মিহির

রূপালী ইলিশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্ব

ডঃ মিহির কুমার রায়: ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। একক প্রজাতি হিসাবে ইলিশ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদ। এই মাছ দেশের মানুষের খুবি প্রিয় খাদ্য তথা অগণিত জেলেদের আয়ের উৎস এবং দেশের রপ্তানী আয়ের একটি ক্ষেত্র। দেশের মোট নব্বই লাখ মানুষ জীবিকায়নের জন্য ইলিশ মাছের উপর নির্ভরশীল যার মধ্যে রয়েছে পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৈাকা তৈরী, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরন, রপ্তানি ইত্যাদি। দেশের প্রায় ৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণের সাথে জড়িত। দেশের আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ইলিশের অংশ শতকরা ১৫ ভাগ এবং একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতি বছরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে ৯-১০ শতাংশ হারে। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। একটি তথ্যে দেখা যায় যে, ২০০২-৩ অর্থবছরের যেখানে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার টন যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে দাড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন অর্থাৎ মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে দুই লাখ টনেরও বেশী যা সম্ভব হয়েছে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে।

ওয়ার্ল্ড ফিস এর তথ্যমতে বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৬০ শতাংশ আসে বাংলাদেশ থেকে। এই দেশে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। তারপরও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি নির্বিকারে জাটকা নিধন বন্ধ না হওয়ার কারণে। এই অবস্থা উন্নতিকল্পে সরকার “জাটকা ইলিশ ধরব না, দেশের ক্ষতি করব না” প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রতিবছর ইলিশ রক্ষা সপ্তাহ পালন করছে। গত অক্টোবর মাসের ২২ দিন সরকার ইলিশ মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ করেছিল। এই সময়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে অনেক জল্পনা, কল্পনা রয়েছে। তাদের মতে ছয়টি পূর্ণিমাতে ইলিশ মাছ ডিম ছেড়ে থাকে যার প্রথম পূর্ণিমাতেই ডিম ছাড়ার অংশ সবচেয়ে বেশী বিধায় যা উৎপাদন হলে তা দিয়েই দেশের উৎপাদন টার্গেট পূরণ অনেকাংশে সম্ভব। আবার এই ২২ দিন পর আবার ২ দিন মাছ ধরার সুযোগ দিয়ে ০১ নভেম্বর থেকে জাটকা নিধন অভিযান আগামী ৩০শে জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এই সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ ধরতে কোন প্রকার বাধা থাকবে না। সরকারী পর্যায়ে এই ধরনের উদ্যোগ অত্যন্ত— সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় যার সুফল পেতে আমরা এরি মধ্যে দেখছি। যেমন বিগত কয়েক মাসে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা পর্যায়ে দামও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যা ভোজনবিলাসী বাঙ্গালী মাত্রই খুশী।

ইলিশ ভারতে উপহার হিসেবে যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘এটা রপ্তানি করা হবে। রপ্তানির টাকা বাংলাদেশ সরকার পাবে।’ বিগত সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মুছাপুর রেগুলেটর এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ইলিশ এখনো যায়নি। শুধু একটা সিন্ধান্ত হয়েছে। তার আগেইতো দাম বেড়ে গেছে। কাজেই রপ্তানি হলে দাম বাড়বে এ কথাটা ঠিক না। যেটা সরকারের বিবেচনায় আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা ইলিশটা চাচ্ছে, তারাও কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ওপার (ভারত) থেকে অনেক সমর্থন দিয়েছেন। সেটা আমরা সবাই দেখেছি। আমরা খুব কতগুলো সহজ কথা বলে ফেলি। সবসময় মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশীর সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমাদের আলাপ আলোচনা করতে হবে। আলোচনার সেই দ্বারটা ছোট ছোট বিষয়ে বন্ধ হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই না।’  

এবার অন্যান্য সময়ের মত আসন্ন দূর্গা পূজা আয়োজনে আরও একটি পণ্য যোগ হয়েছে যা হলো ইলিশ মাছ যা বিজয়া দশমীতে রিতি অনুসারে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত; বাঙ্গালী অধ্যুষিত বাংলাদেশ সহ পশ্চিম বঙ্গে। এখানে উল্লেখ্য যে ইলিশ মাছ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং ইলিশ উৎপাদনে পৃথিবীর এক নং অবস্থানে রয়েছে যা জাতীর গর্ব। প্রতি বছর ইলিশ রপ্তাণী করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে যার ব্যতিক্রম এবছরও ঘটেনি যেমন সরকার এই বছর ৩০০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয়েছে যদিও দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হবে না বলে জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা। এটাকে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান বলেও অনেকে ভাবছিলেন। ভারতে ইলিশ না দেওয়ার পক্ষে এটাও বলা হয়েছিল, এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ও দুর্গাপূজা পালন করবে। এ অবস্থায় রপ্তানি হলে ‘দামি মাছ’টি আরও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে দেশে। সরকারের এমন অবস্থানের মধ্যেই অবশ্য ভারতের ব্যবসায়ীরা ইলিশ আমদানির আবেদন জানান। শেষে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানাল, এবারও ৩ হাজার টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি তারা দিচ্ছে।

পাঁচ বছর ধরেই পূজার সময়টায় বিশেষত ভারতীয় বাঙালিদের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ইলিশ ওখানে রপ্তানি হচ্ছে। এটাকে বিগত সরকারের  ‘রাজনৈতিক বিবেচনার প্রকাশ’ বলেও মনে করা হচ্ছিল। ভারতও এতে হয়ে পড়ে অভ্যস্ত। তাই ইলিশ না পাঠানোর পক্ষে যখন অবস্থান নেয় নতুন সরকার, তখন বেশ হতাশার সৃষ্টি হয়, বিশেষত পশ্চিম বঙ্গে। এরই মধ্যে কিছু ইলিশ যে চোরাই পথে যাচ্ছিল না, তা নয়। বাংলাদেশে আহরিত ইলিশ মিয়ানমার হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার ঘটনাও কম নেই। ইলিশে ইলিশে তফাত করা অবশ্য কঠিন। তবু ‘পদ্মার ইলিশ’ নিয়ে ভারতীয় বাঙালিদের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। একটু বেশি দাম দিয়েও, বিশেষত পূজার সময় সেটা কিনতে তারা প্রস্তুত। তবে ওখানে যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ আছে, তারা নিশ্চয়ই ভারতে আহরিত ইলিশ কিনতেও হিমশিম খায়। তাদের সবারই কিছুটা সুবিধা হয় বাংলাদেশ থেকে অন্তত পূজার সময় কিছু ইলিশ গেলে। তাতে উৎসবে দাম আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাটা হয়তো কমে। এবারও সেই সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে না। ভারতের ইলিশ আমদানিকারকেরাও সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে খুশি হবেন। এ ‘সাপ্লাই চেইনে’ অন্তর্ভুক্ত অন্যরাও। ইলিশ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অর্পিতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক বিশুদা নন্দা আচার্জি বলেন, প্রতি কেজি ইলিশের রপ্তানি মূল্য ১০ মার্কিন ডলার,  যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৪৮ টাকা। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের কাস্টম থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ইলিশের এই চালান ছাড় করানো হবে। আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে ইলিশের কদর রয়েছে। আবার রাজনৈতিক অঙ্গনেও উপহার হিসাবে প্রতিবেশীদের বিশেষ করে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে ইলিশের আদান প্রদান হয়। বাঙ্গালীর প্রতিটি ঘরে ঘরে বিজয়া দশমি পাচ দিন নিরামিশ ভোজের পর মাছের অন্নে ইলিশ মাছ না হলেই নয় যার একটি ধর্ম্মীয় বিবেচনা রয়েছে।

এটাও ঠিক, ভারতে রপ্তানি না হলেও ইলিশের দাম কমত না। তেমন কোনো প্রবণতাই নেই বাজারে। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী ইলিশের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়েও বসে আছে। তারা হয়তো এর দাম জানতেও আর আগ্রহী নয়। বরং জানতে চায়—খামারে উৎপাদিত রুই, কই, পাঙাশ, তেলাপিয়া প্রভৃতির দাম কেমন। কিছু ছোট মাছও চাষ হচ্ছে। বাজারে মেলে কিছু সামুদ্রিক মাছও। কিছু আসে ভারত ও মিয়ানমার থেকে। ঘুরে ফিরে এগুলোই দেশের সিংহভাগ মানুষের মৎস্য আমিষের উৎস। তারা হয়তো ভারতে ইলিশ রপ্তানির পরিবর্তিত সিদ্ধান্তে বড়জোর কিছু ‘রাজনৈতিক তাৎপর্য’ খুঁজে পাবে। এরাতো জানে, ভারতে ইলিশ না গেলেও এটা কিনতে পারত না। সুদীর্ঘ সময় ধরে ইলিশ কিন্তু সাধারণভাবে রপ্তানি হচ্ছে না। দেশের চাহিদা মিটিয়ে তবেই রপ্তানি—এ নীতিই চলে আসছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টাও কম চলছে না। তাতে এর আহরণ বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে ইলিশের দাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি এর চাহিদা বেড়ে চলেছে অধিকতর হারে? জেলেদের মজুরি, জ্বালানি ব্যয়, বরফের দাম ইত্যাদি বাবদ ইলিশ আহরণ ব্যয় দ্রুত বেড়ে যাওয়ার যুক্তি অনেকে দিয়ে থাকেন। পণ্যটির বিপণনে হাতবদল বেশি; উচ্চবিত্তরা একবারে অনেক মাছ কিনে ফ্রিজে মজুত করেন—এসব যুক্তিও জোগানো হয়। এর মধ্যে এই প্রশ্নও তীব্র হয়ে ওঠে যে, ইলিশ আহরণ সংক্রান্ত তথ্যটি অতিরঞ্জিত নয়তো?  

ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের রোলমডেল হলেও সামুদ্রীক মৎস্য সম্পদ আহরণে দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। আগামীতে এই অফুরন্ত সম্পদ আহরণ করতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে যদিও ইলিশ সামুদ্রীক ও সমুদ্র উপকূলীয় মাছ প্রজনন মৌসুমে নদীর মোহনায় প্রবেশ করার সময় জাটকা ধরার উৎসব পড়ে যা আইন করে বন্ধ করতে হবে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে। ইলিশ মাছ ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বত্বপূর্ণ উপাদান যার মধ্যে আছে পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানী বাণিজ্য ইত্যাদি। এই ব্যবসায় প্রায় নব্বই লাখ লোক জড়িত। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে ইলিশ উৎপাদন, মৌসুমে (পূর্ণিমা-আমাবস্যায়) ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকায়  ক্ষতিগ্রস্থ জেলেদের সরকার পুনর্বাসনে কর্মসূচি করবে। তবে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তথা গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা সহায়ক হতে পারে। সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকার যদি সচেতন হয় তাহলেই এর উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। জিআই পণ্য হিসাবে ইলিশ নিবন্ধিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর কদর ও চাহিদা আরো বাড়বে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া ইলিশ বিপণনের ক্ষেত্রে স্বত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকে। এর ফলে বর্তমানের চেয়ে ২০-২৫ শতাংশ বেশি দাম পাবে জেলেরা।

অনেকে বলেন, ইলিশ ধরার সাথে জাল, ট্রলার মেরামত, জ্বালানি তেল ইত্যাদি রয়েছে  যেখানে নূন্যতম ৩ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু মাছ ধরতে পাড়া/না পাড়ার সাথে আরেকটি প্রশ্ন জড়িত কিন্তু ‘খরচ মোটামোটি নির্দিষ্ট যেমন মাঝি মাল্লাদের বেতন, আহারাদি, ট্রলার মেরামত। আবার তার মধ্যে রয়েছে ডাকাতদের উপদ্রব এবং প্রতিবেশী জেলেদের অবৈধ অনুপ্রবেশ। তাই ইলিশ ধরার সাথে মালিক পক্ষের দাবি বেশি পরিমাণ নৌবাহিনীর টহল বোট কিংবা কোস্টগার্ড নামানো। তাই বিভিন্ন সংকটে এর রক্ষা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে যদি আরো সচেতন হওয়া যায় তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। একিভাবে ইলিশ অর্থনীতিকে বিকশিত করতে হলে এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত জনমানুষের জীবনাদর্শকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট (এফ.আর.আই) এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া গেছে ১০ শতাংশ বেশী। ওয়ার্ল্ড ফিসের গবেষণায় পাওয়া যায় যে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে ধরা পড়া ইলিশের আকার ২০১৩ সালে যা ছিল ৫০০ গ্রাম ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৬২৮ গ্রাম। দেশে বর্তমান ইলিশের যে প্রবৃদ্ধি তার অর্থমুল্য ৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর রফতানির মাধ্যমে আসে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। মৎস্য বিভাগের সূত্রমতে ২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট ইলিশকে জাটকা বলা হয়। হিসাব মতে প্রতিবছর প্রায় ১১ হাজার ৮০০ টন জাটকা ধরা পড়ে যাদের আকার ১৪-২০ সেন্টিমিটারের মধ্যে যাদের ওজন গড়ে ৩০ গ্রাম। বছরে সে পরিমাণ জাটকা ধরা হয় সেগুলোকে রক্ষা করে যদি ৫০০ গ্রাম করা যেত তাহলে ইলিশ উৎপাদন অনেক বেড়ে যেত। একটি ইলিশ একসাথে সর্বনিম্ন ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম পাড়ে যার ৭৫-৮০ শতাংশ ফুটে রেনু ইলিশ হয় আর ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থেকে ইলিশে রূপান্তরিত হয়। এফ.আর.আই, চাদপুর কেন্দ্র এর একটি গবেষণায় দেখা যায় গত ১-২২ অক্টোবর, ২০১৭ পর্যন্ত ইলিশ শিকার নিধিদ্ধ থাকায় এই সময়ে নদীতে ৪৬.৪৭ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে যা গতবছরের তুলনায় ২.৪৭ শতাংশ বেশী এবং পোনা ছাড়ার সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার কোটি। এর ফলে চলতি বছরে ইলিশ উংপাদন হতে পারে ৬ লাখ টনের বেশী।

রুপালী ইলিশ মাছের বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দেখা যায় ইলিশ মাছ উজান স্রোত বেয়ে খাদ্য ও প্রজননের জন্য সাগর থেকে নদীতে আসে আবার সাগরে ফিরে যায়। ইলিশ মাছের দু’টি প্রজনন মৌসুম যেমন: সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও জানুয়ারী-মার্চ। এই মার্চটির প্রধান প্রজনন ক্ষেত্রটি হলো মেঘনা নদীর মোহনায় হাতিয়া (মৌলভীরচর), সদ্বীপ (কালিরচর), মনপুরা ও ঢলচর অঞ্চল ইত্যাদি। জাটকা ইলিশের প্রধান প্রধান বিচরণ ক্ষেত্রগুলো হলো চাঁদপুরের মেঘনা নদ লিজটিকা হতে লক্ষীপুরের নীলকমল হাজিমারা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী খুলনার কীর্তনখোলা, ইলিশা, তেতুলিয়া, পায়রা বিষখালী, আসগরমানিক ও শিবসা এবং পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা হতে খুলনা জেলার দুবলারচরের উপকূলীয় অঞ্চল। বাংলাদেশ ইলিশ মাছের আহরণ ১৯৯৫ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেলেও তা সহনশীল পর্যায় থেকে শতকরা ৩২ ভাগ আহরিত হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু দূষণ, পলি জমে নাব্যতা হ্রাস, মেঘনা-পদ্মার প্রবাহের হ্রাস, প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট ইত্যাদির কারণে এই প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্থ হয় ক্রমাগতভাবে। আবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে প্রজননের সময় বিধায় এই সময়টিতে ব্যাপকভাবে ইলিশ ধরার ফলে এদের প্রজনন ব্যাহত হয়। আবার ডিসেম্বর - মে মাসের সময় জাটকা ধরার একটা প্রবণতা লক্ষনীয় যা কারেন্ট জালের মাধ্যমে সংগঠিত হয় এবং এর পরিমাণ প্রায় ৩,৪৫৬ টন যা ধরা না হলে বছরে আরও ৩.৫ লক্ষ টন অতিরিক্ত ইলিশ পাওয়া যেতো। এই অবস্থার উন্নতিকল্পে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন উভয়কেই জোরদার করতে হবে। যার অংশ হিসাবে ইলিশের প্রজননকাল ১৫ সেপ্টেম্বর - ১৫ই অক্টোবর সময়ে আমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় মেঘনার মোহনায় চিহ্নিত এলাকায় সাত দিনের জন্য ইলিশ মাছ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। অপরদিকে ইলিশ মাছের প্রজণন ক্ষেত্র ও জাটকার বিচরণক্ষেত্রকে অভয়াশ্রম হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। বর্তমানে বলবৎ নভেম্বর - এপ্রিল মাসের পরিবর্তে নভেম্বর ও মে মাস পর্যন্ত জাটকা ধরা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার আইন বা নবায়নকরণ করা। জাটকা মৌসুমে এই কাজে নিয়োজিত জেলেদেরকে বিকল্প কর্মসংন্থানের ব্যবস্থা করা যাতে তারা প্রতিনিয়ত জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকে। তাছাড়া ইলিশ উৎপাদনের নীবিড় জেলাগুলোতে প্রশাসন, মৎস্য কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, জন প্রতিনিধি, মৎস্যজীবি, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীর সমন্বয়ে ভ্রাম্যমান দল গঠন করে জাটকা নিধন বন্ধ করা। ইলিশ উৎপাদনের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য গবেষণার আলোকে সুপারিশ করা. ইলিশ ব্যবস্থাপনা অ্যাকশন প্লান বা নবায়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে, জাতীয় আয় বাড়বে, আমিষ জাতীয় খাদ্যের যোগান, পুষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংন্থান জোড়দার হবে।

লেখক: প্রফেসর ও গবেষক।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)