মিহির

নতুন মুদ্রানীতি সঙ্কোচনমুখী ও সতর্কতামূলক

ড: মিহিরি কুমার রায়: বিগত ৩০শে জুন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রা নীতি ঘোষণা করে যা অনেকাংশে সতর্কতামূলক সংকোচনমুখী ও মূল্যস্ফীতিনাশক। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ব বাজার যেখানে অস্থির, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা হানা দিয়েছে- এমন পরিস্থিতিতে সতর্কতার পথেই হাঁটতে চাইছে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মহামারীর কারণে  মাঝে ২০২১ ও ২০২২ দুই বছর মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে। কিন্তু এবার পুরনো রীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুদ্রা নীতি ঘোষণা করে  বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর বলেন, ‘টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান, ও বিনিময় হার ‘স্থিতিশীল রাখাই’ হবে মূল চ্যালেঞ্জ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ যোগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে,  তাতে সরকারী ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৯.৪ শতাংশ,  যা গতবার ছিল ৩৬.৬ শতাংশ আর বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ, যা গতবার ছিল ১৪.৮  শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.২ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে র্নিধারণ করা হয়েছিল ১৭.৮০ শতাংশ। এর মানে হল,  নতুন অর্থবছরে সরকারী খাতের ওপর ভর করে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য হলো চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে একদিন মেয়াদী রেপোর সুদ হার ৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে এই হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছিল অর্থাৎ এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বাড়ানো হল রেপো হার। তবে রিভার্স রেপো হার আগের মতোই ৪ শতাংশ, বিশেষ রেপো হার ৮ শতাংশ এবং ব্যাংক রেট ৪ শতাংশ রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে,  তখন তার সুদ হার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ব্যাংক রেট এ যে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দেয় এসব নীতি হারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য প্রবাহ আর অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে,  যাতে বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপযুক্ত আর্থিক পরিবেশ তৈরি হয়,  আবার বাজারে পণ্য মূল্যও সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়।

সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচী ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয় যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থ প্রবাহ ও আঙ্গিক কেমন হবে,  তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেয়া হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রা নীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম ২)  প্রবৃদ্ধি কিছূটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১২.১ শতাংশ, গতবার এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ;  গত জুন পর্যন্ত এর ৯.১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার ঘোষনা দিয়েছে সরকার।

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অভিমত হলো-নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রা নীতি মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে খুব বেশি সহায়তা করবে না বরং আরও উসকে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক দিকে নীতি নির্ধারণী সুদের হার বাড়ানো হয়েছে,  এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর চাপ তৈরি হবে। অন্য দিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্থ হবে, মানুষের আয় কমবে, টাকার ক্ষয়জনিত কারণে মানুষ চাপে পড়বে ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বাড়ার কারণে স্থানীয় বাজারে আরও বাড়তে পারে। তাদের মতে,  মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে মুদ্রা নীতির বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা নেওয়া হয়েছে তা বিপরিত মূখী। করোনার ক্ষতি মোকাবিলা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়াটা ছিল জরুরি। কিভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে তার কোনো দিক নির্দেশনা নেই, খেলাপি ঋণ কমানোর পদক্ষেপ নেই,  কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেই বরং বিভিন্ন সূচকের যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তাতে ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তারা আরও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। নিয়মিত সুদের হার না বাড়িয়ে বাড়ানো হয়েছে নীতি নির্ধারণী বা রেপো সুদের হার, এতে ব্যাংকগুলো আরও বিপদে পড়বে। অর্থনীতিতে নানা সংকটের মধ্যে যখন ঋণ প্রবাহ আরও বাড়ানোর দরকার ছিল তখনও কমানো হলো। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা নীতি খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেনা। এখন যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে আমদানি ও পণ্য মূল্য বৃদ্ধিজনিত। মূল্যস্ফীতি কমাতে পণ্য মূল্যের লাগাম টানতে হবে। সে ব্যাপারে মুদ্রা নীতি ও বাজেটে কোনো পদক্ষেপ নেই। 

আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে নতুন পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালুর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে অর্থের সরবরাহ আরও বাড়বে, সরকারের ঋণও বাড়বে, পাশাপাশি বিলাস জাতীয় দ্রব্য, বিদেশি ফল,  অশস্য খাদ্যপণ্য, টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত  মার্জিন আরোপের ঘোষণা এসেছে। উল্লিখিত সব পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে,  এতে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদ হার হিসাবে পরিচিত রেপোর সুদের হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এই নীতি সুদ হার বৃদ্ধি পাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে ব্যাংকগুলোকে এখন বেশি সুদ দিতে হবে যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আংশিক কাজ দেবে। তবে এর প্রভাবে ঋণের প্রবাহ বেশি কমে গেলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে পণ্যের সরবরাহজনিত সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যেতে পারে। 

এ করের মুদ্রা নীতির আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো বাজারে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানো যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।  ঋণের প্রবাহের উৎস প্রধানত:  আমানত সংগ্রহ ও বৈদেশিক অনুদান। এখন আমানতের উপর সুদের হার কম হওয়ায় আমানতকারিরা ব্যাংকে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রে আগ্রহী বেশী লাভের আশায়।  আবার বৈদেশিক অনুদান সংগ্রহে অনিশ্চয়তা রয়েছে যদিও অতীতের সকল অর্জন দেশের সরকারকে আরও সামনে নিয়ে যাবে। বর্তমান অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাড়িয়েছিল  ২৮৯০ মার্কিন ডলার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন দেশের আর্থিক সেবা বঞ্চিত জনগোষ্টিকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার অভিযান বিশেষতঃ দারিদ্র বিমোচন,  খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, এস,এম, ই, খাতে অর্থ যোগাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত পাঁচ বছরে অনেক উদ্যোগ গ্রহন করেছে, নারীদের অংশগ্রহন বৃদ্ধি ও নারী উদ্যেক্তা সৃষ্টিতে এস,এম,ই খাতে পূনঃঅর্থায়ন স্কীমে ১৫% অর্থ কেবলমাত্র নারী উদ্যেক্তাদের জন্য বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। এই সকল অর্জন দেশের সরকারকে আরও সামনে নিয়ে যাবে। এখানে উল্লেখ্য যে মুদ্রা নীতির সাথে রাজস্ব নীতির সর্ম্পক ঘনিষ্ট বিধায় প্রথমটির ইতিবাচক প্রভাবে যদি কর্মসংস্থান,  উৎপাদন ও আয়ে পড়ে তবে দ্বিতীয়টির উপর এর গুনগত প্রভাব পড়তে বাধ্য। তবে আশা করা যাচ্ছে যদি প্রবাহ তথা বিনিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদনের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় তবে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু প্রশ্নটি বর্তমান গনতান্ত্রিক সরকারের কাছে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ যথা প্রথমত: বানিজ্য সহায়ক অবকাঠামো নির্মান করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা:  দ্বিতীয়তঃ স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করা এবং তৃতীয়তঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষত:  ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা ও রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখা। এই গুলোর সমাধানকল্পে সরকারের অবশ্যি উৎসাহের কোন ঘাটতি থাকার কথা নয় যদি মুদ্রানীতির সফল বান্তবায়ন দেখতে চায় এবং দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চায়।

তবে মুদ্রা নীতির শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারী ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে যা বর্তমানে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শুধু তাই নয় এ খাতে অনৈতিক কাজগুলো সার্বিক অর্জনকে কুলষিত করছে যা অনেকের কাছে দৃষ্টি কটোর। এ ব্যাপারে সুশাসনের বিষয়টি আর্থিক খাতে সফলভাবে প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার ব্যাপারে তফসীল ব্যাংকগুলোর আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে নজরদারি বাড়ানো পূর্বেকার মত অব্যাহত রাখে তবে মুদ্রা নীতির বাস্তবায়নের হার অনেকাংশে বাড়বে। তাছাড়াও এই খাতকে গতিময় করতে শুধু অর্থঋণ আদালতই যথেষ্ট নয় বরংচ বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে মামলাগুলোর দ্রুত  নিস্পত্তি করতে হবে। হিসাব অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন খাতে আনুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থের যোগ না হয় তা দেশের জি.ডি.পি. এর প্রায় তিন শতাংশের সমান। সাধারণভাবে তত্ত্ব বলছে দুর্ণীতি বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দেয়,  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিমিত করে,  পণ্য মূল্যকে প্রভাবিত করে এবং সর্বপরি সুশাসনকে বাধাগ্রস্থ করে। কাজেই এই সকল সমস্যাগুলো সমাধান করে মুদ্রা নীতির বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। তাহলেই দেশের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি  অর্জন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)