20211105_152239

তারাছা নদীর প্রান্তরে

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম: অনেকদিন হয় যাই যাই করেও যাওয়া হচ্ছিলো না পাহাড়ি নদী তারাছা নদীর প্রান্তরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার দেবতাখুম। অতঃপর সুযোগ মিলে যাওয়ায়, আর হাত ছাড়া করিনি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাতের গাড়িতে চড়ে দেশের ঐতিহ্যবাহি ভ্রমণ সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর বন্ধুরা মিলে ছুটলাম বাংলাদেশের ছাদ বান্দরবান। ছাদ বলার কারণ, দেশের অধিকাংশ উঁচুউঁচু পাহাড়গুলো রয়েছে বান্দরবানে। বাস যখন বান্দরবান ঢুকে তখন রাতের অন্ধকার কেটে চারপাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। জানালার ফাঁক গলে চোখেমুখে বিশুদ্ধ হাওয়ার ঝাপটা লাগে। সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই বান্দরবান শহরে পৌঁছি। 

বেশ ক’বছর পর যাওয়া। অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। অটো’তে চড়ে সোজা হেটেলে। সাফসুতর হতে হতেই চান্দের গাড়ি এসে হাজির। নাশতা করেই ছুটলাম রোয়াংছড়ি। ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি সর্পিল পথ। যেতে যেতে রোয়াংছড়ি বাজার। সেখানে দেবতাখুম ভ্রমণের ফরম পূরণ করে ছুটলাম কচ্ছপতলী লিরাগাঁও আর্মী ক্যাম্প। প্রয়োজনীয় ফর্মালিটি সেরে এবার পা’য়ে হেঁটে গাইড মিস্টার অঙ্কিনের সঙ্গে চললাম শীলবান্ধা পাড়া। যতোই এগিয়ে চলছি, ততোই সৌন্দর্যের ঘোরে আচ্ছন্ন হতে থাকি। পথটাতে এক অন্যরকম মায়া আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শঙ্খ নদের উপনদী তারাছা নদীর তীর ধরে প্রায় ঘন্টাখানেক যাবার পর ইঞ্জিন বোটে চড়ি। না জানার কারণে নদীটাকে অনেকে ঝিরি ভেবে ভুল করে থাকে। কারণ দেবতা খুম যাবার সময় কোথাও কোথাও তারাছা নদীর বুকের ওপর, হাটুঁ সমান পানি কেটে ভ্রমণ পিপাসুদের এগিয়ে যেতে হয়। 
      
নৈসর্গিক পথে বোট চলছে। নদীর দুতীরে পাহাড়। সেই পাহাড়ে প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়া ঘন সবুজ অরণ্য। পাহাড়ের ফাঁক গলে আসা হিমেল হাওয়া হাইকিংয়ের ক্লান্তি দূর করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বোট চালক আমাদেরকে মানুষের বাজারে নামিয়ে দেয়! মানুষের বাজার বলছি কারণ, সেখানে ছিলো প্রচুর ভ্রমণ পিপাসুদের সমাগম। দে-ছুট বেশির ভাগ সময় নিরিবিলী জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করতে করতে, এখন কোথাও সাধারণ ভ্রমণ পিপাসুদের মিলন মেলা দেখলেই হকচকিয়ে যায়। ব্যপারটা দে-ছুট এর জন্য অস্বস্তিকর হলেও দেশের মানুষের মাঝে যে ভ্রমণ নেশা জাগ্রত হচ্ছে, তা ভেবেই বেশ আনন্দ পাই। আগতদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে, দায়িত্বরতদের ঘনঘন উচ্চ স্বরে মাইকিং চলছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। অধিকাংশদের মাঝেই নিয়ম না মানার প্রবণতা। যে কারণেই হয়তো মাত্র কয়েকদিন আগেই তরতাজা একটি প্রাণের হয়েছিলো সলিল সমাধি। নিরাপত্তা কর্মিরা যথেষ্ট সতর্ক নিয়ম শৃঙ্খলার বিষয়ে। ব্যপারটা প্রশংসনীয়। তাই আমরাও স্থানীয় পাড়ার বম সম্প্রদায়ের বাঙ্গালী জামাই রবিউলের সঙ্গে পরিচয়ের সুত্র ধরে, সিরিয়াল ব্রেক করার পূর্ব পরিকল্পণা বাদ দিয়ে - নির্ধারীত সময়ের জন্য অপেক্ষায় রয়েছিলাম। এতে প্রায় ঘন্টাখানেক দেরী হয়েছিলো। তবে নিয়ম মেনে চলছি, এই ভেবে বিরক্ত লাগেনি। 
   
সিরিয়াল নাম্বার ১২। ডাক আসতেই লাইফজ্যাকেট পড়ে সবাই রেডি। নৌকায় চড়ব নাকি বাঁশের ভেলায়। ২য়টা বেছে নেয়ায় আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা। এরপর সবাই বেশ কয়েকটা ভেলায় ভেসে, প্রত্যেকে নিজে নিজেই মুলি বাঁশের সাহায্যে বাইতে শুরু করি। তারাছা নদীর স্বচ্ছ টলটলে পানিতে ভেলা আগাতে থাকে। দুপাশে খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে বিশাল পাথুরে পাহাড়। ওর মাঝ দিয়েই আমরা চলছি। যতোই আগাতে থাকি ততোই সরু হতে থাকে দেবতাখুমের অভ্যন্তর। ক্ষুদ্র নৃত্বাত্তিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা গর্তকে খুম বা কুম বলে থাকে। জায়গাটা বিশাল পাহাড়ের মাঝে হওয়াতে, হয়তো তারা এটাঁকে দেবতা কুম নাম রেখেছে। ভেলা ভাসাতে ভাসাতে একেবারে দুই পাহাড়ের মাঝের সবচাইতে সঁরু জায়গা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছালাম। এই জায়গার সৌন্দর্য আরো বেশি নয়নাভিরাম। ছোটবড় অজস্র পাথর প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এপাশটায় গভীরতা ছিলো কম। কিন্তু পানি প্রবাহের ক্ষিপ্রতা ছিলো অনেক বেশি। টলটলে পানির নীচের সব কিছুই ছিলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। সূর্যের আলো এখানে ঠিকমত পৌঁছতে পারে না। ভরদুপুরেও মনে হবে সন্ধ্যা। এ যেনো কোন মায়াবিনী তার ভালোবাসার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। ব্যপারটা সম্পূর্ণ মনস্তাত্তিক। প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হতে পারা, কোন ভ্রমণ পাগলার মানসিক অনুভূতি। এসবই মনের অপার্থিব সুখ। যা শুধু একান্তই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। বলে-লিখে কখনো তা বুঝানো যায় না।
       
ইচ্ছে ছিলো পায়ে হেঁটে আরো কিছুদূর আগাবো। কিন্তু দায়িত্ববোধ ও মানবতা বলে কথা। কারণ আমরা ফেরার পর, সেই ভেলায় চড়ে আরো অনেকেই ছিলেন প্রবেশের অপেক্ষায়। তাই আর দেরী না করে ফিরতে শুরু করি। নিরাপত্তা কর্মীদের তথ্যমতে দেবতা কুমের কোথাও কোথাও ৬০/৭০ ফিট পর্যন্ত পানির গভীরতা রয়েছে। সুতরাং সাবধান। যতোই মায়ার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন না কেনো, লাইফজ্যাকেট না পড়ে ভিতরে ঢুকার দুঃসাহস করবেন না। 

যাবেন কী ভাবেঃ ঢাকা-বান্দরবান। বান্দরবান-রোয়াংছড়ি বাজার। সেখানে স্থানীয় গাইড মিলবে। থানায় নাম ঠিকানা এন্ট্রি করে, চলে যেতে হবে কচ্ছপতলী আর্মী ক্যাম্প। ক্যাম্প হতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেবতাখুম যাবার অনুমতি মিলবে। 

খাওয়া-দাওয়াঃ যাবার সময়ই কচ্ছপতলী বাজারে থাকা পছন্দমত কোন হোটেলে খাবার ওর্ডার করে যাবেন। 

সময় ও খরচপাতিঃ যাওয়া-আসা দুই রাত মাঝে একদিন হলেই, মাত্র তিন হাজার টাকায় দেবতাখুম ঘুরে আসা যাবে। 

টিপসঃ তিন কপি ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সঙ্গে নিতে হবে। নিরাপত্তা কর্মীদের কথা অমান্য করে লাইফজ্যাকেট পরিধান হতে বিরত থাকবেন না। কিংবা প্রবেশের পর খুলে ফেলবেন না। যারা সাঁতার জানেন না, তাদেরকে দেবতাখুম ভ্রমণে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের অনুরোধ থাকবে।

ছবির ছৈয়ালঃ নাজমুল আহমেদ


Comment As:

Comment (0)