানদের সম্পর্কেও জ্ঞানার্জন লাভ করা যেতে পারে।                                                            

`এই সুন্দর ভূবনে জম্মিয়া যদি

জাগতিক নানান দায়িত্বের বেড়াজালে

আজো দেখা না হয়ে থাকে তোমার

সৃষ্টিকর্তার ইশারায় তৈরী

প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য

তাহলে তুমি কিসের দায়িত্ববান?

নিজেকেইতো নিজে ঠকিয়ে যাচ্ছো

নিজেকে যে ভালোবাসতে না জানে

অপরের প্রতি তার ভালোবাসা মেকি

উপরোক্ত কবিতার পংক্তিগুলো সত্যিই সমাজ সংসারের অনেক দায়িত্বশীলদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যাপিতজীবনে অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের জন্যও সময় বের করে ছুটে যেতে হবে নির্মল প্রকৃতির সান্নিধ্যে। অনেককেই বলতে শুনা যায়,সংসার আমাকে টাকার মেশিন বানিয়ে ফেলছে। এতো বেশি দায়িত্বের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে যে,উড়ে বেড়ানো ভ্রমণ পিপাসু মনটাকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে। একজন ভ্রমণ পিপাসুর জন্য ব্যপারটা ভয়ানক। আমি শতভাগ নিশ্চিত এরকম দায়িত্ববান অধিকাংশ মানুষগুলো অচিরেই চরম দায়িত্বহীন হয়ে উঠে। সর্বপ্রথম সাধ্যের মধ্যে থাকা নিজের সুন্দর শখের বিষয় গুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। যার মাঝে অন্যতম হল ভ্রমণ। কারণ প্রকৃত ভ্রমণ মানুষকে উদার,নিতীবান,সহানুভূতিশীল ও সমাজ-সংসারের প্রতি দায়িত্ববান হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে থাকে। সুযোগ পেয়ে অনেক কথাই লিখলাম। যাই এবার আপনাদেরকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি নানিয়ারচর থেকে।

    

হুটহাট সিদ্ধান্ত প্রিয় বিদ্যাপিঠ শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের বন্ধুরা মিলে যাবো রাঙ্গামাটি। রাতের বাসে চড়ে সকালে গিয়ে নামলাম। এবারের ভ্রমণ ছিলো অনেকটা উদ্দেশ্যবিহীন। মানে রাঙ্গামাটি যাবার পর কী দেখব। কোথায় কোথায় যাবো। আমি যেহেতু দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর একজন। তাই বন্ধুদের মানসিক চাপ তেমন ছিলো না। কিন্তু আমারতো ছিলো। কারণ অনেকেরই রয়েছে আমার প্রতি বিশেষ ভরসা। কি আর করা। তাই মনে মনে নানিয়ারচরের প্ল্যানটা করেই রাখতে হয়েছিলো। বাস স্ট্যান্ড হতে নাশতা সেরেই ট্রলারে চেপে বসলাম। গন্তব্য প্রথমে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধিস্থল। কাপ্তাই লেকের নীলাভ পানিতে ট্রলার চলছে ভেসে ভেসে। দূর পাহাড়ের সৌন্দর্য বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে রই। ছোট্ট ডিঙ্গীতে চড়ে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে জেলে মাছ ধরে যায়। প্রায় ঘন্টা দুই পরে দেখা মিলে জাতীর সূর্যসন্তান পাক হানাদারদের মর্টার শেলের আঘাতে নিহত বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধিস্থলের স্মৃতির মিনার। স্বাধীনতার সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুর রউফ এর বীরত্ব সম্পর্কে কিছুটা জানা আমার। তাই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। মনের ভিতর আনমনেই রক্ত টগবগিয়ে উঠে। ট্রলার ভিড়ে কবরস্থানের ঘাটে। একে একে সবাই নেমে জিয়ারত করি। চেঙ্গী নদীর খাল বেষ্টিত কাপ্তাই হৃদের বুকে বুড়িঘাট ইউনিয়নে অবস্থিত ছোট্ট একটি টিলার মত ভূমিতে, ফরিদপুরের দামাল ছেলে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলে কর্মরত থাকা ল্যান্স নায়েক শহীদ আবদুর রউফ চিরনিদ্রায় শায়িত। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই বীর সেনানির সমাধি আজ ইতিহাসের উজ¦ল সাক্ষি। পাক হানাদারদের আক্রমণ হতে সঙ্গীয় ১৫০জনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার সুযোগ করে দেয়ার জন্য, একাই ৭টি স্পিডবোট ও ২টি জাহাজে করে আসা পাকিস্তানি কামান্ডো বাহিনীর সাথে লড়তে লড়তে শত্রুদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেন। ততোক্ষণে শত্রুরা মুন্সি আব্দুর রউফের অবস্থান নেয়া ব্যাঙ্কার চিহ্নিত করে,তার মেশিনগানের সক্ষমতা হতে দূরে সরে গিয়ে মর্টারসেল হতে গোলা ছুড়তে থাকে। হঠাৎ একটি গোলা এসে ব্যাঙ্কারে বিস্ফোরিত হলে অদম্য সাহসি, দেশ রক্ষার অকুতোভয় সৈনিক মুন্সি আব্দুর রউফ শহীদ হন। তারিখটা ছিলো ২০ এপ্রিল ১৯৭১। সেই সম্মুখ যুদ্ধে হানাদারদের ৭টি স্পিডবোট ডুবিয়ে দেয়া সহ জাহাজ ও সৈন্যদলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো। এরপর শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফকে এই বুড়িঘাটের জমিতে দাফন করা হয়। তখন জায়গাটা যেমন ছিলো দুর্গম তেমনি ঝোপঝাড় জঙ্গলে ঘেরা। যে কারণে স্বাধীনতার অনেক বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল কবরটির সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ২০০৬ সালের ২৫ মার্চ তার সমাধিস্থলে রাইফেলের ভাস্কর্য সাদৃশ্য স্মৃতির মিনার স্থাপন করা হয়। যা অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। কাপ্তাই পানিপথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফের সেদিনের একার বীরত্বের জন্য,তার নির্দেশে সঙ্গীয় ১৫০ জন্য মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদে সরে যেতে পেরেছিলো। হালকা মেশিনগান দিয়ে একাই কুখ্যাত হানাদারদের বিশাল কমান্ডো বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী, বাংলাদেশ সরকার শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফকে মরোনত্তর পদবী ল্যান্স নায়েক ও বীরশ্রেষ্ঠ সম্মাননাতে ভূষিত করেন। মুক্তিযোদ্ধের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠর মাঝে ল্যান্স নায়েক শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফ একজন। সমাধির পাশে থাকা দেয়াল লিখনীতে তার বীরত্বের ইতিহাস রয়েছে। পড়ালেখায় উদাসিন থাকা শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফ ছোটবেলা হতেই দুর্দান্ত মেধাবী ও সাহসি ছিলো। চাচার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও পাকিস্তান রাইফেলসে যোগদান করেছিলেন। অত:পর স্বাধীনতার যুদ্ধে দেশবাসী দেখলো-জানলো তার মেধার ধার ও সাহসিকতা। সমর যুদ্ধে কখনো কখনো মেধার দক্ষতায় উপস্থিত বুদ্ধিতে নিজ বাহিনীর সুরক্ষায় পিছু হটেও শত্রুকে ঘায়েল করতে হয়। বুড়িঘাটের যুদ্ধে সেই তিক্ষè মেধারই বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। স্যালুট হে মহান বীর। দিনদিন সমাধিস্থলটি ভ্রমণ পিপাসুদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতেছে। অনেকেই যান শ্রদ্ধা জানাতে। কেউবা নিছক ভ্রমণের উদ্দশ্যে। তা যাই হোক সমাধিস্থলের পবিত্রতার প্রতি সবারই খেয়াল রাখা জরুরী।

যাই এবার পাহাড়ি নদী চেঙ্গীর উপর নবনির্মীত ব্রিজটি দেখতে। ভটভট শব্দ তুলে ট্রলার স্টার্ট। ছুটছে ট্রলার নানিয়ারচর বাজারে দিকে। কাপ্তাই হ্রদে নৌভ্রমণকালীন পানির বুকে জেগে থাকা সবুজে মোড়ানো টিলা গুলোর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ভ্রমণের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বহুগুন। যেতে যেতে আধাঘন্টার মধ্যেই ট্রলার ঘাটে ভিড়ে। ততোক্ষণে জুম্মার আযান হয়ে গেছে। ভাতের হোটেলে খাবার ওর্ডার করে মসজিদে ঢুকে যাই। নামাজ শেষে কাপ্তাই লেকের সুস্বাদু রুই মাছ আর দেশি মোরগের গোস্ত দিয়ে পরিমাণের চাইতে অতিরিক্ত ভাত খেয়ে ছুটে যাই ব্রিজে। ওয়াও! এযেনো ব্রিজ নয় বরং বলা যেতে পারে প্রকৃতির দান একটুকরো স্বর্গ। ব্রিজটির একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়াই। চেঙ্গী নদীর উপর ব্রিজটি নির্মান করা হয়েছে। ব্রিজের আশপাশ প্রকৃতির মায়াবি চাদরে ঢাকা। নিজের চোখ দিয়ে না দেখা পর্যন্ত এর সৌন্দর্য বুঝা মুশকিল। ব্রিজ নির্মাণের সুফল এখন পুরো রাঙ্গামাটির বাসিন্দারা পাচ্ছে। সেই সঙ্গে নানিয়ারচর যেতে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য, সড়কপথেও বেশ সাচ্ছন্দ বয়ে এনেছে। সব কিছু মিলিয়ে নানিয়ারচর ভ্রমণে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার ঝুলি সম্বৃদ্ধ হবার পাশাপাশি,বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো মূহুর্ত গুলো স্মৃতির আঙ্গিনায় আজীবন গেঁথে রবে।

যাবেন কীভাবেঃ ঢাকা-রাঙ্গামাটি রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বাস সার্ভিস রয়েছে। রাঙ্গামাটি রিজার্ভবাজার নৌ ঘাট হতে রিজার্ভ ট্রলার/স্পিডবোটে দিনেদিনে ঘুরে আসা যাবে। এছাড়া যাত্রীবাহি জাহাজও চলাচল করে।

ছবির ছৈয়ালঃ লেখক ও সাঈদ

কৃতজ্ঞতাঃ সমাজসেবক মু.শাহ্জাহান ও এডভোকেট মু.মাছুম

বিনিয়োগবার্তা/জেডএইচ/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)