মিহির

সার্বজনীন পেনশন স্কিম সরকারের মানবিক উদ্যোগ

ড: মিহির কুমার রায়: জাতীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে সর্বসাধারণের জন্য পেনশন স্কিমের উদ্যোগ সরকারের দূরদর্শী চিন্তার একটি সফল প্রতিফলন। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ছিল বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে ক্ষুধা,  দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বসাধারণের জন্য যে পেনশন-ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছেন যা প্রশংসনীয় ও সময় উপযোগী উদ্যোগ। এটি দেশের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে সরকার এরই মধ্যে কৌশলপত্র তৈরি করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ব্যাপারে সরকারের চিন্তার ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। পরবর্তিতে বর্তমান অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের অবহিত করলেন যে,  আগামী এক বছরের মধ্যে চালু হতে যাচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। মাননীয় অর্থমন্ত্রী এই ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য যেসব বিষয় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেছেন সেগুলো যদি স্বচ্ছতা ও বিধির মাধ্যমে চালু করা যায় তাহলে সমাজ জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরি মধ্যে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে সর্বজনীন পেনশন চালু করবে বলে ঘোষনা দিয়েছে সরকার। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আমি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দিচ্ছি যে,  সরকার আগামী অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরও বলেন,   ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। জুন ২০, ২০২২ সোমবার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ উপলক্ষে মন্ত্রি পরিষদ সচিব বলেন,  ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা এই পেনশন স্কিমের আওতায় আসবে। তবে এর বেশি বয়সীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ৬০ বছরের পর থেকে এ পেনশন কার্যকর হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে,  বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে নির্ভরশীল মানুষের বর্তমান হার ৭.৭ শতাংশ,  যা ২০৫০ সালে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৫৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারি চাকরি করছেন মাত্র ১৪ লাখ মানুষ। এসব সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পেনশন সুবিধা রয়েছে। বাকি ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি, বেসরকারি খাত,  ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। এদের কোনো পেনশন সুবিধা নেই। তাই সকল মানুষকে পেনশনের আওতায় আনতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত।

অর্থমন্ত্রীর কথা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সের যে কোনো কর্মক্ষম নাগরিক পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন, প্রবাসীরাও বাদ পড়বেন না। শুধু ব্যক্তি পর্যায় নয়,  প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। ব্যবস্থাটির আওতায় গ্রাহক যে পরিমাণ টাকা মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জমা দেবেন তার সমপরিমাণ টাকা দেবে সরকার,  জমাকৃত অর্থ বিনিয়োগ করে যে লাভ অর্জিত হবে তারও হিস্যা পাবেন গ্রাহক। পরে প্রাপ্তিযোগ্য বয়সে মাসিক ভিত্তিতে পেনশন হিসেবে প্রদান করা হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। নিম্ন আয়ের মানুষের মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দেবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কর্মসূচিটি ঐচ্ছিক,  পরে তা বাধ্যতামূলক হবে। ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’  নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে একে সমুদয় কার্যাদি দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হবে।

২০২১ সালের মে মাসে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনিসেফ তাদের এক নীতিপত্রে জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রবীণ প্রবণ সমাজে প্রবেশ করবে ২০২৯ সালে। ২০৪৭ সালে সমাজটি প্রবীণ প্রধান সমাজে রূপান্তরিত হবে। জনসংখ্যাবিদদের মতে মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে সেটি হবে প্রবীণ প্রবণ সমাজ। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে তা হবে প্রবীণপ্রধান সমাজ। নিজেদের করা একটি প্রক্ষেপণের সূত্র ধরে অর্থমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর থেকে ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছরে গিয়ে ঠেকবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে, যার অন্য অর্থ হলো কর্মে-অক্ষম নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়বে। পরিবারের অবহেলা থেকে বাঁচানোর তাগিদ থেকে রাষ্ট্রকেই পাশে দাঁড়াতে হবে প্রবীণদের। ২০২৯ সাল দূরে নয়,  তাই এখন থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সেটিই হবে সঠিক পদক্ষেপ। এতদিন কেবলমাত্র সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কর্মরতরা এই পেনশন সুবিধা ভোগ করতেন যারা মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ তারা। সুবিধা সম্প্রসারিত হয়ে যদি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত গড়ায় তো একে সন্দেহাতীত ভালো খবর। ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা উন্নত রাষ্ট্রের নিবাসী হওয়ার স্বপ্ন দেখি,  সে স্বপ্ন নিরর্থক প্রতীয়মান হবে যদি না সামাজিক নিরাপত্তার বলয় বাড়ানো যায়। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রবর্তন হতে পারে লক্ষ্যপূরণে এক ধাপ অগ্রগতি। 

বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে দারিদ্র্যের হার হ্রাস আশাব্যাঞ্জক হয়েছে, কিন্তু করোনা পরিস্তিতির প্রভাবে আবার অতি দারিদ্র্য এবং সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এখন সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁডিয়েছে চরম দারিদ্র্য তথা সার্বিক দারিদ্র্যের হার যাতে পুনরায় বৃদ্ধি না পায় তা যথার্থভাবে মোকাবিলা করা। আর এক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা,  বয়স্ক ভাতা,  বিধবা ভাতাসহ  সরকারের আরও কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কখনও কখনও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল কারও কারও বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। অনেক ভালো উদ্যোগ অনিয়ম-দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ার নজিরও আমাদের সামনে রয়েছে। বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনেক সফলতার কাহিণি রয়েছে সত্যি কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন না হওয়ার কারনে অনেকেই এর সুফল পাচ্ছে না। যারা বেসরকারি খাতের সঙ্গে যুক্ত,  তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা তেমন কিছুই পান না। বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেগুলো চলমান,  সেগুলোর বেশির ভাগই বয়স্ক-দরিদ্রদের জন্য যার কোনোটিকেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সেই অর্থে নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। এখানে উল্লেখ্য যে এই সময়টি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী তথা মুজিব বর্ষের বছর যেখানে অনেক প্রপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও রয়েছে যা আমাদের পূরন করতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে যা সকলেরই জানা রয়েছে এবং সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা যে বিশাল কর্মযজ্ঞ- এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্নিষ্ট মহল আন্তরিক রয়েছেন বলে প্রতিয়মান হয় যদিও মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দূরদর্শী পরিকল্পনা ও এর সফল প্রয়োগ জরুরী। ক্ষুদ্রাকৃতির একটি দেশে বিপুলায়তন জনগোষ্ঠী-  এই বাস্তবতা স্বভাবতই অসংখ্য সমস্যার জন্ম দেবে। সেসব মাথায় রেখেই এগোতে হবে এবং আমাদের মনে রাখতে হবে অপরিকল্পিত উন্নয়ন,  নদী ভাঙন ইত্যাদি রোধ করা না গেলে ভূমিহীন-আশ্রয়হীনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে,  সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলাতে পারবে না। শিক্ষা ও চিকিৎসা পরিস্থিতি পঞ্চাশ বছরের পথ পরিক্রমা শেষে যে পর্যায়ে উন্নীত,  তাকে কাল-বিবেচনায় সন্তোষজনক বলা যাবে না। তবে সরকারের প্রচেষ্ঠার কোন ঘাটতি নেই এই জনবহুল দেশটিতে যদিও তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তারই অংশ হিসাবে এই ব্যবস্থা সামাজিক নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত হবে, সর্বজনীন পেনশন তহবিলে যত অর্থ জমা হবে এবং এর অংশ বিশেষ সরকার নানা খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাবে। যা হবে উৎপাদন ও কর্মসংন্থানমুখী। 

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আর এদেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। দেশের মানুষ কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। যে দেশের কৃষকেরা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল ফলিয়ে মানুষের মুখের অন্ন জোগায়, সে দেশের কৃষকেরা পায়না কোন মর্যাদা, উৎপাদিত ফসলের কোন ন্যায্যমূল্য দেয়া হয় না। পেনশন স্কিমটি যে প্রক্রিয়াই হোক ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে ১ বছরের মধ্যেই চালু করে দেশে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, যে কোন চাকরি শেষে তাদের পেনশন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মতো  কৃষকের নামে ভাতা চালুর দাবি রইলো। হয়তো অনেকে বলবেন যে বয়স্ক ভাতা,  বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা তো কৃষকের মধ্যেই পেয়ে থাকে। কিন্তু না,  কৃষক পেনশন ভাতা আলাদাভাবে চালু করতে। কারণ, ষাটোর্ধ্ব বয়সী যেসব কৃষক তারা না পারে, কোন চাষ কাজ করতে,  না পারে অন্য কিছু করে জীবিকা রক্ষা করতে। তাই তাদের বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন দরকার। সম্প্রতি কৃষক প্রতিনিধিদের এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে দাবিটা উঠে এসেছিল। তাহলেই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসাবে ঘোষিত পেনশন-ব্যবস্হা উন্নয়ন হবে বর্তমান সরকারের শ্রেষ্ঠ উপহার।

লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)