ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে সংশয়
ড: মিহির কুমার রায়: অতি সম্প্রতি ৩০শে জুন, ২০২২ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গর্ভনর মুদ্রা নীতি (২০২২-২৩) ঘোষনাকালে বলেছিলেন দেশের সামনে দুটি মূল চ্যালেঞ্জ যথা মূল্য স্ফীতি নিয়ন্ত্রন ও বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি অতি আলোচিত বিষয় বিশেষত দক্ষিন এশিযার দেশ শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর। এরি মধ্যে বিগত ১২ জুলাই, ২০২২ তারিখে নূতন গর্ভনর বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের পর পরি পূর্বের ন্যায় একই ভাবে মূদ্রার ব্যবস্থাপনার সংকট মোকাবেলায় নতুন তিনটি পদক্ষেপ ঘোষনা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে ডলারের চাহিদা কমিয়ে আনতে পণ্য আমদানি তদারকি, অব্যবহৃত ডলার নগদায়ন এবং ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য অর্থ ধার নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে আলাদাভাবে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রপ্তানি আয় হিসেবে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার ইআরকিউ (রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা) হিসাবে রাখা অর্থের ৫০ শতাংশ নগদায়ন করতে হবে এবং এর সীমা কমানো হয়েছে। অপরদিকে ব্যাংকের বিদেশে পরিচালিত অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও সরকারি পর্যায়ে আমদানির জন্য ব্যাংকের রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ অর্থ যোগান দেওয়া যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি র্নিধারণী এই তিন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
এরি মধ্যে আ্ই,এম,এফ এর একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম (আইএমএফ স্টাফ ভিজিট মিশন-২০২২) বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং ব্যাংক খাতে সংস্কারের অগ্রগতি জানতে গিয়ে সরকারি ব্যাংকে উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাও জানতে চেয়েছে। একি সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে ফের আপত্তি তোলে আইএমএফ। তাদের মতে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল সহ (ইডিএফ) বিভিন্ন ঋণ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনো রিজার্ভেই দেখানো হচ্ছে। অথচ এগুলো নন লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসাবে বিবেচিত হবে না। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক: একটি হলো গ্রস হিসাব এবং আরেকটি নিট হিসাব। নিট হিসাবে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ঋণ তহবিল বাদ দেওয়া হয়। তবে আগামীতে আইএমএফের ম্যানুয়াল মেনেই রিজার্ভের হিসাব দেখানো হবে বলে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে রিজার্ভের অর্থে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে ৩ কোটি ৮৫ লাখ এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই ৭৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলংকাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। এটা রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।
খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রথম থেকেই সরকারের অর্থ মন্ত্রনালয় সরগরম এবং ২ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করে খেলাপি ঋণীরা আরও নয় মাস ঋণ পরিশোধের জন্য সুযোগ পাবে বলে ঘোষনা এসেছিল এবং যারা শতকরা ৯ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারি তারা অনেকটা অখুশি হয়েছিল তারপরও খেলাপি ঋণীর সংখ্যা ও ঋণের পরিমান কমেনি। তথ্য বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসেবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসেবে প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এখন কোন সংন্থা কোন পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হিসাব করেছে তা অবিশ্যি আলেচনার বিষয়। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে একটি চুক্তি করেছে। ওই চুক্তির প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় ও স্থিতি নিয়ে আগামী তিন বছরের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। ব্যাংকগুলো নিজ অবস্থান থেকে কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমাবে, এর ঘোষণা সেখানে দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগামী তিন বছরে খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা কমিয়ে আনার রূপরেখার মধ্যে চলতি অর্থবছরে করা হবে ১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ টাকা খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। ব্যাংকগুলোর মতে, খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধির কারণে মূলধন সংকট সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মূলধন পর্যাপ্ততার হার সঠিক পর্যায়ে রাখা যাচ্ছে না। এর আগের তিন বছরে (২০১৭-২০১৯) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়েছে ৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকিং খাতে বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক প্রভাব রয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে।
তবে আর্শ্চয বিষয় হলো আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পাঁচ কার্যদিবসের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এই নীতিমালা জারি করে এবং নীতিমালায় খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে যার ফলে ব্যাংক মালিকেরাই এখন ঠিক করবেন তারা ঋণ খেলাপিদের কী সুবিধা দেবেন। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন যা নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। নতুন নির্দেশনা মতে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবে। এর আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ জমা দিতে হতো। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় পেলে এখন ৫ থেকে ৮ বছরে সময় পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে নতুন করেও ঋণ পাওয়া যাবে। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংক মালিকদের হাতে খেলাপি ঋণ সুবিধার ক্ষমতা থাকলেও জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, ও প্রতারণার ঋণ নতুন নীতিমালার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না। একটি ঋণ চার অর্থবছর পর পুনরায় একবার নিয়মিত করতে পারবে। জানা গেছে, করোনার কারণে দেওয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, নতুন করে অনেক ঋণ খেলাপি হয়েছে, পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এ কারণে এখন ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ গবেষকদের মন্তব্য হলো খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ করা ভালো তবে এটি অর্জন করতে পারলে পুরস্কার আর না হলে তিরস্কারের বিষয়টিও মনে রাখতে হবে কারন খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক চাপও আসবে, এই চাপমুক্ত থেকে সংন্থাগুলো কাজ করতে পারলে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের মতে ব্যাংকিং খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ। এই ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগামী দিনে খেলাপির পরিমাণ যাতে না বাড়ে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে ব্যাংকগুলোয়। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমাতে হলে সুশাসন বাড়িয়ে দুর্নীতি বন্ধ করে প্রতিটি ঋণ যথাযথভাবে যাচাই-বাছাইয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণের মান বাড়াতে হবে। ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের শাস্তির দৃশ্যমানতা এবং স্বচ্ছতাই ঋণ খেলাপি হ্রাসের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে বলে তাদের মতামতে উঠে আসে। তারা আরও বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন মাস অন্তর খেলাপি ঋণের যে হিসাব তৈরি করে, তাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। এর সঙ্গে অবলোপন করা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এছাড়া পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে আছে বিপুল অঙ্কের ঋণ। এর বাইরেও আছে লাখ কোটি টাকার মতো মেয়াদোত্তীর্ণ ও স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) ঋণ, যেগুলো খেলাপির পূর্ব ধাপে রয়েছে। তাই সরকারের মহতি প্রচেষ্ঠার সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায় এ দেশের ১৭ কোটি মানুষ এবং ব্যাংকিং খাত উন্নয়নের সোপান দেশ ও দেশের বাহিরে।
গত ৮ই অক্টোবর, ২০২১ গণমাধ্যম প্রতিবেদনে প্রকাশিত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২-২০২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে দেশের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা)। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২,৯২৮ ডলারের বিপরীতে ২০২৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট ও গ্লোবাল হেড অব রিসার্চ বলেন, ‘যখন বিশ্বব্যাপী পুনরুদ্ধারের গতি এবং সরবরাহ অত্যন্ত অসম রয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশ ২০২০ সালে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। জোরদার টিকাদান কর্মসূচি এবং কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এলডিসি থেকে দেশের উত্তরণে প্রত্যাশিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি আরও বেড়েছে। এই সময়ে আর্থিক খাত এক সহযাত্রি হিসাবে এগিয়ে আসবে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।