আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
ড: মিহির কুমার রায়: বিশ্বের প্রতিটি দেশেই দারিদ্র্য মানুষ কম বেশি রয়েছে এবং এই দারিদ্র্যতাকে বিমোচনের জন্য আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস পালন করা হয়। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের একদল ব্যক্তি ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট ATD ফোর্থ ওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ রেসিনস্কির সাথে দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের সম্মান জানাতে ট্রোকাডেরোতে মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্লাজায় জড়ো হয়েছিল। সেখান থেকেই মূলত আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসের সূচনা শুরু হয়। এরপর রেসিনস্কির মৃত্যুর চার বছর পর, জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ অক্টোবরকে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে মনোনীত করে। অর্থাৎ ১৯৯২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস পালিত হয়ে আসছে।
ইতিমধ্যেই জাতিসংঘ ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসের প্রতিপাদ্য ঘোষণা করেছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ন্যায়, শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অপব্যবহার বন্ধ করা”। যদিও এই দিবসটিকে প্রচারের জন্য ২০০৮ সালে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চরম দারিদ্র্যের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত মানবাধিকার রক্ষকসহ এই বিষয় নিয়ে কাজ করা সদস্যদের নিয়েই মূলত এই কমিটি গঠন করা হয়।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দারিদ্র্যতা। আমরা যদি ২০২৪ সালের ঘোষিত ১০টি দারিদ্র্য দেশের তথ্য পর্যালোচনা করি তাতে দেখা যায় আফ্রিকা মহাদেশে অধিকাংশ দেশই এতে অবস্থিত যার মধ্যে প্রথমে থাকা দক্ষিণ সুদানের মাথাপিছু আয় ৪৫৫.১৬ ডলার এবং দশ নম্বরে আছে পশ্চিম এশিয়ার দেশ ইয়েমেনের মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলার। এই তালিকায় থাকা বাকি দেশগুলো হচ্ছে, বুরুন্ডি, আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গনতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মোজাম্বিক, নাইজার, মালাউই, লাইবেরিয়া এবং মাদাগাস্কার।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ। ইউএনডিপি ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড প্রোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (ওপিএইচআই) যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সাল ছিল যুদ্ধের বছর। এই বছর যতগুলো দেশ যুদ্ধ-সংঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। ইউএনডিপি এবং ওপিএইচআই ২০১০ সাল থেকে দারিদ্র্যের সূচক প্রকাশ করে থাকে। এজন্য ১১২টি দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ৬৩০ কোটি। আর এই গবেষণার জন্য বেশ কিছু সূচক ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাসস্থানের সংখ্যা, বিদ্যুৎ সুবিধা, স্যানিটেশন, ভোজ্যতেল, পুষ্টি ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। নতুন এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ইউএনডিপির মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ ইয়ান চুন ঝ্যাং বলেন, ২০২৪ সালের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) থেকে এই চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, ১১০ কোটি মানুষ এখন চরম দারিদ্র্যের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এছাড়া ৪৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যুদ্ধ ও সংঘাতময় দেশগুলোয় দরিদ্র মানুষেরা মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে করে তারা আরও বেশি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এই গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ১১০টি দেশের প্রায় ৬১০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ চরম এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই ৬১০ কোটি মানুষের মধ্যে এমন ৫৮ কোটি শিশু রয়েছে, যারা চরম দরিদ্র। অর্থাৎ বিশ্বের মোট শিশুর প্রায় ২৮ শতাংশ শিশু এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে গত বছর। আর প্রাপ্তবয়স্কদের এই সংখ্যা ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে, সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রায় ৮৩ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষের বসবাস এসব এলাকায়। এই চিত্র তুলে ধরে ওপিএইচআইয়ের পরিচালক সাবিনা আলকির বলেন, দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে যুদ্ধ, সংঘাত। তিনি আরও বলেন, ‘এই যে চিত্র উঠে এসেছে, তা সহজেই বোধগম্য। তবে আমাদের কাছে সবচেয়ে বেদনাদায়ক যে চিত্রটা উঠে এসেছে, সেটা হলো একটি শালীন বা ভদ্রোচিত জীবনযাপন এবং নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা খুঁজছে এমন মানুষের সংখ্যা ৪৫ কোটি।’ ওপিএইচআইয়ের এই পরিচালক আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি অনিবার্য চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে এই চিত্র। কোন দেশে কী পরিমাণ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তারও একটি চিত্র উঠে এসেছে এই গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি চরম দরিদ্র মানুষের বসবাস ভারতে। দেশটির ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ২৩ কোটি মানুষই চরম দরিদ্র। এর পরই যেসব দেশের নাম উঠে এসেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, গণ প্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো। ভারত ও এই চার দেশ মিলিয়েই চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে উন্নয়নের পথে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক খাতের নাজুকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এখনও বড় বাধা মনে করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে গুণগত কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের সংস্কারকে এ মুহূর্তে অপরিহার্য হিসেবে দেখা হয়েছে। বিভিন্ন খাতে অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাত সহ বিভিন্ন খাতে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে তাতে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা এবং সমর্থন থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুলাই সেখ। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন–জিডিপির ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে। যা সমাপ্ত অর্থবছরে ছিল ৫.২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে। তবে কত হতে পারে সে ব্যাপারে কোনো পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি। খাদ্য পণ্যের উচ্চমূল্য ও জ্বালানি মূল্যের কারণে গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯.৭ শতাংশ হয়েছে বলে এতে মন্তব্য করা হয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২২ সালে দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে অন্তত চারজন হয় গরিব অথবা দরিদ্র্য হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। অন্যদিকে আয় বৈষম্য ও নগর দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক বছরে দারিদ্র্য কমলেও আয়বৈষম্য বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পতনের দাবিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জনজোয়ারের পেছনে আর্থসামাজিক বিভিন্ন কারণের মধ্যে দারিদ্র্যও একটা বড় কারণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। শহরমুখী মানুষের ঢল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এখন গ্রাম থেকে নগরমুখী। দেশে প্রতি চারজনে একজন শহরে বসবাস করেন।
দারিদ্র্য ঝুঁকির অনুমান ছাড়াও বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই অর্থবছর দেশের শিল্প এবং সেবা খাতে নানা নেতিবাচক প্রভাব ছিল। শুধু গত অর্থবছরে এ কারণে চাকরি হারিয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। বছরটিতে মজুরি প্রায় ১ শতাংশ কমেছে। এতে চাকরি হারানো পরিবারগুলো দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। একই কারণে অতি দারিদ্র্য শূন্য দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায় দারিদ্র্যতা বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি)- এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০০-২০১০ সাল মেয়াদে গড়ে প্রতি বছর দারিদ্র্য কমেছে ১.৭৪% হারে, যা কিনা উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতি বছর ১.২% হারে দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যের চেয়ে বেশি। ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬.৭%, যা ২০১৬ সালে হ্রাস পেয়ে ২৪.৩% এ দাঁড়িয়েছে। আবার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে গড় দারিদ্যের হার ১৮.৭% যা আমাদের কাছে ইতিবাচক হলেও দেশের মোট জনসংখ্যার হার অনুযায়ী এটি অশুভ সংকেত। আরও দেখা যায় যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ের দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে পল্লী এলাকায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ দারিদ্র্য রয়েছে। যেখানে ২০১৬ সালে দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে অফিসিয়াল দারিদ্র্য হার ছিল জাতীয় পর্যায়ে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। পল্লী এলাকায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো ব্যাক-ক্যালকুলেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে হেইজ ২০১৬ সালে দারিদ্র হার ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এতে দেখা যায়, দেশে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্য হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট (হ্রাসের গতি) কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে অতিদারিদ্র্যের ব্যাপকভাবে কমেছে। নিম্ন দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে ২০২২ সালে অতিদারিদ্র্য জাতীয় পর্যায়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এরমধ্যে পল্লী এলাকায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। যেখানে ২০১৬ সালে নিম্ন দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে অতিদারিদ্র্য হার ছিল জাতীয় পর্যায়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে পল্লী এলাকায় ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ব্যাক-ক্যালকুলেশন ব্যবহার করে হাইয়েজ ২০১৬ সালে অতিদারিদ্র্য হার ছিল ৯ দশমিক ৩ শতাংশ দারিদ্র্য। দেশে ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সালে অতি দারিদ্র্যের হার (৩ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট, হ্রাসের গতি ৩৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ) ব্যাপকভাবে কমেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বরিশাল বিভাগে সর্বোচ্চ দারিদ্র্য হার পাওয়া গেছে। আগে কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ দারিদ্র্য হার থাকলেও এবার সেটি বরিশালে গেছে। উচ্চ ও নিম্ন উভয় দারিদ্র্য রেখার মাধ্যমে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের বিভাগগুলোর মধ্যে সবোর্চ। গত বছরে বরিশালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী দারিদ্র্য হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং নিম্ন দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার ১১ দশমিক ৮ শতাংশ পাওয়া যায়। অন্যদিকে বিভাগগুলোর মধ্যে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী খুলনায় দারিদ্র্যের হার ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ঢাকায় নিম্ন দারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী অতিদারিদ্র্যের হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে আয় বৈষম্যের পরিবর্তন ঘটেছে। ২০২২ সালে আয় গিনিসহগ অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে আয়বৈষম্য শূণ্য দশমিক ৪৯৯, পল্লি এলাকায় শূন্য দশমিক ৪৪৬ এবং শহর এলাকায় শূন্য দশমিক ৫৩৯, যা ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে ছিল শূণ্য দশমিক ৪৮২, পল্লি এলাকায় শূণ্য দশমিক ৪৫৪ এবং শহর এলাকায় শূন্য দশমিক ৪৯৮। ২০১০ সালে জাতীয় পর্যায়ে গিনিসহগ ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮, পল্লী এলাকায় শূন্য দশমিক ৪৩১ এবং শহর এলাকায় শূন্য দশমিক ৪৩১ এবং শহর এলাকায় শূন্য দশমিক ৪৫২। উচ্চ আয় বিশিষ্ট শ্রেণির আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালে আনুমানিক ১৪ দশমিক ১ শতাংশ খানার একজন সদস্য ছিলেন যারা গত ১২ মাসে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এটি ২০১৬ ও ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ যার হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। হাইয়েজ ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে ২১ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যক্তি মাঝারি বা মারাত্বক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। যেখানে ২০২২ সালে পল্লী এলাকায় এ হার ছিল ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশে ২০২২ সালে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ ব্যক্তি মারাত্বক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন।
তবে দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি হলেও সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণির সংখ্যা দ্রুত বাড়ার ফলে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সামাজিক খাতে উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশে আয়বৈষম্য প্রকট যেমন দেশের গরিব ৪০ শতাংশের আয় মোট আয়ের মাত্র ২১ শতাংশ, প্রথম ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে ২৭ শতাংশ আয় চলে যায়, শেষ ১০ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছায় ৩.৮ শতাংশ আয়। অর্থাৎ শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী শেষ ১০ শতাংশের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি আয় করে যার ফলে মোট দেশজ উৎপাদন/আয় বৃদ্ধি পেলে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে কম পৌঁছায়। ইউএনডিপির ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গিনিসূচকের পয়েন্ট ০.৪৭৮ এবং কোনো দেশের এই স্কোর ০.৫০ এর ঘর পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয় যা কোনভাবেই বাংলাদেশের জন্য সুখবর নয়।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অর্থনীতির অনেক পরিবর্তন হলেও সমাজের মৌলিক সমস্যা যেমন নারীর প্রতি বৈষম্য, যৌতুক প্রথা, মানবিক মূল্যবোধ, গনতন্ত্রিক আচরন, ভোগের প্রবণতা বৃদ্ধি, পরিবার প্রথায় অনীহা, কাল টাকার প্রভাবমুক্ত সমাজ, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, হতাশা জনক রাজনীতি, নির্বাচনের প্রতি অনীহা, সরকার-বিরোধী দল দ্বন্দ ইত্যাদি বিষয়গুলোর তেমন গুনগত পরিবর্তন হয়নি যা নিয়ে সমাজ বিশ্লেষকগন চিন্তিত গ্রামীণ থেকে শহুরে, স্থানীয় থেকে জাতীয়/আঞ্চলিক স্তরের সকল পর্যায়ে যে পরিবর্তন হয়েছে তার সঙ্গে দেশের আদি সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থায় রয়েছে যা কাম্য নয়।
লেখক: গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//