বোরো ধানে ফলন বিপর্যয়

জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড: মিহির কুমার রায়: বিগত ২৪ জুলাই রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২’ উদযাপন এবং ‘জাতীয় মৎস্য পদক-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বলেন আমাদের যে চাহিদা সে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি মাছ এখন উৎপাদন করতে হবে যদিও মিষ্টি পানির মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন,  সবচেয়ে নিরাপদ পুষ্টি পাওয়া যায় মাছ থেকে যা মাংস থেকে হয় না। মাছের যে আবাসস্থল অর্থাৎ অভয়ারণ্য তৈরি করা- এগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পানির প্রবাহটা ভালো থাকা,  পানি যাতে দূষণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। আমাদের যে চাহিদা সে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি মাছ এখন উৎপাদন করতে পারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশ গড়ে তুলেছিলেন উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, জাতিসংঘ তখনও সমুদ্রসীমা আইন করেনি,  জাতির পিতা করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে ‘নিরাপদ মাছে ভরব দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’  প্রতিপাদ্যে দেশব্যাপী জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশের মানুষকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করাই এবারের লক্ষ্য। মৎস্য চাষে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখ করার মতো এবং বিশ্বের যেসব দেশে মৎস্য উৎপাদনের হার বাড়ছে,  সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। নতুন জাত উদ্ভাবন ও মৎস্য চাষে বাংলাদেশে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে এক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টা, উদ্যোগ,  মৎস্য গবেষক ও মাছ চাষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অসামান্য ভূমিকা এখানে কাজ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন যা ২০১৯-২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টনে। হিমায়িত খাদ্য ও চিংড়ি রফতানি থেকে প্রতিবছর  আমাদের আয় বাড়ছে বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদনে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল উল্লেখযোগ্য। সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে।

মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ৫.৭৪ শতাংশ, জিডিপিতে এ খাতের অবদান ৩.৫৭ শতাংশ এবং মোট কৃষি জিডিপিতে তা ২৬.৫০ শতাংশ। মাছ ও মাছজাতীয় পণ্যের রফতানির পরিমাণ মোট রফতানি আয়ের ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশবান্ধব নতুন মৎস্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রচারের মাধ্যমে সরকার টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনার জন্য ফলাফলভিত্তিক বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সরকারের মৎস্যবান্ধব কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ফলে মাছ উৎপাদন ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মোট উৎপাদন (৩.৬মিলিয়ন টন) থেকে ২৭ শতাংশ বেশি। বার্ষিক মৎস্য দর দামের স্থিতিশীলতাই বলে দেয় মৎস্য চাষে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং কোন কোন মাছ দেশে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৬০ গ্রামের বিপরীতে ভোগ ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। মাছ ও মাছজাতীয় পণ্য বাংলাদেশের অন্যতম রফতানি পণ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএসএ, জাপান,  রাশিয়া,  চীনসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের মাছ ও মাছজাতীয় পণ্য রফতানি হচ্ছে। বর্তমানে ১০৫টি মৎস্য  প্রক্রিয়াজাত প্লান্টকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩টি ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানির জন্য অনুমোদিত। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ হিমায়িত ও তাজা মাছ রফতানি করে ৪৭৭ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। গত কয়েক দশকে চাষ করা মাছ এবং এক দশকে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনুকরণীয়। কিন্তু নদীর নাব্যতা হ্রাস, দূষণ,  হাওর-বাঁওড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর সংকোচন, দখল,  অপ-উন্নয়ন ও জীব বৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ার মতো ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে মাছ ধরা এবং চাষের সঙ্গে জড়িত বিপুল পেশাজীবীর আর্থিক ও পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত,  যা এই অগ্রগতিকে হুমকিতে ফেলতে পারে। দেশে এখন প্রায় চার কোটি লোক মৎস্য খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। লাভজনক হওয়ায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান মৎস্য চাষে এগিয়ে এসেছে। মৎস্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বের অনুপ্রেরণা এখন। ভালো ব্যবস্থাপনা এবং মৎস্য বিজ্ঞানী,  মৎস্য অধিদপ্তর ও জেলেদের নিরলস পরিশ্রম, ত্যাগে এটা সম্ভব হয়েছে। হাওর-বাঁওড়, অন্যান্য জলাশয় ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন,  দূষণ রোধ এবং জাতীয় আয়ে মৎস্য খাতের বিপুল অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে জেলেদের জীবন মান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। তবেই এ অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব। পৃথিবীর প্রায় ৫২টি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে বিভিন্নভাবে মাছ রফতানি হচ্ছে। এটি আরো বাড়িয়ে তুলতে নিরাপদ মাছের সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই। ভুলে গেলে চলবে না,  চিংড়ি মাছে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যাওয়ায় ইউরোপে এর রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে মৎস্য চাষ এবং বাজারজাত করতে হবে। নিরাপদ মাছের সরবরাহ নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিক কিছু প্রটোকল রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশও অনুসরণ করতে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যৌথভাবে প্রণীত ‘কোড অব প্র্যাকটিস ফর ফিশ অ্যান্ড ফিশারি প্রডাক্টস’ শীর্ষক একটি বিস্তারিত প্রটোকল রয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে ২০২০ সালে এটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। এতে মাছের পোনা উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত,  বাজারজাত ও ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত কীভাবে মৎস্য অনিরাপদ হতে পারে এবং এখান থেকে পরিত্রাণে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রাকৃতিক মাছের দূষণ রোধ, নিরাপদ প্রক্রিয়াকরণ, রফতানি,  স্থানীয় বাজারজাত, পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন রয়েছে। বাংলাদেশ এখনো এ গাইডলাইন পুরোপুরি অনুসরণ করছে না, এতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মাছ অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। এর কিছু প্রাকৃতিক,  আবার কিছু কৃত্রিমভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে মাছে সিসা সহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি মিলছে। শুধু তা-ই নয়, মাছ চাষে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে এসেও মাছ  অনিরাপদ হয়ে উঠছে ভেজাল ও কেমিক্যাল ব্যবহার করায়। এক্ষেত্রে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক মাছের খাবার ও বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে। মাছ থেকে শুরু করে বাজারজাত ও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে হবে,  যা বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা যৌথভাবে প্রণয়ন করেছে। সারা বিশ্ব এটি মেনে চলছে,  যদিও উন্নত দেশগুলোয় নিজ নিজ প্রটোকল রয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে, এবারের মৎস্য সপ্তাহ পালনের মধ্য দিয়ে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় মৎস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত এবং বাজারজাতে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ‘কোড অব প্র্যাকটিস ফর ফিশ অ্যান্ড ফিশারি প্রডাক্টস’ বাংলাদেশে অনুসরণে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।

বাংলাদেশে হ্যাচারিতে মাছের পোনা উৎপাদনের কৌশল ষাটের দশকে প্রথম চীন থেকে আসে। হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি ছাড়াও পর্যায়ক্রমে চীন থেকে দ্রুত বর্ধনশীল মাছের প্রজাতি যেমন—সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প,  মিরর কার্প ইত্যাদি মাছ আমদানি করা হয়েছে। এসব মাছ আমাদের দেশের জলবায়ুতেও দ্রুত বর্ধনশীল। পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষাবাদের ক্ষেত্রেও চীনের সাফল্য আশাব্যঞ্জক। মাছের রোগ বালাই দমনের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাসায়নিক দ্রব্যের পাশাপাশি ভেষজ ওষুধ  চীনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে তারা সুফলও পাচ্ছে। বাংলাদেশও ভেষজ ঔষধি গাছে সমৃদ্ধ। মাছের রোগ বালাই দমনে এসব ঔষধি গাছ ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়ে কার্যকর গবেষণা প্রয়োজন।

মাছের উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করতে, পাশাপাশি বর্তমান সরকারের আমার গ্রাম, আমার শহরের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ‘হালইসার’ গ্রামকে ‘ফিশার ভিলেজ’ বা ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করেছে। এছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় ১০০টি মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠা ও ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। মাছের মান নিয়ন্ত্রণে দেশে তিনটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে। জনবহুল বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে কল-কারখানার বর্জ্য,  ফসলি জমিতে কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নদী দূষণ এবং অতিরিক্ত মাছ আহরণসহ নানা কারণে দেশী মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক প্রজাতি হুমকির মুখে রয়েছে। এ থেকে উত্তরণে কার্যকর দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: গবেষক ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)