মিহির

বাজেট ২০২২-২৩: মূল্যস্ফীতি জীবনমান উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় কেন

ড: মিহির কুমার রায়: সামষ্টিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় দু’টি বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের হার। মূল্যস্ফীতি শুধু ব্যবসা বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করেনা,  দরিদ্র হওয়ার প্রক্রিয়াকেও সমানভাবে ভাবিত করে। সেজন্যই বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি সামষ্টিক অর্থনীতির মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং বাংলাদেশও এই আলোচনার অন্তর্গত রয়েছে। এই মাসের ৯ই জুন মহান জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট মহান জাতীয় সংসদে পেশ করার কথা রয়েছে যেখানে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ এবং চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকার যেসব তথ্য দিয়েছিল তার সাথে বাস্তবতার কোন মিল যে আছে তা অনেক অর্থনীতিবিদ কিংবা ব্যবসায়ি নেত্রীবৃন্দ মনে করেন না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৬.২২ শতাংশ অথচ বাজার বলছে দ্রব্যমুল্যের যে পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে তাতে মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। 

মূল্যস্ফীতির কারণ যেমন একটি নয়, তেমনি এর প্রতিকারও একটি সূচকের তারতম্য করার মাধ্যমে সম্ভব নয়, এর হার বৃদ্ধির সমস্যার উৎস যেমন বহুমুখী-বহুমাত্রিক, গ্রামে কিংবা শহরে-নগরে কিংবা বন্দরে-  তেমনি এর প্রতিকারেও প্রয়োজন বহুমুখী-বহুমাত্রিক কার্যকলাপের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া। তবে তিনটি বিষয় মূল্যস্ফীতির জন্য প্রবিধানযোগ্য যেমন চাহিদাগত;   পণ্য মূল্যের ওপর হঠাৎ করে বহিরাগত ধাক্কা ও স্বল্প মেয়াদে আমদানিকৃত পণ্য ও কাঁচামালের ঘাটতি। হঠাৎ করে মূল্যস্ফীতি কার্যত সব দেশের জন্যই একটি বড় রকমের সমস্যা হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, উন্নত অর্থনীতিগুলোয় মূল্যস্ফীতির হার অনেকাংশে বেশি যেমন আমেরিকার বর্তমানে ৮.৫ শতাংশ, ইউরোপীয় অঞ্চলগুলোয় ৭.৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৭ শতাংশ এবং উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারত (৭%), বাংলাদেশ (৬.২%)  ও দক্ষিণ কোরিয়ায় (৪.১%)। অতিরিক্ত তারল্য ও চাহিদার কারণে যখন মূল্যস্ফীতি ঘটে তখন পণ্য ও পরিষেবা জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি আরো অপরিবর্তনশীল হয়। কিন্তু আজ মূল্যস্ফীতির এ অবস্থার জন্য দায়ী জ্বালানি ও খাদ্য। আমরা যদি এ পণ্যগুলোকে সরিয়ে রাখি তাহলে ইউরো জোনের মূল্যস্ফীতির পরিমাণ এক ধাপে ৭.৫ শতাংশ থেকে কমে ৩.২ শতাংশ হবে। যদিও আমেরিকান মূল্যস্ফীতি ৮.৫ শতাংশ থেকে কমে হবে মাত্র ৬.৫ শতাংশ। ব্যাপক সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটি মনে রাখা জরুরি,  যখন একটি দেশ প্রধানত চাহিদা চালিত মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হয় এবং বোর্ড জুড়ে দাম বেড়ে যায় তখন বিনিময় হারের সংশোধন প্রভাবটিকে এর সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারে।
 
এখন আসা যাক বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কিছু কথা যেখানে মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরিব মানুষ আর এ অবস্থায় তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার অথচ ফেব্রুয়ারিতেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.১৭ শতাংশ,  যা গত প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবার কি অবস্থা হবে-বাজেট বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলবেন তবে ঘোষনা এসেছে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশ হবে। 

আমাদের ভোগ্য পণ্যের তালিকায় তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ যেমন গ্যাস,  বিদ্যুৎ ও রান্নার তেল। এই তিনটির দাম সব অংককে হার মানাচ্ছে অথচ  প্রতিটির ক্ষেত্রে সদিচ্ছা থাকলে দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণকে সুরাহা দেওয়া যেত বলেই মনে করছেন বাজার গবেষক মহল। আবার সরকারি সংন্থাসমুহ যে তথ্য দিচ্ছে সারা দেশের উপর জরীপ করে তাতে শহর ও গ্রামের মধ্যে একটি বিভাজন সৃষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে্ যেমন বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যাচ্ছে গত মার্চে শহর ও গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫.৬৯ এবং ৬.৫২ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে ০.৮৩  শতাংশ বেশি হয়েছে। আর খাদ্য খাতে যখন শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫.৪৯ শতাংশ, তখন গ্রামে এখাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.৭১ শতাংশ, খাদ্য বহির্ভূত খাতে শহর (৫.৯০%)  ও গ্রামে (৬.৯০%) ছিল মার্চে। তথ্য আরও বলছে গত ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি  থেকে ২০২২ এর মার্চ পর্যন্ত টানা ১৪ মাস শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে বিধায় গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সানেম) বলছে বিগত ২০১০-১১ অর্থবছরে বিবিএসের মজুরি সূচক ছিল ১০০ পয়েন্ট, যা ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০.৮৩ পয়েন্টে অর্থ্যাৎ ২০১০ সালে মানুষের গড় মজুরি যদি ১০ হাজার টাকা হয়, তাহলে ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ৮৩০ টাকা (৮০% প্রবৃদ্ধি)। অন্যদিকে বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ সালে মূল্যস্ফীতি সূচক ছিল ১০০, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সূচক ২৮৮ পয়েন্টে উন্নীত হয় অর্থাৎ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে জিনিসপত্র কিনতে ১০০ টাকা খরচ হতো,  সেখানে তা কিনতে এখন কমপক্ষে ২৮৮ টাকা খরচ হয়। এ সময়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৮৪ শতাংশ, যা মজুরি বৃদ্ধির (৮১%)  চেয়ে কিছুটা বেশি যার অর্থ দাড়ায় মানুষের গড় মজুরি যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম,  ফলে মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গত এক যুগে মানুষের গড় ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এটা জাতীয় পর্যায়ের সার্বিক চিত্র হলেও গ্রামের সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও করুণ যেখানে কর্মক্ষম মানুষের ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে নিয়োজিত যারা বছরের সবসময় কাজ পায়না। তাছাড়া শহরের নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, কুলি,  বন্দর শ্রমিক প্রমুখের তুলনায় গ্রামের কৃষি শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। তাই খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যাদির মূল্যস্ফীতি তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। গবেষকদের মন্তব্য হলো গ্রামাঞ্চলে নিত্য পণ্যের জোগানে খরচ বেশি যা শহর থেকে গ্রামে যায়,  কৃষিভিত্তিক নিত্য পণ্যের উৎপাদন গ্রামে হলেও মজুত গড়ে উঠছে শহরে। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে অধিকহারে বাড়ছে। এছাড়া রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি যাচ্ছে গ্রামে যার ৫৩ শতাংশই অনুৎপাদনশীল ভোগবিলাসে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এই ধরনের একটি অবস্থায় অর্থনীতিবিদগনের মন্তব্য হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্রীয় সূচক হিসাবে বিবেচনায় আনা উচিত। কারণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে নিম্ন আয়ের  মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, আর পরের বিষয় হলো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে,  বিনিয়োগ কোনোভাবেই ৩৩ শতাংশের বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না যার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের হার হলো ২৩-২৪ শতাংশ। কিন্তু করোনার আগে ২০১৯ অর্থবছরে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি। অথচ এখনও বলা হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই অথচ সরকার বলছে, বৃহৎ শিল্পে জিডিপির ১২.৮৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে যার মধ্যে ছোট ও মাঝারি শিল্পে ১১.৭১ এবং কুটির শিল্পে ১১.৭৫ শতাংশ। সাধারণ নিয়মে ছোট শিল্পে বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বাড়ে। এখানেও বৈষম্য হচ্ছে। ফলে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে দেশীয় বাজার মুখী শিল্পকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সাধারণ ও গরিব বান্ধব এ সরকার এ সংকট উত্তোরণের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী প্রত্যাশা করে থাকেন। দেশের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল এবং এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর ব্যবস্থা ও নজরদারি অভাব হলেই দায়সারা মনিটরিং হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা, টিসিবি, পণ্য বিপণন ব্যবস্থাপনা,  চাহিদা সরবরাহ নেটওয়ার্ক এবং সর্বোপরি আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আনয়নপূর্বক এ সমস্যা সমাধানে তৎপর হতে হবে। অধিকন্তু বিভিন্ন বাজার কমিটি দ্রব্যসামগ্রীর গুণাগুণ যাচাই কমিটি,  মালামাল সংরক্ষণ ও গুদামজাত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি মহানগর ও পৌর এলাকাস্থিত বাজারগুলোতে তাদের নিজস্ব পরিদর্শন টিমের আন্তরিকতার সঙ্গে তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। আর সকলের সমন্বিত কার্যক্রমে এ দূরবস্থার নিরসন সম্ভব হবে। গ্রাম নির্ভর বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের আয়ের উৎস শহরবাসীর তুলনায় অনেক কম ফলে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার উদ্বেগের বিষয়। এ সমস্যা মোকাবিলায় যা প্রয়োজন তা হলো গ্রামের মানুষের আয় বাড়ানো যার অংশ হিসাবে বর্ধিত সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলতে হবে,  গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে শিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে,  তাদের মধ্যে সবধরনের ব্যবসার উদ্যোগ সৃষ্টিতে সরকারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। গ্রামাঞ্চলে সেবা খাতের কার্যক্রম,  বিশেষ করে ব্যবসা, পরিবহণ, টেলিকম, রিয়াল এস্টেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, হোটেল,  রেস্তোরাঁ ইত্যাদির ব্যাপক প্রসারের ব্যবস্থা নিতে হবে। রেমিট্যান্সের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলেই দেশ মূল্যস্ফীতির অভিষাপ থেকে মুক্ত হবে, কর্মসংন্থান, উৎপাদন ও আয় বাড়বে যা হবে আগামী বাজেটের অঙ্গীকার।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)