মিহির কুমার রায়

জাতীয় বাজেট: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষন

ড: মিহির কুমার রায়: বিগত ৯ই জুন, ২০২২ তারিখে বৃহস্পতিবার দিবস মহান জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য অর্থমন্ত্রী কতৃক বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট এবং বর্তমান সরকারের সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শেষ বাজেট উপস্খাপিত হয়েছে যার শিরোনাম   ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন। কাজেই এই বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরত্ব দেওয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানব সম্পদ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা সহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে যা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন অনুষ্ঠানে আমরা দেখতে পেয়েছি। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে আগামী অর্থ বছরের জন্য ৬ ধরনের চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাড়তি হারে ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান;  বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা;  শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন;  অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ ও ব্যক্তি আয়কর দাতার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা। তিনি উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ৮ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন,  এগুলো হচ্ছে-ভর্তুকি বাড়ানো, দরিদ্রদের মধ্যে কম দামে খাদ্য বিতরণ,  নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক হ্রাস,  বিলাসী পণ্য আমদানি শুল্ক ও রপ্তানি আয় বাড়ানো। এছাড়া রেমিট্যান্স,  দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ,  কৃষি উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। এজন্য করমুক্ত আয় সীমানা বাড়িয়ে আয়কর থেকে আরও বেশি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে,  নজর দেওয়া হয়েছে আমদানিকৃত ব্যবহার্য পণ্যে বেশি শুল্ক আরোপের ওপর,  পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ভ্যাট বেশি আদায় ও নতুন করে ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, এছাড়া গ্যাস,  বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম পর্যায়ক্রমে সমন্বয় করা হবে-এমন ঘোষণাও আছে,  তবে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর, কারণ মূল্যস্ফীতির হার বাড়লেও কমানো হয়েছে রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগের সীমা, ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে আয়ের পথ সংকুচিত হবে,  আর নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের শুল্ক-কর বাড়ানো এবং ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করায় জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়ার শঙ্কা থাকছেই। 

এখন আসা যাক বাজেটেরে সংখ্যাতাত্বিক বিষয়ে যেখানে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ১৫.৩ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থ বছরের তুলনায় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। সে অর্থে বাজেটের আকার বাড়ছে বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ১২.৫ শতাংশ অর্থ্যাৎ চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছর বাজেটের আকার নির্ধারিত রয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা যা জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জিডিপির অংশ হিসেবে বাজেটের আকার ২ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে আনছে সরকার। সম্ভাব্য বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৯.৮ শতাংশ। অপরদিকে চলতি অর্থ বছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ১১.৩ শতাংশ এবং সেদিক থেকে বাজেটে ঘাটতি দাড়াচ্ছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ যা মোট বাজেটের প্রায় ৩৬ শতাংশের মতো এবং ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট ঘাটতির তুলনায় সামান্য কিছু বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি  ৫.৬ শতাংশ। নতুন বাজেটে এনবিআরের ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যা জিডিপির ৮.৪  শতাংশ যা চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটে এনবিআরের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা  (জিডিপির ৯.৫ শতাংশ)। সে হিসাবে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা যা শতকরা হিসাবে ১২ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা,  কর-বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর)  আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরের মূলবাজেটে এ দুই খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১৬ হাজার কোটি ও ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে যথাক্রমে ১৩ ও ৫ শতাংশ। 

ঘাটতি পূরণে প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা এবং চলতি অর্থবছর যার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারত আছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা যা চলতি বছরে যার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা,  সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। এছাড়া নতুন বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান (নিট)  গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা যা চলতি বছর এক্ষেত্রে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে এডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার আছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জিডিপির প্রাক্কলিত আকার ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা এবং সে অনুযায়ী প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ অথচ যা চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৭.২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ যা চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে ৫.৩ শতাংশ। আবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন খাতের মোট ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১.৯ শতাংশ অথচ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা,  যা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেটের কর ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তনের উল্লেখ করা হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে করপোরেট কর সাধারণ গার্মেন্টসের জন্য ১২ শতাংশ এবং সবুজ কারখানার জন্য ১০ শতাংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দিতে হয়। রপ্তানি পণ্যের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সব ধরনের রপ্তানিমুখী শিল্পের করপোরেট কর ১২ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। এছাড়া স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল ছাড়া অন্য সবধরনের রিপোর্টিংয়ের বাধ্যবাধকতা হতে অব্যাহতি দেওয়া,  কোম্পানির লোকসান ৯ বছর পর্যন্ত সমন্বয়,  ব্যয় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং টার্নওভার কর দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে দশমিক ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এদিকে ব্যবসা পরিচালনা সহজ করা সহ এজন্য খরচ কমানোর লক্ষ্যে উৎসে কর উৎপাদকদের কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ,  ব্যবসায়িক পণ্যের সরবরাহে ৭ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ এবং সরকারি ছাড়া অন্য বই সরবরাহের ক্ষেত্রে ৭ নামিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রসারের জন্য অনাবাসী ব্যান্ডউইথ পেমেন্টের ওপর উৎস কর হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং বিদেশি সংস্থাগুলোতে পরিষেবা প্রদান থেকে উৎস কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া বেভারেজ বা পানীয়র কাঁচামাল, পরিষেবা রপ্তানি,  অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী জাহাজ ও বাণিজ্যিক যানবাহন আমদানিকালে সমন্বয়ের পর ৫ শতাংশ কর ন্যূনতম কর হিসাবে গণ্য করা হবে। এখন মন্ত্রনালয় ওয়ারী বাজেট বিভাজনে দেখা যায় জাতীয় বাজেট মোট ৬২টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের আওতায় এই ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয় ১ লাখ ৯০ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা,  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৪১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৪০ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ৩৬ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা,  রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৮ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২৪ হাজার। 

বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায় যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের যে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে সেটা ঠিক আছে। তবে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নে যা উত্তরণের কোনো দিক নির্দেশনা বাজেট ঘোষনায় পাওয়া যাচ্ছে না। প্রস্তাবিত বাজটে ভর্তুকির মাত্রা বাড়ছে,  তাই যে পরিমাণ ঘাটতি রাখা হচ্ছে সেটা হয়তো পরবর্তী সময়ে বেড়ে যাবে,  তবে আগামী অর্থবছরে ঘাটতি ৬ শতাংশ হলেও সমস্যা নেই,  তবে ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে,  অভ্যন্তরীণ বিশেষ করে অত্যন্ত ব্যয়বহুল সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমানোরও পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদগন,  অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আয় কম থাকলেও এখন বাড়ছে,  অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক থাকলে আগামী অর্থবছরেও রাজস্ব আয় বাড়ার প্রবণতা বজায় থাকবে। তবে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি ও সারের দাম বাড়ার কারণে সরকারি ভর্তুকির বোঝা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার আয় বাড়িয়ে এ বোঝা লাঘব করতে চায়। প্রস্তাবিত বাজেটের আর্থিক কাঠামো প্রস্তুত করা অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় কষ্টকর,  কারণ ব্যয়ের বড় দুটি অংশ যাবে ভর্তুকি প্রণোদনা এবং সুদ পরিশোধে। এ দুই খাতে প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্যয় হবে। এর সঙ্গে বেতন-ভাতাসহ সরকারের অন্যান্য পরিচালন ব্যয় যোগ করলে সেটা আরো বেড়ে যাবে। তাই উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করার জন্য অর্থ খুব কমই থাকবে। এটিই এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

এদিকে আয় বৈষম্য কমাতে সাধারণ মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। তার জন্য দরকার পরিকাঠামোর প্রসার। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণে ঘোষণা করলেও তার আর্থিক নীতির কোথাও বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। বাজেটের কর ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তনের উল্লেখ করা হয়েছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়তে কোম্পানির করপোরেট কর হ্রাস,  এক ব্যক্তির কোম্পানিতে কর ছাড় এবং স্টার্টআপ কোম্পানির কর হ্রাসের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্যনীয় যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকোচন হচ্ছে, প্রবাসী আয়ে ভাটার টান,  রফতানিতেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান ক্রমে নিম্নমুখী,  খোলা বাজারে দেশী মুদ্রার মান আরো কমে যাওয়া,  বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক এরই মধ্যে আরোপ করেছে বিধায় সেসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জনমনে অস্থিরতা ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে সাধারণত দুটি বিকল্প উৎস ব্যবহার করে থাকে; এক.  বৈদেশিক ঋণ এবং দুই.  দেশী ঋণ। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে তেমন বৈচিত্র না থাকলেও দেশী ঋণের প্রকারে বেশ বৈচিত্র লক্ষণীয়। সরকার জাতীয় বাজেটে ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ঋণ অন্যতম, এর বাইরে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের আওতায় পরিচালিত বিভিন্ন সঞ্চয় এবং ঋণপত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে ও সরাসরি ঋণ নিয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় বাজেটে ঘাটতি মোকাবেলায় সঞ্চয়পত্র ও ঋণপত্রের মাধ্যমে অর্থ সংস্থান করেছে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংক খাত থেকে একই সময়ে একই উদ্দেশ্যে সরকারের ধার ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। উল্লিখিত ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৬০০ কোটি এবং স্বল্প মেয়াদি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রশ্ন হলো,  অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত ব্যাংক ঋণ অথবা জনসাধারণের কাছ থেকে নেয়া সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণের সুবিধা-অসুবিধা কী? এই  প্রশ্নগুলো নিয়ে অর্থনীতিবীদদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। তারা বলছেন,  একটি দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তাও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ও জিডিপির আকার প্রতি বছরই বাড়ছে। তবে এর সঙ্গে সংগতি রেখে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ ও আওতা তেমন বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যে পরিমাণ বরাদ্দ ছিল, আগামী অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় সেই বরাদ্দ কমেছে যা জিডিপির তুলনায় ২.৬০ শতাংশ, অন্যদিকে এর আকার ৩ থেকে ৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্লেষনে দেখা যায় আগামী নির্বাচনের আগে এ বাজেট অনেক গুরত্বপূর্ণ। এর পরবর্তী বাজেট এ সরকার ঘোষণা দিলেও সেটি বাস্তবায়নে মাত্র ছয় মাস সময় পাবেন। ফলে এটি হবে বর্তমান সরকারের পূর্ণাঙ্গ শেষ বাজেট। এ বাজেট ভোটার আকৃষ্ট করার ওপর নির্ভর করবে। বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো হবে-এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল কৌশল হিসাবে নেওয়া হয়েছে,  মূল্যস্ফীতি আগামী বছর ৫.৬ শতাংশের মধ্যে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। সে লক্ষ্যে আমদানি নির্ভর ও কম গুরত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা হবে, নিম্ন অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন গতি হ্রাস করা হবে, একই সঙ্গে মধ্যম ও উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে,  দেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।  এই প্রক্রিয়ায় কর দিয়ে অর্থ বৈধ হয়ে গেলে তা নিয়ে প্রশ্ন করবেনা কর্তৃপক্ষ। তাই সরকারের এই মহতি প্রচেষ্টা, কৌশল ও বাজেট বাস্তবায়ন সফল হউক এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)