গর্ভবতী মায়ের অপুষ্টি শিশুর মেধা বিকাশে অন্তরায়
আমীর হামজা: গর্ভবতী মায়েদের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মেধা বিকাশে অন্যতম অন্তরায়৷ তেমনি অন্তরায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতায়ও।
বাংলাদেশের পুরো ভূখন্ডের বিশাল এলাকা জুড়ে আছে গ্রামাঞ্চল বা গ্রামীন জনপদ। গ্রামীন জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু আয় তুলনামূলক কম। একটা বড় শ্রেণি পেশার মানুষ আবার দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০২২) তথ্য মতে, দেশের প্রায় ১৮.৭% শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের বেশির ভাগই (পরিসংখ্যান মোতাবেক ২০%) আবার গ্রামে বসবাস করে। যাদের অনেকেরই আর্থিক সামর্থ্য অনেক দুর্বল। গ্রামাঞ্চলে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে৷
১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক আইন পাশ করা হয়। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রাথমিকভাবে ৬৮টি উপজেলায় চালু করা হয় ১ জানুয়ারী ১৯৯২ সালে। আর ১ জানুয়ারি ১৯৯৩ সাল থেকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সারা দেশব্যাপী চালু করা হয়। প্রতি বছর বাৎসরিক বাজেটে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়৷ উদ্দেশ্য প্রাথমিক শিক্ষার সফলতার হার বাড়ানো৷ শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়মূখী করা। ঝড়েপড়া রোধ করে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার জন্য উপযোগী করা৷ ঝড়ে পরা রোধ প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে মূলত আর্থসামাজিক কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায় থেকে ঝরে পরে। ইউনিসেফ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পরার হার গড়ে ৩.১% জন। তবে কভিড-১৯-এর যুক্তিক কারণে এ হারটা তুলনামূলক বেড়েছে।
ঝড়ে পরার পেছনে অন্যতম একটি কারন শিশুর পরিপূর্ণ মেধার বিকাশ না হওয়া৷ শিশুর মেধায় দুর্বলতার কারনে তাদের নিকট পাঠ কঠিন মনে হয়৷ প্রাথমিক শিক্ষাচক্রের বিশেষ সময়ে (৪র্থ/৫ম শ্রেণি) শিক্ষার্থী যারা মেধায় তুলনামূলক খুবই দুর্বল তাদের মস্তিস্কে পাঠ বোধগম্য হয়না৷ তারা হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে৷ অবশেষে একটা সময়ে নিরুৎসাহিত হয়ে ঐ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসতে চায়না৷ অভিভাবকদের চাপে পড়ে অনিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে আসে৷ একটা সময় বিদ্যালয়ে আসা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। পড়াশোনা থেকে পুরোপুরি নিজেকে সরিয়ে নেয়৷
শিশুর মেধা বিকাশে মায়েদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ মায়ের গর্ভাবস্থায়ই শুরু হয়। সাধারণত মায়ের গর্ভাবস্থায় বাচ্চার মস্তিস্কের শতকরা পঁচিশ ভাগের (২৫%) উন্নয়ন ঘটে থাকে। সে জন্য পুষ্ট মেধার শিশুর জন্য দরকার গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিকর খাবার দাবার৷ গ্রামাঞ্চলের দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা পরিবারের পক্ষে গর্ভবতী মায়েদেরকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর সামর্থ্য থাকেনা৷ সরকারের পক্ষ থেকে গরীব গর্ভবতী মায়েদের জন্য তিন বছরে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা করে দেয়া হয়৷ দরিদ্রের কষাঘাতে চলতে থাকা পরিবারের অন্যসব মৌলিক প্রয়োজনে খরচ হয়ে যায় সরকারিভাবে প্রাপ্ত ভাতার অর্থ৷ গর্ভবতি মায়ের মুখে জুটেনা কোন পুষ্টিকর খাবার৷ দরিদ্র পরিবারের গর্ভবতী মায়েরা ভুগে থাকে অপুষ্টিতে৷ তাদের গর্ভ থেকে জন্মনেয়া শিশুরাও ভুগে অপুষ্টিতে। তাদের ব্রেইন তুলনামূলক কম ডেভেলপ করে থাকে। এ ধরণের শতভাগ শিশুই আসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে৷ আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ করতে হয় তুলনামূলক কম মোধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে৷ অনেকটা স্রোতের বিপরীতে দাঁড় টানার মত৷
এ শিশুদের থেকে প্রাথমিক চক্র পেরুনোর আগেই ঝড়ে পরে কিছু শিশু। মান সম্মত শিক্ষক ও অবকাঠামোর পাশাপাশি উন্নত মস্তিকের শিশু ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সফলতা সম্ভব নয়৷ তাই উপযুক্ত শিক্ষার্থী পেতে হলে গর্ভবতী মায়েদের সুনির্দিষ্টভাবে যত্ন নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ তা হতে পারে সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে।
লেখক: শিক্ষক।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//