মিহির

উচ্চশিক্ষা

ছাত্ররা আন্দোলনে, শিক্ষকরা পদত্যাগে- শেষ কোথায় 

ড: মিহির কুমার রায়: সরকারী চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে কতজনের স্বচ্ছ ধারনা রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অথচ, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সকল স্তরের ছাত্র ছাত্রী বুঝে হউক আর না বোঝে হউক আন্দোলন করে বিগত ৫ আগষ্ঠ তারিখে একটি গনতন্ত্রিক সরকারকে হঠিয়ে বিগত ২৫ শে আগষ্ঠ ১৭ সদস্যবিশিষ্ঠ একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার সুযোগ করে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, যেহেতু এটি কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, সেহেতু শেষ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা তাদের রয়েছে। কাজেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেই নির্বাচনে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি। এজন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো দেশে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যা বিগত এক-দেড় দশকে একেবারে ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রহীনতা ও দুর্নীতি দেশে যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে; ধর্মাধর্মের বিভেদের কারণে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হয়েছে, তার নিরসন ও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। এসব কাজ রাজনৈতিক সরকার করার মতো পরিবেশ দেশে কবে তৈরি হবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কাজেই এর যতটা করা সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই করতে হবে। সেজন্য অবশ্যই তাদের সময় প্রয়োজন। কারন এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত।

এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষা খাতে (উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা) ধস নেমেছে যা এর আগে কল্পনা করা যায়নি। উচ্চ মাধ্যমিকে ৭ টি বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরি আন্দোলন শুরু হয় এবং ছাত্রদের দাবির কারনে কতৃপক্ষ বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিল করে দেয়। এতে ছাত্রদের মধ্যে এক অনিশ্চয়তার সৃষ্ঠি হয় যা এখনও কাটেনি। এখন আসা যাক উচ্চশিক্ষার বিষয়ে যা আরও মরমান্তিক। ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মুখে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য (ভিসি), সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করছেন। তাঁরা সবাই বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া। এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না। নতুন নিয়োগও দেওয়া শুরু হলেও তা কবে সকল নিয়োগ প্রকৃয়া শেষ হবে তা সময়ই বলে দেবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের সংকটের বড় কারণ দলীয়করণ। বিগত সরকারগুলোর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষস্থানীয় পদে দলীয় আনুগত্য রয়েছে, এমন শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবসময় দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনও এই সুযোগে ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে প্রভাব বিস্তার করে। এমন পরিস্থিতির ভুক্তভোগী হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি। বাকি ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সরকার বিদায়ের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২৫ জন উপাচার্য, ১২ জন সহ-উপাচার্য এবং ৭ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছ। এরি ধারাবাহিকতায় আরও দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (অধিভুক্ত কলেজসহ) ৪৪ লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না। নতুন নিয়োগও কেবল শুরুর কাজ চলছে। সরকার পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রশাসনকে দলীয়মুক্ত করার দাবিও তুলছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের ১১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি সরকারি কলেজ ও ৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান সংকটের বিষয়টি সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সংবাদ সম্মেলনেও উঠে এসেছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ৪৫টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় এখন অভিভাবকহীন। শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনিক দিক দিয়ে সবার কাছে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এর পর যত দ্রুত সম্ভব অন্তত প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ দলীয়ভিত্তিক প্রশাসন চান না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

বর্তমানে ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর মধ্যে অন্তত ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত তিন মেয়াদে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে কোনো প্যানেল নির্বাচন হয় না। সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময় নিয়োগ, জমি অধিগ্রহণ সহ নানা বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের আত্মীয় স্বজনের নিয়োগ নিয়ে নানা অনিয়ম হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ উচ্চশিক্ষায় নানামুখী সংস্কারের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে শিক্ষকদের একটি মোর্চা। ওই আলোচনায় উঠে আসে সব স্তরে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে উদার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মতো চলতে দিতে হবে। প্রশাসনের পদে থাকা শিক্ষকদের সমিতির নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে না রাখার প্রস্তাবও করা হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন পদ্ধতি ঠিক করে গণতান্ত্রিক উপায়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এখানে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকবে না। যেখানে শিক্ষকেরা ক্লাস-গবেষণাগারে সময় পার করার কথা, তাঁরা সেটা না করে দলীয় স্লোগানে নিজেকে ক্ষয় করছেন। ফলশ্রুতিতে ঘৃণার রাজনীতিতে দলীয় প্রভাব-পদোন্নতির দেখা যেমন মিলছে, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনের জায়গা থেকে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যা এবার ছাত্র বিক্ষোভের সময় আমরা দেখলাম। 

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইনের প্রধান হওয়ায় এ উদ্যোগটি তাঁকেই নিতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা বলে দ্রুততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের রাজনীতিবিদের প্রভুত্ব বন্ধে ‘ক্যাম্পাস রাজনীতি’র প্রতি চিরতরে নিষেধাজ্ঞা জারি তিনিই করতে পারেন, যাতে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনীতি ফেরাতে না পারে। সেটি বন্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত কাঠামো অনুসারে যদি উপাচার্যরা ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁদের আর দল দাসের কোনো সুযোগ থাকবে না, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাষ্ট্রপতি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তিনি প্রয়োজনে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এই মহান কাজটি করতে পারেন। বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা নতুন সরকারের কাঁধে এ দাবিটি তুলে দিয়ে নিজেরা সক্রিয় থেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিতে পারে। অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কেবল ‘ছাত্র সংসদ’সচল রাখতে পারে, যেখানে কোনো প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকবেনা আর রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে সে ভোটাধিকার বা প্রার্থী হতে পারবে না। শিক্ষক সমিতি থাকার প্রয়োজনীয়তাও নেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও অধ্যাদেশ সক্রিয় থাকলে প্রচলিত নিয়মে শিক্ষকদের পদ-পদোন্নতি বাধা হওয়ার সুযোগ নেই। একজন শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো শ্রেণিতে পাঠদান ও গবেষণাগারে গবেষণা করা। এ সুযোগটি সরকারকেই করে দিতে হবে। এ দাবিটি রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকে নয়, বরং হাজার হাজার শিক্ষার্থী মনে–প্রাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতি মুক্ত করতে চায়। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এরি মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু করলেও সাম্প্রতিক বন্যার কারনে তা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আশা করা যায় বর্তমান সরকারের বিশেষত শিক্ষা উপদেষ্ঠা বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবেন এবং ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার পথকে প্রশ্স্থ করবেন।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)