মিহির

শ্রীলঙ্কা কেন দেউলিয়া হলো

ড. মিহির কুমার রায়: শ্রীলঙ্কা দেশটিকে নিয়ে সারা বিশ্বে বিশেষত: দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচনার ঝর বইছে যা মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা অবহিত হচ্ছি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে এটি একটি জল্পনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে যা অনেক ক্ষেত্রে আতঙ্কের বিষয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি ও ব্ল্যাকআউটসহ খাদ্য ও জ্বালানির দুর্লভ ভয়াবহ দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, জরুরি ওষুধ,  খাদ্যসঙ্কট এসব বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিক্ষোভ করছে শ্রীলঙ্কার মানুষ। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কা ৫১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করায় গত ১২ এপ্রিল দেশটির সরকার নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়,  বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয় এবং শ্রীলঙ্কার আয়তন ৬৫,৬১০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২.১৫ কোটি যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩২৮ জন লোক বসবাস করে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী,  এখন মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে। দেশের ঋণ থেকে জিডিপি ২০১৯ সালের ৮৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ১০৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কাগজপত্র,  দুধের গুঁড়োসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ পেতে তীব্র অসুবিধা দেখা দিয়েছে। দেশটি প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হচ্ছে,  এমনকি নিউজপ্রিন্টের অভাবে কাগজের মুদ্রণ বন্ধ হয়ে গেছে। মার্চে দেশটিতে সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১৭ শতাংশের বেশি,  খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৩০.২ শতাংশ এতে বর্তমানে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো বলছে,  এটি এমন কিছু অকার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ,  যার ফলে বর্তমান সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কিছু পশ্চিমা মিডিয়া এ অসত্য দাবি প্রচার করছে, এটি চীনের  ‘ঋণের ফাঁদ’ যা শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকারের পরিসংখ্যান বলছে,  দেশটির ঋণ কাঠামো জটিল। বৈশ্বিক পুঁজিবাজার থেকে কলম্বো সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে, যা মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ,  তারপর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ১৩ শতাংশ, জাপান ১০ শতাংশ,  চীন ১০ শতাংশ,  বিশ্বব্যাংক ৯ শতাংশ ও ভারত ২ শতাংশ। এটি প্রমাণ করে,  তথাকথিত  ‘ঋণের ফাঁদ’ কোনো সত্যের সাথে জড়িত নয়। 

এর কারন কি এ নিয়ে অনেকে বলছে বিষয়টি অর্থনৈতিক যা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে আঘাত এনেছে যদিও আত্ম সামাজিক সূচকে  (শিক্ষার হার ৯২.৬৪%, গড় আয়ু  ৭৮ বছর, মাথাপিছু আয় ভারত  /বাংলাদেশের দ্বিগুন)  ভারত মহাসাগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত শ্রীলঙ্কা (একমাত্র ভারতের কেরালা রাজ্য ছাড়া)  দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে অগ্রগামী যা ‘পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশেন’ নামে পরিচিত। তারপরও কেন এই বিপর্যয় এবং এর কারন বিশ্লেষনে দেখা যায় এক: কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার নিম্নমুখী যাকে এডিবি বলছে ‘ধনী হওয়ার আগেই বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া- বয়স্ক জনসংখ্যার চাপে শ্রীলঙ্কা” যার সঙ্গে উৎপাদন, কর্মসংন্থান ও আয়ের একটি নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে, দুই: এখনও দেশের রফতানি বাণিজ্যের ৫২% দখল করে আছে পোশাক খাত, এর পরে আছে চা (১৭%), রাবার, মাছ ও নারিকেলজাত দ্রব্য ইত্যাদি। গৃহযুদ্ধের কারণে পোশাক খাত এবং শিল্পায়নের অন্য খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি। চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা নিরসনে ওষুধ শিল্পও সেখানে বিকাশ লাভ করেনি যেমন বাংলাদেশ বর্তমানে ১২১টি দেশে ওষুধ রফতানি করেছে যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওষুধ রফতানি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়;  তৃতীয়ত: বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা যেমন সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দর এবং অনেক অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পে ঋণ,  রাসায়নিক সারের ব্যবহারের চেয়ে জৈব সারের উপর নির্ভরতা যা কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে, ভ্যাট ও কর হ্রাস যার প্রভাব জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পরা ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন, দেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়, সার আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যায়, চালের দেশ শ্রীলঙ্কা খাদ্য ঘাটতি মেটাতে ৪৬০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করে, এতে চালের দাম হু হু করে বেড়ে যায়, অর্গানিক কৃষির নীতিমালা দেশের চা উৎপাদনেও পড়ে যা শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অজর্নের একটি মাধ্যম ছিল যা ব্যাহত হওয়ায় এ খাত সজীব রাখতে সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় যখন দেশজুড়ে খাদ্য ঘাটতিতে জনদুর্ভোগ প্রকট আকার ধারণ করে। চতুর্থত:  শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের ঐতিহাসিক ভুল দেশটির স্বাধীনের পর থেকে শুরু হয়েছে। তামিল জনগোষ্ঠীকে ব্রিটিশরা চা ও কফি উৎপাদনের জন্য ১৯ শতকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পরে বন্দরনায়েক সরকার তামিলদের শিক্ষা, প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে যার অন্যতম হচ্ছে - সিলোন সিটিজেনশিপ আইন-১৯৪৮ এবং সিনহল আইন ১৯৫৬ পাস করা। সঙ্গে আছে দাফতরিক ভাষা ইংরেজীর পরিবর্তে সিংহলী চালু এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ভাষাভিত্তিক কোটা পদ্ধতি প্রচলন। ১৯৬৪ সালে ভারতের সঙ্গে ইন্দো-সিলোন চুক্তি করায় প্রায় ৩.৫ লাখ তামিল ভারতে ফিরে যায় এবং অবশিষ্টরা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং পরে এলটিটিই নামে সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে যার অবসান ঘটে ২৬ বছর পর ২০০৯ সালে। এই গৃহযুদ্ধের কারণে কাঙ্কিত বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি, যথাযথ শিল্পায়ন হয়নি, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ বেকার থাকায় উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, দিন দিন বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে এবং দেশের একটি ছোট জনগোষ্ঠীকে পেছনে ঠেলতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা ডেমোগ্রাফিক বোনাসের সময় নষ্ট করেছে; পঞ্চমত: বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণে শ্রীলঙ্কার এ মুহূর্তে প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা। দেশটি তাই অনেকের দ্বারস্থ হচ্ছে - চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি। 
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতে ১৫ শতাংশ মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে এক ডলার সমান শ্রীলঙ্কার ২৩০ রুপি; তা বেড়ে ৩১৬ রুপিতে দাঁড়িয়েছে। আমদানি বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা। জরুরি খাবার, ওষুধ ও জ্বালানি কেনার জন্য ভারত এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ২৫ কোটি ডলারের  ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ এবং চলমান সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে সহায়তার অংশ হিসেবে ২০ কোটি টাকা মূল্যের জরুরী ওষুধ উপহার দেয় বাংলাদেশ; ষষ্ঠত: কলম্বোয় সিলন চেম্বার অব কমার্সের এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি সেখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, এ সংকট হঠাৎ জন্ম হয়নি বরং এ সংকটের উৎসের দিকে তাকাতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই পঞ্চাশের দশকে তখন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে দেশটির অর্থনীতি কখনোই নিরাপদ থাকার মতো স্থিতিশীলতা পায়নি। কেবল মাত্র সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তর কারনে। 

তিনি বলেন,  এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যা করার দরকার ছিল তা কখনোই হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে তা হলো নিয়মিত বার্ষিক বাজেট ঘাটতির কারণে রাজস্ব কমেছে নাটকীয়ভাবে। কমেছে রপ্তানি আর বেড়েছে ঘাটতি। তবে সমস্যাটা ব্যাপক বেড়েছে গত ১০-২০ বছরে। 
কুমারাস্বামী বলেন,  আগেও বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে বার বার; অষ্ঠমত:  অনেকে বলছে শ্রীলঙ্কার সংকটকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- প্রথমত: সরকারের ব্যয় তার আয়ের চেয়ে অধিক হওয়া; দ্বিতীয়ত:  বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক ঘাটতি এবং তৃতীয়ত:  ব্যাপক ঋণ, যা শ্রীলঙ্কার পক্ষে এখন পরিশোধ করা অসম্ভব। বিরোধী জোটের বড় কোনো দলই বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে দেশে কীভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা সামনে আনেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় তাদের পরিকল্পনার পক্ষে কোনো প্রমাণ দাখিল করেনি। একই সঙ্গে সংকট যে পর্যায়ে গেছে,  তা থেকে উত্তরণে যেসব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন,  সেগুলোতে যে সবাই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সেটিও হয়নি। সরকারের ব্যয় কমিয়ে একটি পর্যায়ে আনার জন্য অর্থাৎ সরকারের আয় অনুযায়ী ব্যয় ভারসাম্যপূর্ণ করতে গেলে সামরিক স্থাপনা ও সড়ক; এ দুই খাতে ব্যাপক ব্যয় সংকোচন করতে হবে। একই ভাবে রাজস্ব ব্যয় বাড়াতে গেলে আয়কর ও ভ্যাট বাড়াতে হবে, বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের কাজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখতে হবে, বস্তুত বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং ব্যাপক ঋণের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যা সরকারের নেওয়া বড় বড় প্রকল্পের কারণেই হয়েছে বিশেষ করে মহাসড়কের প্রকল্প,  হাম্বানটোটা বন্দর তৈরি প্রকল্প,  মাত্তালা বিমান বন্দর,  সুরাইয়াওয়া ক্রিকেট স্টেডিয়াম, নেলুম কুলুনা,  বন্দর সিটি ইত্যাদি প্রকল্পের অর্থনৈতিক কোনো দৃশ্যমান লাভ আমরা দেখিনি। 

এই প্রতিবেশী দেশের অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের কৌতুহলের সৃষ্ঠি হয়েছে যে বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে হাটছে?  বিষয়টির উত্তর অতি সহজেই দেয়া যায় যা অর্থনৈতিক মানদন্ডে বিচার্য্য যেমন বাংলাদেশকে প্রতি বছর ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ২ বিলিয়ন ডলার আর শ্রীলঙ্কাকে করতে হয় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হলো দেশটির জিডিপির ৬১ শতাংশ আর বাংলাদেশের তা ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া দেশটির মোট ঋণ (ঋণ জিডিপি অনুপাত) ১২০ শতাংশের কাছাকাছি,  বাংলাদেশের তা ৪৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ বৈদেশিক ঋণ কঠিন শর্তে নেওয়া আর বাংলাদেশ সহজ শর্তে এসব ঋণ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হলো পর্যটন খাত যা করোনা মহামারির  কারণে গত দুই বছর এই খাতে ব্যাপক ধস নামে যার আঘাত লাগে সরাসরি রাজস্ব আয়ে। তারও আগে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তামিল টাইগারদের  সাথে যে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘ সময়ে সংগঠিত হয়েছে তার ফলাফলও ভয়াবহ ছিল যেখানে পর্যটন খাত বিপদে ছিল। অপর দিকে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয় দেশটিকে। এদিকে বাংলাদেশের নেওয়া বেশিরভাগ মেগা প্রকল্পগুলো মূলত যোগাযোগ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য। এর মধ্যে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং অন্য প্রকল্প, যেমন - কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল,  ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে,  রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র,  মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র,  পায়রা সমুদ্র বন্দর ও গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে যেমন বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপির ৩৮ শতাংশ যা গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা যা বৈদেশিক ঋণের এই হার জিডিপির ১৩ শতাংশ। 

আইএমএফের মতে বৈদেশিক ঋণের হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই তা যে কোনো দেশের জন্য সংকট তৈরি করতে পারে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে বাংলদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। তারপরও সরকার রিজার্ভ নিয়ন্ত্রনে কঠোর অবস্থানে রয়েছে যেমন অপ্রয়োজনীয় আমদানী পণ্য বন্ধ, বিদেশ সফরে নিয়ন্ত্রণ জোরদার, কম গুরুত্বপূর্ণ  প্রকল্প বাস্তবায়ন নিরুৎসাহিত করন ইত্যদি। তাছাড়াও বেশ কিছু মূল চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন বানিজ্য ঘাটতি,  রফতানী বাড়লেও রেমিটেন্স নিম্নমুখী। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে বিশেষ করে আমদানি ও কর্মসংস্থানজনিত ঝুঁকি। এর মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। শ্রীলঙ্কার এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্য সব দেশ শিক্ষা নিতে পারে, এক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব কর্মসূচি সময়মতো, সাশ্রয়ী ও দুর্নীতিমুক্তভাবে যেন শেষ হয় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। দেশে বাস্তায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে হবে, আগামী বছরের বাজেট প্রণয়নে মূল্যস্ফিতী ও কর্মসংন্থানকে আমলে নিতে হবে এবং সর্বপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে,  বাস্তবতার নিরিখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে, ঋণ করে ঘি খাওয়ার কৃষ্টি পরিহার করতে হবে, পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের দিকে নজর দেওয়াসহ এক্সচেঞ্জ ব্যয় ম্যানেজমেন্ট করতে হবে, ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়িয়ে তারল্য বৃদ্ধি করতে হবে, ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ধরে রাখতে দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে দেশটি আমাদের যা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবান্বিত করুক সেই আশাই রইল।

লেখক: অধ্যাপক, ডীন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)