অভ্যুত্থানের এক মাস
সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে
ড. মুশতাক খান: ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্টে যে স্রেফ গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। এটাকে আমি গণজাগরণও বলব। দেশের সব মানুষের সামনেই ভালো দেশ গড়ার একটি সুযোগ এসেছে। এ রকমটা আগে তেমন দেখিনি, এটা নতুন ঘটনা। এ গণ-অভ্যুত্থান ও গণজাগরণের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে।
প্রথমত, টানা তিনটি বিকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে সম্পূর্ণ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের ধারণাই ছিল না মানুষের আকাঙ্ক্ষা কী, প্রত্যাশা কী। তারা উন্নয়নের একটি বয়ান সৃষ্টি করেছিল যাতে তাদের সমর্থক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ অনেকেরই বিশ্বাস ছিল। তারা বলতে শুরু করেছিল, বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন চায়, গণতন্ত্র চায় না। উন্নয়নের সংজ্ঞায়ন তারা নিজেদের মতো করে নিল। উন্নয়ন হচ্ছে আমরা বড় বড় ব্রিজ, রাস্তা বানাব। ১ টাকার জিনিস ১০ টাকায় বানাব এবং ওই বাড়তি টাকা বিদেশে পাচার করব। একের পর এক ব্যাংক লুট করে যাব, কেউ কিছু বলবে না। ব্যাংক ফতুর হয়ে যাক, রিজার্ভ খালি হয়ে যাক, কেউ কিছু বলবে না। কিছু লোক জাদুর কাঠি পেয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাক। দেশে বিলিয়নেয়ার হন বা বিদেশে বিলিয়নেয়ারের খাতায় নাম লেখান, কেউ কিছু বলবে না। নতুন কর্মসৃজন প্রয়োজন নেই, কোনোমতে বেঁচে থাকাই এ দেশের মানুষের নিয়তি—এভাবেই চলছিল দেশ। নতুন খাত সৃষ্টি, নতুন কর্মসংস্থান সৃজন ছাড়াই বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণকে উন্নয়ন বলে চালিয়ে দিয়েছে বিগত সরকার। অদ্ভুত এক উন্নয়নের বয়ান তারা সৃষ্টি করেছিল এবং তারা এতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। অনেক বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও শিক্ষক এ গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। আমরা অল্প কিছু লোক এর বিপরীত ধারায় কিছু কথা বলেছিলাম। কিন্তু সেটার কোনো প্রভাব পড়েনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি, গণতন্ত্র ছাড়া যে এ দেশে উন্নয়ন সম্ভব না সে সময় কাউকে বোঝানো যেত না। উন্নয়নের প্রভাব মানুষের কাছে না গেলে যে তা প্রকৃত উন্নয়ন হয় না তারা সেটা বুঝতে চাইত না। ব্যক্তি খাতের বিকাশ না করে, কর্মসংস্থান না বাড়ানোর মাধ্যমে অদ্ভুত ওই উন্নয়ন চলছিল। ঢাকায় পড়াতে এসে বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে শুনতাম, তারা দেশে চাকরির সম্ভাবনা দেখছে না। তারা বিদেশে চলে যেতে চায়, কীভাবে যাবে, কী করবে এ নিয়ে ছিল তাদের চিন্তা। বাংলাদেশে নবীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য, ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেক বা সাড়ে আট কোটি মানুষের বয়স ২৬ ও তার চেয়ে কম।
আপনার উন্নয়ন মডেলে কোনো কর্মসংস্থান নেই, আপনি কীভাবে টিকতে পারেন? আপনার পক্ষে ক’দিন টেকা সম্ভব? একটা গণবিস্ফোরণের সব উপাদান প্রস্তুত ছিল। কোত্থেকে তা স্পার্ক করবে সেজন্য অপেক্ষা ছিল। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গেমটা ছিল বিপরীতমুখী কথা বলে ভারত ও চীনকে খুশি রাখা। আপাতদৃষ্টিতে চীন ও ভারত উভয়ই শেখ হাসিনা সরকারের ওপর সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে এশিয়ার দুই সুপারপাওয়ার বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। একপর্যায়ে গিয়ে দুপক্ষের স্বার্থের সংঘাত হতে বাধ্য ছিল। জুনে শেখ হাসিনার চীন সফরেই তার সূত্রপাত হয়ে গেল। ২০২৪-এর বিতর্কিত নির্বাচন শেষে এক মাসের ব্যবধানে দুবার ভারত সফরে গেলেন, বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও নিয়ে এলেন। সেখান থেকে গেলেন চীন সফরে। তখন বাংলাদেশ সরকারের অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। চীনের কাছে চাইলে তারা জানিয়ে দিল প্রত্যাশিত টাকা তারা দেবে না। এতে নির্ধারিত সফরসূচির একদিন আগেই দেশে ফিরে এলেন শেখ হাসিনা। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে হইচই পড়ে গেল এবং সেখান থেকেই কিন্তু বড় সংকটের সূত্রপাত বলা যায়।
এমনিতেই নানা সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছিল বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন গ্রুপ থেকে নানা আন্দোলন সৃষ্টি হচ্ছিল। ব্যাংক খাত নাজুক, রিজার্ভ দিন দিন কমছিল। এর মধ্যে চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন চেয়েও পেল না। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মানুষ বের হতে শুরু করবে—এ ভয়ে ছাত্রদের অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সহিংস হস্তক্ষেপ করে সরকারি বাহিনী ও সরকার সমর্থকরা। শেখ হাসিনা এতদিন যেভাবে সরকার চালিয়েছেন তার প্রকৃতি ছিল অনেকটা এমন—আমাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। আমি সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনকালে মূল কৌশলই ছিল বিরোধীদের ভেঙে দেয়া, বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে, কঠোর দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিল তারা। বিরোধীরা যখনই আন্দোলন করেছে, চরম হিংস্রতার সঙ্গে তা দমন করা হয়েছে। এমনভাবে আন্দোলন দমন করে তারা অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনও একইভাবে দমন করতে চেয়েছিল সরকার। এবার মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তারা দেখতে পায়, বেঁচে থাকাও মরণ এবং মরণ তো মরণই। সরকার যতই দমন-পীড়নের পথে এগোয় ততই মানুষ রাস্তায় নামে। এ রকম প্রতিক্রিয়ার কথা সরকার কখনো ভাবেনি। এটা যেহেতু কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হচ্ছিল না সেজন্য তারা আরো ঘাবড়ে গিয়েছিল। কোনো দলের নেতৃত্বে আন্দোলন হলে সে দলকে তো দমন করা যায়। সাধারণ ছাত্র, সাধারণ মানুষ নেমে এসেছিল। স্কুলের ছাত্র থেকে মাদ্রাসার ছাত্র কেউ বাদ যায়নি, তারা রাস্তায় নেমেছে, প্রাণ দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত অভিভাবকরাও বেরিয়ে এল, দোকানদার, শ্রমিক বেরিয়ে এল। একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেল।
২০২৪ গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে ওই কারণগুলো ভূমিকা রেখেছে। ১৫ বছর যে উন্নয়নের ন্যারেটিভ ছিল তা সবার কাছে পৌঁছেনি। হাতেগোনা কিছু লোক প্রভূত সম্পদের মালিক হলো কিন্তু সাধারণ মানুষ সাধারণই থেকে গেল, তার কোনো উন্নতি হয়নি। বিশাল সংখ্যক তরুণ দেশে চাকরি পাচ্ছেন না। ভাগ্যের সন্ধানে বিদেশই ছিল গন্তব্য। আবার বিদেশে যাওয়ার পথেও তাকে পদে পদে ঠকানো হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে হাতেগোনা কিছু লোকের বাপের সম্পত্তি বানানো হয়েছিল। সব প্রতিষ্ঠানকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ সব জায়গাতেই পচন ধরেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মানুষ তখন বুঝতে পারে তাদের কেউ হাতে তুলে গণতন্ত্র দেবে না, সুশাসন দেবে না। নিজেদেরই যে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে সেটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি উপলব্ধি।
৫ আগস্টের পর সপ্তাহব্যাপী কিন্তু ছাত্ররাই দেশ চালিয়েছে। তারা রাস্তা পরিষ্কার করেছে, ঝাড়ু দিয়েছে, সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে, চুরি-ডাকাতি ঠেকিয়ে দিয়েছে। এই যে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে সে মনোভাব থেকে সংস্কার সম্ভব। সবকিছু সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো সম্ভব। এই যে অতিপ্রয়োজনীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান; পুলিশ, আদালত, বিচার ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোনোটিই ঠিকমতো কাজ করছে না। সব জায়গাতেই সমস্যা, কোনটি নিয়ে কাজ করবেন—এটি চিহ্নিত করাই এ সময় চ্যালেঞ্জ। সংবিধান থেকে শুরু করে পিয়ন কীভাবে নিয়োগ দিতে হয়—সবকিছুই ঠিক করতে হবে। কর্তৃত্ববাদী সরকার সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আমরা যদি এখন সবকিছু একসঙ্গে ঠিক করতে চাই তাহলে কিন্তু হবে না। এটাই হচ্ছে এ সময়ের আলোচনার বিষয়বস্তু। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকারকে ছাত্র-জনতা বসিয়েছে তা একটি উত্তম সরকার বলে মনে করি। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে যে টিম গঠন হয়েছে—বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো টিম বলে মনে করি। তারা প্রত্যেকেই দেশের ভালো চান। কিন্তু তাদের কাছে কিন্তু সব সমস্যার উত্তর নেই। আমাদের কাছ থেকেই সেসব প্রশ্নের উত্তর আসতে হবে এবং তা আসতে হবে গঠনমূলকভাবে ও ইতিবাচকভাবে। আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে গঠনমূলকভাবে তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে হবে। আমরা আশা করি, তারা সর্বস্তরের নাগরিকদের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত প্রস্তাব শুনবেন।
বাংলাদেশের এ ক্রান্তিকালে একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। আমরা যদি এ সুযোগ নিতে পারি তাহলে অনেক দূর এগিয়ে যাব। আবার যদি মিস করি, আমাদের কেউ ক্ষমা করবে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে না। ৫ আগস্টের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আর নেই। কেউ কেউ বলছেন এবং আমি তাদের সঙ্গে একমত, এটা একাত্তরের চেয়েও বড় ঘটনা। একাত্তরে আমরা অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে দেশ গঠন করেছিলাম। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রসহ বিভিন্ন চমৎকার প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু কিছু পাইনি। এখন সব কিছু মেরামতের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা চমৎকার। বৈষম্যহীন সমাজ মানে কী? এই যে আমরা বিশ্ব অর্থনীতিতে কাজ করছি এখানে পুঁজিবাদ হচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে বৈষম্যহীন অর্থ হলো, চাকরির ব্যবস্থা তথা কর্মসংস্থান, এসএমই ও মধ্যম শ্রেণীর ব্যবসা প্রসারিত করা, অলিগার্কদের ক্ষমতা ভাঙা, গণতন্ত্র কার্যকর করা। এ আলোচনা বাংলাদেশে কোনো দিন হয়নি। এ নিয়ে আমরা কথাই বলিনি। সংবিধানে বলা আছে, আর আমরা ভুলে গেছি।
আসলে এ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে এখনই দেশ গঠনের প্রকৃত সুযোগ। কারোরই একে হালকাভাবে নেয়া বা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। গড়পড়তা ধারায় পড়ে যাওয়া উচিত হবে না। এ প্রক্রিয়া কয়েক বছর চলবে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এক নতুন বাংলাদেশ বের হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বর্তমানে সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কাজ করা দরকার তা হলো, সংগঠনগুলোকে উন্নত করতে হবে। এতদিন যারা বিরোধী দলে ছিলেন, তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে দল ঠিক করার। দল ঠিক না থাকলে কেউ দমন করতে এলে তা রোধ করা সম্ভব হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নকে শক্ত করতে হবে। এ সাংগঠনিক কাজটিই হচ্ছে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ভিত্তি। আর এ ভিত্তি যদি ঠিক করা যায় তাহলে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভালো হবে, তথা ক্ষমতা বিস্তৃত হবে। আর সেটিই হবে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের গ্যারান্টি। তাই সামাজিক চুক্তি না ভেবে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভাবা উচিত। রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে ইমারত ধরা হলে ইট হবে সংগঠন। সেজন্য সংগঠনগুলোকে শক্ত, গণমুখী, জবাবদিহিমূলক করতে হবে।
এক্ষেত্রে দুটি কাজ একই সঙ্গে করতে হবে। আমরা যখন প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ করি, তখন একদিকে থাকে প্রতিষ্ঠান যার অর্থ নিয়মকানুন। যেমন সংবিধান, আইন, যেকোনো অধ্যাদেশ একটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো সব নিয়মকানুন। অন্যদিকে থাকে সংগঠন যাকে নিয়মকানুনের বাইরে আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান হিসেবেই আমরা চিহ্নিত করে থাকি—রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, ব্যবসায়ী সংস্থা। আমরা নিয়মকানুন বা আইন করে দিলাম কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান যদি তা না মানে তাহলে কোনো লাভ হবে না। এক্ষেত্রে এমন একটি জায়গায় আসতে হবে যেখানে আইন হবে প্রতিষ্ঠানের উপযোগী। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তা কার্যকর করবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রতিষ্ঠানের লাভজনক হওয়া জরুরি। প্রতিষ্ঠান যদি অনুৎপাদনশীল বা দুর্বল হয় তাহলে সেটি আইন ভেঙেই লাভ করার চেষ্টা করে। যেমন ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত না দেয়া। এ অবস্থায় যখন একটি প্রতিষ্ঠান আইন মানে না, এর পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানও আর আইন মানতে চায় না। তখন এ ধরনের দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো একে অন্যের সহযোগী হয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে লেনদেন চালিয়ে যায়। একে অন্যের ওপর চাপ প্রয়োগ করে কাজ সম্পূর্ণ করে, কেউ আদালতে যায় না। এভাবেই সবাই আইন ভেঙে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা চলমান রেখেছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সবার আগে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসার কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। তাদেরকে উৎপাদনশীল করতে হবে। তারাই তখন চাইবে যে আইন মানা হোক। কারণ তাহলে হাতেগোনা কাউকে দিয়ে কেউ কাজ করিয়ে নিতে পারবে না। আইনের শাসন তখনই প্রতিষ্ঠা পায় যখন উৎপাদনশীল সংগঠনের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যায়। আমরা সে জায়গায় এখনো যেতে পারিনি।
এ অবস্থায় ক্ষমতার পৃথকীকরণও কঠিন। ধরুন আমরা একটি সংবিধান লিখলাম যেখানে আগের সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো থাকবে না। বিচার বিভাগের নিয়োগ বিচার বিভাগ থেকেই দেয়া হবে, প্রধানমন্ত্রীর এখানে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দল একই থেকে গেল, পেটোয়া বাহিনীর দল। তাহলে কি কেবল সংবিধান সংশোধন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠান পাবে? রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধর কেউ যদি বিচারপতিকে বলে দেয় অমুককে নিয়োগ দিতে হবে, তা প্রতিহত করা যাবে কি? বাস্তবে ক্ষমতার পৃথকীকরণ করতে চাইলে অনেকগুলো ক্ষমতার কেন্দ্র থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি সাংবিধানিক নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো চাপ প্রয়োগ করেন তাহলে তা প্রতিহত করতে অন্য আরো ক্ষমতাসম্পন্ন জায়গা থাকতে হবে, যারা কাজটি হতে দেবে না। ক্ষমতার বিন্যাস যদি সাংঘাতিকভাবে কেন্দ্রীভূত থাকে, তাহলে আইন যা-ই হোক তা কার্যকর হবে না। আইন আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমান্তরালে আনতে হবে। আইন বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ব্যাপকতর করতে হবে। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাইলে কেবল নিয়মকানুনে জোর দিলেই হবে না। যেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মকানুনগুলো কার্যকর হবে সেগুলোর ওপরও নজর দিতে হবে, যেটা আমরা করি না। আর প্রতিষ্ঠান যে নিয়মকানুন মানবে তা নিশ্চিত করা কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কাজ নয়। এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। আমার গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান আইনকানুন মানে সেটি ৯৯ শতাংশ সম্ভব হয় পাশের প্রতিষ্ঠানের চাপে আর ১ শতাংশ কার্যকর হয় ওপর মহলের নজরদারিতে। কারণ আমি ট্যাক্স দিচ্ছি কিনা সেটি দেখতে হবে আমার সঙ্গে যারা লেনদেন করে তাদেরই। এটি পুলিশ প্রশাসনের কাজ নয়। আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো করে না পড়াই তাহলে প্রথমেই চাপ আসতে হবে আমার সহকর্মী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে, উপাচার্য থেকে নয়। এটাকে বলে পর্যায়ক্রমিকভাবে নজরদারিতে রাখা। সুতরাং সবার আগে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা বলি নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি। বিরোধী দল যদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্ত হতো তাহলে এভাবে অস্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হতো না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন।
সূত্র: বণিক বার্তা
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//