ডিজিটাল বাংলাদেশে বিপন্ন বাংলা

মোস্তাফা জব্বার

এক॥
আজই ফেসবুকে দেখলাম। মাস্টারমাইন্ড নামক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল অমর ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে একটি ব্যানার প্রকাশ করেছে। ব্যানারে শহীদদের ছবি দেয়া হয়েছে। সেই ছবিগুলো ভাষা শহীদদের নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠদের। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন এমনটাই।
অন্যদিকে যতো ডিজিটাল ততো বাংলা ভাষার বিদায়। ৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বাংলা চর্চার যে স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন সেটি এখন কালো অধ্যায়ে পরিণত হচ্ছে।
কারও কারও স্মৃতিতে এটি থাকতে পারে যে, মোবাইল ফোন কেনার আবেদন পত্রটি আমাদের টেলিকম অপারেটররা ইংরেজিতেই করেছিলেন। কালক্রমে সেটি নাকি দ্বিভাষিক হয়েছে-কেবল বাংলা ভাষাতে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে কি হবে রোমান হরফ ছাড়া ওরা জাতে ওঠতে পারেনা। তাই আবেদনপত্র বদলালেও ফোন কেনার জন্য যে চুক্তিনামা তৈরি হয় সেটি এখনও পুরোই ইংরেজি, বাংলা হরফই নেই সেখানে। আঙুলের ছাপ দিয়ে যে দিনমজুর ফোনের সিম কেনে তাকে সেই ইংরেজি চুক্তিতেই স্বাক্ষর করতে হয়। চুক্তির লেখা তথাকথিত ইংরেজগণও বুঝে কিনা আমার তাতে সন্দেহ আছে। যে দেশে শতকরা ৯৬ জন মানুষ ইংরেজি পুরো বুঝেনা এবং যে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সেই দেশে মোবাইল কেনার মতো অতি সাধারণ কাজে ইংরেজি ভাষায় চুক্তিপত্র হবার কথা নয়। দেশের স্বাক্ষরতার হার ৭১ ভাগে ওঠলেও ইংরেজিতে ফরম পূরণ করার মতো মানুষ শতকরা কতোজন সেই প্রশ্নের চাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে কেন আমি নিজের ভাষায় একটি মোবাইল কেনার চুক্তিও করতে পারবোনা।  আমার সংবিধানে দেয়া অধিকার কেন আমি ভোগ করতে পারবোনা? কে দেবে আমার এই প্রশ্নের জবাব।
অন্যদিকে ডিজিটাল হবার একটি অতি সাধারণ দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারি। সেটিও মোবাইল বিষয়ক। বাংলাদেশ মোবাইল অর্থ সেবা খাতে অসাধারণ অগ্রগতি করেছে। এই সুবিধাটি বস্তুত দেশের অতি সাধারণ মানুষের জন্য এক বিপ্লবী রূপান্তর। কিন্তু দেখুনতো বিকাশের মেন্যুটা। সেটিতে একটিও বাংলা হরফ নেই।  যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা সেই দেশে এইসব সাধারণ মানুষের পক্ষে রাষ্ট্র একটি কথাও বললোনা। মোবাইল অর্থ সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের কেউ বললোনা যে এটিকে বাংলা করে দাও। তাকিয়ে দেখবেন ব্যাঙ্ক খাতের কার্ড লেনদেন বা অন্য কিছুতে বাংলার কোন চিহ্নই নেই।  ডিজিটাল যন্ত্র পয়েন্ট অব সেলস এর কোন রশিদ বাংলায় হয়না। কোন ডপার্টমেন্টাল স্টোর তার পণ্য বেচার রশিদ বাংলায় করেনি। বেসরকারি অফিসগুলোর দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি। বাংলাদেশের কোন বড় বাণিজ্য বা শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের যোগাযোগে বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন না। ডিজিটাল যন্ত্রে লিখলেতো নয়ই।
ঘটনাটি সেখানে থেমে থাকলে ভালই হতো। সেটি এখন এক নতুন জটিলতায় প্রবেশ করেছে। সম্প্রতি টেলিকম অপারেটরগণ বায়োমেট্রিক্স সিম নিবন্ধনের তথ্য ডাটাবেজ হিসেবে তৈরি করছে। এখন চলছে  সেই ডাটাবেজের কাজ। তাতে ডাটা এন্ট্রি হচ্ছে রোমান হরফে। ফলে ডিজিটাল করার নামে টেলকোগুলো বাংলাকে পুরোই বিদায় করে দিয়েছে।  সচরাচর তাদের সাইনবোর্ডও বাংলায় হয়না। বিলবোর্ডে বাংলা নেই। ব্যানার-ফেস্টুন বা প্রচারপত্রে বাংলা নেই। বিজ্ঞাপনে বাংলা নেই। বাংলা টিভি চ্যানেলের নাম ইংরেজিতে। এমনকি বাংলায় প্রচারিত অনুষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে। রেটিও বাংলা হরফে লেখা হয়না।
সরকারি অফিসে বাংলার প্রচলন কমছে। ফাইলে বাংলা হাতে লেখা হয় বটে কিন্তু তারা সেমিনারের ভাষা, প্রকল্পের ভাষা, মেলার ভাষা, ব্যানার ফেস্টুনের ভাষায়তো বটেই ডিজিটাল রূপান্তরের নামে যত্রতত্র রোমান হরফের ব্যাপক ব্যবহার করছে। ওরা যখনই সেমিনার করে তখন দুইজন বিদেশীর জন্য সেমিনারের ভাষা বাংলা করে ফেলে। আমি নিজে একটি সংগঠনে যুদ্ধ করেও বাংলা প্রচলন করতে পারছিনা। ফেংব্রুয়ারি মাসেও ইংরেজি দিয়ে উপস্থাপনা ও বক্তব্য প্রদান হচ্ছে বাংলায়। সেদিন একটি বাণিজ্য সংগঠনের সেমিনারে ৩ জন বিদেশীর জন্য ইংরেজিতে সেমিনার পরিচালিত হলো। দেশে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার প্রাধান্য থাকলেও বড়লোকের সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যম বা ইংলিশ ভার্সনে পড়ে। ওদের বাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিষিদ্ধ। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা নেই। উচ্চ আদালতে বাংলা নেই। শহুরে মধ্যবিত্ত এমনকি বিয়ের কার্ডও ইংরেজিতেই ছাপে। তাদের এজন্য কোন লজ্জাবোধতো হয়ইনা, বরং গর্ব হয়। আবার ওরাই একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ভরে দেয়। খালি পায়ে আমার ভাই-এর রক্তে রাঙানো গান গায়। এই স্ববিরোধী জাতি গোষ্ঠীকে নিয়ে কি মন্তব্য করা যাবে সেটি আমি জানিনা।
জীবনেও বাংলা নেই:  কয়েক মাস আগের ঘটনা। ঢাকার শেরে বাংলা নগরের এনইসি মিলনায়তনের পথে যাবার সময়ও আমার মনে ছিলোনা যে,  ইদানিং আমি আমার ফেসবুক পেজে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছি। ফেসবুকের কভার পেজ বা প্রফাইলে এই দাবি তুলছি। শহীদ মিনারের ছবি তুলছি কভার ছবিতে। কেবল ফেসবুকেও নয়, প্রচলিত ও অনলাইন মিডিয়াতেও আমি এই দাবি পেশ করছি। এই দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করার কিছু মানুষকেও পাচ্ছি আমি। ফেসবুকে অনেকেই আমার রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবির সাথে একমত হয়েছেন। তবে  তারা সংখ্যায় খুবই নগন্য। নিজেরা রোমান হরফে টাইপ করে বাংলা হরফে রূপান্তর করে ভুল বাংলা লেখেন, ভুল বানান লেখেন বা ইংরেজিতে নিজেকে প্রকাশ করেন এমন বঙ্গসন্তানরা বাংলার পক্ষে দাড়াবেন তেমনটি আশাও করিনা আমি। স্বাধীনতার প্রায় চার যুগ পরে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কেবলমাত্র গ্রামের মানুষ বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষ বাংলা ব্যবহার করে। কোন কোন বাংলাদেশী নাগরিকেরা এমনকি ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলায়ও বাংলা ব্যবহার করেনা। সরকারি অফিসে ফাইলের নোটে বাংলা থাকলেও ডিজিটাল করার নামে-বিদেশীর নামে বা সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের নামে বাংলা উধাও হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা বর্ণমালাও নাই। উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের কোন ইচ্ছাও নাই। দেশের সকল আদালতে বাদি বাঙালী, বিবাদী বাঙালী, বিচারক বাঙালী, আইনজীবি বাঙালী। এমনকি আইনও বাংলায়। কিন্তু আদালত বাংলায় পরিচালিত হয়না। ফলে  সাধারণভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ ধারায় প্রজাতন্ত্রের একমাত্র  রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকলেও বাস্তবে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা নাই। এমনকি দিনে দিনে ডিজিটাল হতে হতে বাংলা বিলুপ্ত হচ্ছে। এই বিষয়টি যে কতো ভয়ংকর সেটি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অনেকেই অনুভব করছেন না। গত ১৬ সালের ২৮ আগস্টের একটি সরকারি সভার বরাত দিয়ে অবস্থার ভয়াবহতা কিছুটা অনুভব করা যায়।
সেদিন দুপুরে যখন শেরে বাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি মিলনায়তনে একটি সভায় প্রবেশ করি তখনও জানতামনা যে, এই সভায় বাংলা একটি বড় প্রসঙ্গ হিসেবে আলোচিত হবে । সভাটি হচ্ছিলো পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি মিলনায়তনে। মিলনায়তনের প্রবেশ পথে দেখলাম ইংরেজিতে সভার বিবরণ দেয়া ব্যানার ঝুলানো হয়েছে। তাতে একটি বাংলা হরফও নেই। সভার পেছনে প্রধানত ইংরেজিতে সভা পরিচিতির ব্যানার ছিলো। যদিও দুয়েকটা বাংলা বাক্য দিয়ে সভার স্থান লেখা হয়েছিলো তথাপি ব্র্যাক এর উপস্থাপনাটি ছিলো পুরোই ইংরেজিতে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপনাও ছিলো ইংরেজিতে। তারা তাদের উপস্থাপনায় ইংরেজি ভাষায় অনেক জটিল ধারনা তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। ব্র্যাকের উপস্থাপনাটি পেশাদারী হলেও স্থানীয় সরকারের উপস্থাপনাটি ছিলো গুবলেট পাকানো। তবে আমাকে পরম স্বস্তি দিয়ে সভার পরিচালনা শুরু হয় বাংলায়। শুরুতে বিশ্বব্যাঙ্কের বাঙালী প্রতিনিধি ইংরেজিতে কথা বললেও ব্র্যাকের উপস্থাপক ইংরেজি স্লাইডগুলো বাংলায় ব্যাখ্যা করেন। বাংলা নিয়ে কথার সূচনাও তিনি করেন। তিনি স্থানীয় পর্যায়ে ১২টি সড়ক ও ৮টি স্কুল-এর উন্নয়ন কাজের মনিটরং-এর অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে প্রকল্পগুলো ইংরেজিতে প্রণীত হবার জন্য চরম হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, স্থানীয় উন্নয়ন কাজ মনিটিরং করতে গিয়ে স্থানীয় জনগণ ইংরেজিতে প্রণীত প্রকল্পগুলো বুঝেনা। সেগুলো কঠিন ও জটিল ইংরেজি জারগণে প্রস্তুত করা থাকে বলে প্রকল্প ও বাস্তব কাজের প্রকৃত সম্পর্ক ও মূল্যায়ন করতে পারেনা। তিনি সেগুলো বাংলায় প্রনয়নের পরামর্শ দেন। এরপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবও জানান যে, প্রকল্প এলাকায় ইংরেজি সাইনবোর্ড থাকায় স্থানীয় জনগণ প্রকল্প সম্পর্কে ধারনা পায়না। এরপর মুক্ত আলোচনায় দ্বিতীয় বক্তা হিসেবে আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই যে, সংবিধানের ৩ ধারা লঙ্ঘন করে কেমন করে ইংরেজিতে প্রকল্প প্রণীত হয় এবং গ্রামের রাস্তার প্রকল্পের বিবরণ কেমন করে ইংরেজিতে লেখা থাকে। আমি সকল প্রকল্প বাংলায় প্রণয়নের দাবি করে মন্ত্রী মহোদয়কে ইংরেজিতে প্রণীত প্রকল্প গ্রহণ না করার অনুরোধ করি। তারপর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি ঘোষণা করেন যে, তারা বাংলার প্রকল্প মূল্যায়ন করতে সক্ষম। মন্ত্রী মহোদয় তার বক্তৃতায় বিস্মিত হন যে এতোদিন বাংলায় প্রকল্প প্রণয়ন হয়নি কেন?
আমার নিজের হাসি পাচ্ছিলো মন্ত্রীর কথায়। যিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন তিনি জানেননা যে, তার কাছে আসা প্রকল্পগুলো বাংলায় নয় ইংরেজিতে আসে। বছরের পর বছর তিনি সেগুলো অনুমোদন দিয়েছেন। আমার এতোদিন ধারনা ছিলো যে, বিদেশীদের জন্য এসব প্রকল্প রোমান হরফে  তৈরি হয়। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধির কথা শুনে মনে হলো সেটিও সত্য নয়। তাহলে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার প্রকল্প কেমন করে ইংরেজিতে  তৈরি হলো। মাননীয় মন্ত্রীদের কি সংবিধান পড়া নেই। তারা বঙ্গবন্ধুর ৭০ সালের ভাষণটি ভুলে গেছেন? সরকারের কোন স্তরেই কি এই বিষয়ে সচেনতা নেই? আমি এটিও ভেবে পাইনি যে এসব প্রকল্প সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে যায় কেমন করে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা এইসব ফাইলে সই করেন কেমন করে?
তারপরই মন্ত্রী মহোদয় ঘোষণা দেন, এখন থেকে সকল প্রকল্প বাংলায় হতে হবে। তিনি বলেন, যদি বিদেশীদের জন্য প্রকল্পটির প্রয়োজন হয় তবে বাংলার সাথে এর ইংরেজি করা যেতে পারে। তবে প্রকল্প বাংলায় হতেই হবে। বক্তৃতার শেষ পর্বেও তিনি বাংলায় প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেন।
আমি অবশ্য অবাক হয়েছি মন্ত্রীর কথায়। দেশে সংবিধানগতভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় কাজ কেমন করে হচ্ছিলো সেটি মন্ত্রী নিজে জানতেন না? অন্যদিকে বিশ্বব্যাঙ্ক বাংলা প্রকল্প গ্রহণে সম্মত হলেও আমাদের সরকার এর ইংরেজি সংস্করণ করতে চান কেন?
আমি সেই বৈঠকে যোগ দিয়ে ধরেই নিয়েছিলাম যে এরপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষায় কোন প্রকল্প পেশ বা অনুমোদন হবেনা। কিন্তু আমার সেই আশায় গুড়ে বালি হলো। সেই ঘটনার কয়েক মাস পরে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা উন্নয়নের জন্য আইসিটি ডিভিশন থেকে ইংরেজি ভাষায় একটি প্রকল্প উপস্থাপন করা হয় যা ৩রা জানুয়ারি ১৭ অনুমোদিত হয়। ৩১ জানুয়ারি সেই প্রকল্পের অনুমোদনের পত্র আইসিটি ডিভিশনেও পৌছেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই প্রকল্পটির সাথে কোনভাবেই কোন বিদেশী সহায়তা বা ঋণ জড়িত নয়। ফলে বিদেশীদের জন্য প্রকল্প দলিল বাংলায় করা যায়নি এই কথাটিও বলা যাবেনা। প্রকল্পটি পাঠ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে সেটি বাংলায় প্রণয়নে কোন সমস্যাই নাই। কিন্তু সেটি বাংলায় তৈরি হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি বাংলা ভাষার উন্নয়নের প্রকল্পও যদি বাংলায় করা না যায় তবে কোন প্রকল্প বাংলায় হবে? বস্তুত এই বিষয়টি মানসিকতার। এর মধ্য দিয়ে এটিও প্রমাণিত হলো যে রাষ্ট্রের কোন স্তরেই বাংলা ব্যবহারের কোন ধরনের অঙ্গীকার নেই। বাংলা বস্তুত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাগুজে সাংবিধানিক ভাষা। অথচ শহীদের রক্তে লেখা এই ভাষার এই দুর্গতি হবার কথা ছিলোনা। বিশেষ করে ভাষার নামে একটি দেশ প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষার এই পরিণতি আমাদের সামনে আসা উচিত ছিলোনা।
দুই॥
বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ও সরকারি অফিসে বাংলা: গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় বাংলা প্রচলন বিষয়ক আইন সম্পর্কে একটি খবর ছাপা হয়। খবরটির অংশ বিশেষ এরকম: “দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা চালুর লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ প্রণয়ন করা হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’। এতে বলা হয়, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এই আইনে আরও বলা হয়, কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে সেটি বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি এই আইন অমান্য করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই আইন চালু হলেও এর বাস্তবায়নের কাজটি হয়েছে ঢিলেঢালাভাবে। এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। কিছু সমস্যাও ছিল। কারণ যথাযথ পরিভাষার অভাব ও বানানরীতির ভিন্নতার কারণে ব্যবহারিক ভাষায় অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এ ছাড়া প্রমিত ভাষারীতি সম্পর্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভালোভাবে অবহিত না থাকার কারণে নথিপত্রের ভাষার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিষয়টি ২০১২ সালে মন্ত্রিসভার  বৈঠকেও আলোচিত হয়। পরে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর সরকারি কাজে বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানরীতি অনুসরণ করার নির্দেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর এ কাজ কিছুটা গতি পায়। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ শাখা, যেটির নাম বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ। এই কোষের অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তা মো মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কাজে বাংলা ভাষা সহজ করে ব্যবহারের জন্য এই কোষ থেকে ইতিমধ্যে চারটি পুস্তিকা বই আকারে বের করা হয়েছে। এগুলো হলো পদবির পরিভাষা, প্রশাসনিক পরিভাষা, সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা পুস্তক ও ছোট বই (পকেট বুক)। এ ছাড়া সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম ও সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলার দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার কাজও প্রক্রিয়াধীন আছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকারি কর্মকর্তারা প্রমিত বাংলা ব্যবহারে সহায়তা নিতে পারছেন। অফিস সময়ে এই কোষে ফোন করেও সহায়তা নেওয়া যায়।ওই কোষের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি অনুসরণে লেখা এই পুস্তক ও ছোট বইগুলো ছোটবড় সব সরকারি দপ্তরেই বিতরণ করা হয়েছে। এখন সেই অনুসারে নথিপত্রের ভাষা লেখা হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনেও একইভাবে একই বানানরীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এই কোষ ইংরেজি থেকে বাংলায় করা আইনের খসড়াগুলো প্রমিত বানানে হচ্ছে কি না, তা যাচাই করে দেয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জনবল বাড়িয়ে এই কোষকে শক্তিশালী করে আরও অনেক কাজ করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। বর্তমানেও দুজন অনুবাদ কর্মকর্তা ও একজন বিশেষজ্ঞের পদ শূন্য আছে। এ ছাড়া বদলিজনিত কারণে যুগ্ম সচিবের পদও এখন শূন্য। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন এলাকায় সাইনবোর্ড যাতে বাংলায় লেখা নিশ্চিত করা হয়, সে জন্য গত বছর স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।”
কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে  আমরা  এই চিঠির প্রয়োগ দেখতে পাইনা। নগর এলাকায় বাংলা সাইনবোর্ড দূরবীন দিয়ে খুজতে হয়।
আমি মনে করি, বাংলা ভাষা বর্জন করার বিষয়টি পুরো সরকারের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে কারণে বা অকারণে আমলারা ইংরেজি ব্যবহার করেন। বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন বা সরকারের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ এইসব বিষয়ে কেন এই আইন লঙ্ঘন করার জন্য কারও বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এর মূল কারণ বাংলা ভাষার প্রতি এদের কোন অঙ্গীকার নেই।।
যাহোক এই পরিস্থিতির আলোকে এতোদিনে বাংলা ভাষার কতোটা দুর্দিন  তৈরি হয়েছে সেই বিষয়েও আমি আলোকপাত করতে পারি।  নিবন্ধের পরের অংশে আমরা সংকটগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরব।
রাষ্ট্রভাষার দেশে অসহায় বাংলা:  বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার অসহায়ত্ব নিয়ে আমরা লেখাটি শুরুই করেছি। বস্তুত বাংলা ভাষার নামে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সেই ভাষারই এখন চরম দুর্দিন বিরাজ করছে সেটি বিশ্বাস করা অনেকটাই কষ্টের। ভাবা যায় যে, এমনকি সেই ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? যদি আমাদের এটি ভাবতে হয় যে, আমরা যতই ডিজিটাল হচ্ছি বাংলা ভাষার দুর্দিন ততই বাড়ছে, তবে কেমন লাগবে একজন বাংলাভাষী হিসেবে। সাম্প্রতিককালে এই দুর্দশাটি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। দিনে দিনে সেই অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে কেবল বাংলা ভাষা ও লিপির দুর্দিনই দেখতে পাচ্ছি। কোন মহলই এই চরম সঙ্কট থেকে বাংলাকে উদ্ধারের কোন চেষ্টা করছে সেটি দেখছি না। বরং একদল মানুষ জেনে না জেনে বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করার জন্য সকল শক্তি দিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা ডিজিটাল যুগের বাসিন্দা থাকব বটে-তবে বাংলা ভাষার সঠিক (বা কোন প্রকারের) ব্যবহার থাকবে না। আমি বাংলা লিপির বিলুপ্তিরও আশঙ্কা করছি। যদিও আমি এটিও বিশ্বাস করি যে, ৩৫ কোটি লোকের ব্যবহƒত একটি লিপি বা হাজার বছরের সমৃদ্ধ একটি ভাষা-সাহিত্য কোনভাবেই বিলুপ্তির স্তরে যেতে পারে না, তবুও ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বিশেষত বাংলাদেশে যেসব কাজ হচ্ছে তাতে আশঙ্কার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছেই। চিন্তা করে দেখুন, এটি কি ভাবা যায় যে, রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে যে জাতি সেই জাতির হাতেই তার মাতৃভাষা বা তার রক্তমাখানো বর্ণমালা হারিয়ে যাবে? এটি কি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা যায় যে, সেই পথেই পা বাড়িয়েছি আমরা।
কয়েকটি বিষয় নজরে আনুন। কেউ কি এটি ভাবতেও পারেন যে, আমাদের সরকারের দুর্বলতার জন্য বাংলা ভাষাকে এখনও দেবনাগরী কোড ব্যবহার করতে হয়। এটি আমরা বছরের পর বছর ধরে মেনে চলেছি এবং সেটি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে। কেউ কি ভাবতে পারেন যে, কম্পিউটারে বাংলা ভাষা যে প্রমিত মান প্রয়োগ করার কথা সে বিষয়ে সরকারের কোন স্তরে সচেতনতাই নেই। কেউ কি ভাবতে পারেন যে, খোদ সরকার কীবোর্ড পাইরেসির দায় ঘাড়ে নিয়ে বছরের পর বছর নীরবতা পালন করেছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প গ্রহণ করার কথা সেইসব কাজ শুরু করতে ২০১৭ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মাঝে যেসব কাজ হয়েছে সেগুলো প্রায় সবই নিস্ফলতায় পড়েছে এবং সমন্বয়ও দেখা যায়নি। আপনারা কি ফেসবুক বা টুইটারে দেখেন আমাদের বঙ্গ-সন্তানরা কি সুন্দর (!) বাংলা লেখেন? এটি ভাবতে পারেন যে, ফেসবুকের মতো ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলিশ, অশুদ্ধ ও শুদ্ধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাত্র শতকরা মাত্র ৮ ভাগ মানুষ বাংলা ব্যবহার করে। এর মানে দেশের ৯২ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী বাংলিশও ব্যবহার করেন না। কেউ কি এটি ভাবতে পারেন যে, রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রশিক্ষণ দিয়েছে  সরকারি সংস্থা এবং রোমান হরফে বাংলা লেখার উৎসাহদাতাও সরকারি সংস্থা। যার সন্দেহ আছে তার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য কোন বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে সেটি জানার অনুরোধ করছি? সরকারের একটি সংস্থার নির্দেশে হাজার হাজার শিক্ষক ও সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী এখন তাই রোমান হরফে বাংলা লেখে। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৫০ হাজার ল্যাপটপ কেনার স্পেসিফিকেশনে রোমান হরফে বাংলা লেখার ব্যবস্থা সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরামর্শক।
সকলেই সরকারের এসএমএসগুলো কি দেখেন? কি চমৎকারভাবে রোমান হরফ দিয়ে ভুল বাংলায় এসএমএস লেখা হয়! কেউ কি এটি কল্পনা করতে পারেন যে, সরকার নিজেই তার প্রণীত মান মানেন না?
বাস্তব অবস্থাটি আমার ওপরের বর্ণনার চাইতেও ভয়াবহ। আরও ভয়াবহ যে এই বিষয় নিয়ে সরকার তো কথা বলেই না, দেশের সুশীল সমাজও কথা বলেন না। বাংলা ভাষার জন্য যারা কথায় কথায় জীবন দিয়ে ফেলেন তারাও কথা বলেন না। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা এখন এতিমের মতো অযতেœ অবহেলায় বেড়ে উঠছে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই এতিম রাষ্ট্রভাষার অতি জরুরি সংকট বা চ্যালেঞ্জগুলোকে অতি সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরা।
আজকের ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার সংকট অতি সাধারণ নয়। এর চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তি জড়িত রয়েছে। অতীতের সরকারসমূহের কোন কোন মহলের চরম অবহেলার জন্য প্রযুক্তিগত সংকটগুলো অতিক্রম করা সম্ভব হয়নাই। এর ফলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে বাংলার পশ্চাপদতা রয়েই গেছে।
তিন॥
বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রা নিয়ে এই কলামে আমরা এর আগেও আলোচনা করেছি। আলোচনার বিস্তৃতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে কিছু আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আমরা কয়েকটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছি।
১. প্রমিতকরণের সংকট:  কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রমিতকরণের দায়িত্ব ছিলো বিএসটিআই-এর। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার সরকার কেবলমাত্র আমাকে (মোস্তাফা জব্বারকে) ঠেকানোর জন্য সেই দায়িত্ব তৎকালীন বিসিসিকে দেয়। তখন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কম্পিউটারে বাংলা ভাষার নীতিগত, প্রমিতকরণ ও প্রায়োগিক বিষয়গুলোর কাজ সম্পন্ন করার। ২০০৩ সালে এক নির্বাহী আদেশে প্রমিতকরণের কাজটি বিএসটিআই থেকে কম্পিউটার কাউন্সিলে নিয়ে আসা হয়। মূলত বিজয় কীবোর্ড যাতে প্রমিত না হতে পারে কাজটি করা হয়েছিল সেজন্য। তৎকালে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি, তখনকার মন্ত্রী আবদুল মইন খান ও কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সালামের সহায়তায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে দিয়ে এই কাজটি করান। এরপর কম্পিউটার কাউন্সিল বিজয় কীবোর্ডকে নকল করে একটি কীবোর্ড প্রণয়ন করে ও কপিরাইট গ্রহণ করে। তারা বিএসটিআই থেকে এর অনুমোদনও গ্রহণ করে। বেগম জিয়ার আমলে সেই কীবোর্ড সম্পর্কে আপত্তি করা হলেও সেটি কম্পিউটার কাউন্সিল আমলে নেয়নি। এমনকি ২০১৭ সালেও কপিরাইট বোর্ড এই বিষয়ক আপত্তির নিষ্পত্তি করেনি। এর মানে এখনও এই বিষয়টি কপিরাইট বোর্ডে ঝুলে আছে। তবে বাস্তবতা উপলব্ধি করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এখন অফিসিয়ালি জাতীয় কীবোর্ড আছে বলে দাবি করে না।
শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালেই উপলব্ধি করে যে, কারও সম্পদ নকল করে প্রমিত করা সঠিক কাজ নয়। এজন্য প্রমিত কীবোর্ড প্রসঙ্গটি নিয়ে টানা হেঁচড়া না করে কম্পিউটারের জন্য এনকোডিং প্রমিত করার কাজটি সম্পন্ন করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, সরকার এরই মাঝে জাতীয় কীবোর্ড নিয়ে জটিলতায় জড়িত থাকার পর স্মার্ট ফোনের কোয়ার্টি কীবোর্ড কি হবে সেটি নিয়েও আর সামনে যাচ্ছে না। ফলে স্মার্ট ফোনের জন্য কোন প্রমিত কীবোর্ড পাওয়া যায়নি। খুব সঙ্গত কারণেই স্মার্ট ফোনে নানা ধরনের কীবোর্ড প্রচলিত হতে থাকবে। কোন এক সময়ে আমরা কীবোর্ডের জঙ্গলে বাস করব। এখনই অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল নানা ধরনের কীবোর্ড বানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকে তাদের পছন্দমতো কীবোর্ড বাজারজাত করছে।
কম্পিউটারে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জটিল জায়গাটি রয়ে গেছে এর এনকোডিং প্রসঙ্গটি। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমিতকরণ ইস্যু। সরকার বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ নামের একটি প্রমিত এনকোডিং অনুমোদন করে নিজেরাই এর বদলে ইউনিকোড এনকোডিং অনুসরণ করছে। সরকারের বিভাগগুলো নিজেই বোঝে না যে বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ এবং ইউনিকোড এক জিনিস নয়। এটি বোধহয় দুনিয়াতে বিরল যে, সরকার তার নিজের প্রমিতকরণ মানে না। এটুআই ও কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে সরকারের সকল তথ্য ইউনিকোডে সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জাতীয় ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে সরকারের সকল ডাটা ইউনিকোডে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অথচ সরকারের উচিত ছিল বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ প্রমিত মানে সকল ডাটা সংরক্ষণ করা। এই বিষয়টির প্রতি আমি শত শত বার দৃষ্টি আকর্ষণ করেও সরকারের টনক নড়াতে পারছি না। এর ফলে বাংলা ভাষা কোড ইন্টারচেঞ্জের ক্ষেত্রে চরম জটিলতায় পড়েছে। সম্প্রতি ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের কারিগরি কমিটির সভায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল যোগ দিয়ে জানতে পারে যে, বাংলাদেশ সরকারের প্রমিতকরণ এই কনসোর্টিয়াম মানছে না। তারা দেবনাগরী থেকে দুটি কোড এনে বাংলা ভাষার সঙ্গে যেভাবে যুক্ত করে রেখেছে তা তারা পরিবর্তন করতে চায় না। দীর্ঘদিন যাবত ইউনিকোডের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় বা আইএসওতে কোন প্রস্তাব না পাঠানোতে আমরা এখনও দেবনাগরী কোডকেই বাংলা কোড হিসেবে ব্যবহার করছি। দুঃখজনকভাবে সরকার ইউনিকোড ব্যবহারের নামে সেই দেবনাগরী কোডকেই পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এই জটিলতার নিরসন না করা হলে আমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এক চরম জটিল পরিস্থিতি  তৈরি করে রেখে যাব। এ বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যদি আমরা ইউনিকোডকে মেনে নিই তবে আমাদের জাতীয় মান সংশোধন করা উচিত। নইলে সকল ডাটা আমাদের জাতীয় মানে সংরক্ষণ করে সকলকে জাতীয় মান অনুসরণ করতে বাধ্য করা উচিত। যদি সেটি না হয় তবে সরকারের প্রমিত মানকে ইউনিকোড মানে উন্নীত করা উচিত।
২. রোমান হরফে বাংলা : কেবল বাংলা ভাষার প্রয়োগই আমাদের সংকট নয়। ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সঙ্কটের নাম রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা। আমরা মোবাইলে এসএমএস পাঠাতে গিয়ে রোমান হরফ ব্যবহার করি অনেক ক্ষেত্রেই তথাকথিত প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার নামে। অথচ বিটিআরসির সিদ্ধান্ত অনুসারে আমদানীকৃত বা দেশে উৎপাদিত মোবাইল সেটগুলোর জন্য বাংলা সমর্থন করা বাধ্যতামূলক। বিটিআরসির নির্দেশ অনুসারে বাংলা সমর্থন করেনা  এমন মোবাইল সেট বাংলাদেশে আসার কথা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে বিটিআরসি নির্দেশ দিলেও সেটি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়নি। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর বাণী বা সরকারী বক্তব্য এখনও রোমান হরফেই প্রচার করা হয়। ব্যক্তিগত প্রবণতা এমন যে কেবল মোবাইল নয়, ফেসবুক-টুইটার বা অন্য সকল ডিজিটাল মাধ্যমে বেশিরভাগ বাংলাভাষী রোমান হরফে বাংলা লেখেন। অথচ ইন্টারনেটে বাংলা লেখা মোটেই সমস্যার নয়। এখনকার মোবাইল সেট বা ব্রাউজার কোথাও বাংলার সীমাবদ্ধতা নেই।
তবে সর্বনাশের বড় কাজটি করেছে সরকারের ভেতের থাকা কোন কোন অফিস নিজেই। তারা বাংলা লেখার জন্য রোমান হরফ দিয়ে লেখার প্রক্রিয়াকে সরকারীভাবে নির্দেশ দিয়ে সকলকে বাধ্য করছে যাতে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখা হয়। ওরা নিজেরা রোমান হরফে বাংলা লেখে এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে যাতে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখা হয়। এই চরম ঘৃণিত কাজটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পালিত হবার ফলে বাংলা লিপি কোন একদিন বিলুপ্তই হয়ে যাবে।
৩ উচ্চ শিক্ষা মানেই বাংলার বিদায় : কারও কারও স্মৃতিতে থাকতে পারে যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের নির্দেশনা অনুসারে সরকারী অফিস-আদালত-ব্যাংক ইত্যাদিতে বাংলা ব্যবহƒত হতো। এখন এসব কর্মকা- ডিজিটাল করা হচ্ছে। কষ্ট পেলেও সত্য যে ডিজিটাল যখনই করা হয় তখনই সেখান থেকে বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করা হয়। আমরা সবাই জানি উচ্চ আদালতের মতো উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার অস্তিত্বই নেই। বঙ্গবন্ধু যে শিক্ষাকে বাংলায় প্রচলন করেছিলেন সেটি এখন ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষায় বদলে যাচ্ছে। গত ২৭ আগস্ট আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সোসাইটীর একটি সভায় কথা বলতে গিয়েছিলাম। আলোচনার শেষে একজন ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করলো, স্যার আমি প্রাথমিকে, হাইস্কুলে ও ইন্টারমিডিয়েটে বাংলায় পড়েছি, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং পড়তে এসে সবই ইংরেজিতে পড়তে হয়। আমি এসব ইংরেজির শতকরা ১০ ভাগও বুঝিনা। আমার কি হবে স্যার? আমি এমন একজন নিরীহ ছাত্রের প্রশ্নের জবাব দিতে জানিনা। আমাদের নীতি নির্ধারকগণ জানেন কিনা সেটিও জানিনা। সেই ছেলেটিই জানালো, সবাই বলে ইংরেজি ছাড়া নাকি দুনিয়ায় লেখাপড়া করা যায়না। আমি খোজ নিয়েছি স্যার, জাপানে উচ্চ শিক্ষা নিতে হলেও ১ বছর জাপানী শিখে লেখাপড়া করতে হয়। ওরা ইংরেজি ছাড়া পড়তে পারলে আমরা কেন পারিনা। শিক্ষাবিদগণ এই ছাত্রটির প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে আমি খুশি হতাম।
৪. ডিজিটাল মানেই বাংলার বিদায়: সরকারি কাজ কেমন করে রোমান হরফে-ইংরেজিতে হচ্ছে তার একটি দৃষ্টান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তারা আয়কর ও ভ্যাট বিষয়ক যে কাজগুলো করছে তাতে বাংলার এখনও ঠাই হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গেলে, ব্যাঙ্কের  লেনদেন দেখলে এটি বোঝা যায় যে আমরা বাংলা ভাষার দেশে বাস করিনা।  অথচ এই দেশটির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনকালের শুরুতেই অসাধারণ একটি নির্দেশনামা দিয়েছিলেন। তার নির্দেশনামাটি ছিলো এরকম: “ এই আদেশ জারী হবার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্ত্বশাসিত অফিসসমূহে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোন অন্যথা হলে  বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস আদালতের কর্তাব্যক্তিগণ সতর্কতার সাথে এই আদেশ কাযকরী করবেন ও আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করবেন।”
আজ বঙ্গবন্ধু বেচে থাকলে অবাক হতেন যে দেশের সরকারি কর্মকর্তারা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতে চাইলেও তার নির্দেশ মানেনা। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের জন্য তার নির্দেশ অমান্য করা কোন অপরাধ নয়। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের কোন সরকারের সময়কালে বাংলা ভাষার দুর্গতি দেখতাম তবে মনে কষ্ট পাবার বিসয় ছিলোনা। কিন্তু ঘটনাটি অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে এমন, যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। বিষয়টিকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ আফসান চৌধুরি। তিনি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, চাষার বাংলা আর আমলার বাংলা। আমলারা ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা সংকটে ভোগে। কারণ, রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষার মধ্যে পার্থক্যটা ধরার জন্য কোন দাপ্তরিক আদেশ দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি এক কর্মশালায় আমলাদের জিজ্ঞেস করা হয়, কতগুলো বাংলা আর ইংরেজি অক্ষর আছে? মন্ত্রীকে মাননীয় না মহোদয় সম্বোধন করা হয় ইত্যাদি। সঠিক উত্তরের সংখ্যা কম। এই ভাষার সমস্যা ভদ্রলোকদের। কারণ তারাই বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে, যদিও কোনটাই পারেনা। হাইল্যা চাষা আর ফুটপাথের ফেরিওয়ালাদের এই সংকট নেই। কারণ তার ভাষা একটাই। তা হল চাষার ভাষা। ভদ্রলোকের বাংলা বানিয়েছে ইংরেজের গোলামী করা বাবু শ্রেণি। তাদের বংশধররাই আমাদের দেশের ভদ্রলোক। মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার তফাৎ শুরু হয় চাষা আর আমলার তফাত দিয়ে। শুকরিয়া…”
আমি ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার মাত্র কয়েকটি জরুরী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। বাংলা ভাষার সঙ্কট এর চাইতেও গভীরে। জাতিগতভাবে আমরা দিনে দিনে বাংলা ভাষা বিমুখ হচ্ছি এবং সময় সুযোগ পেলেই বিশ্বায়ন বা আন্তর্জাতিকতার নামে রোমান হরফের দাসে পরিণত হচ্ছি। রাষ্ট্র এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে। শেখ হাসিনার সরকারও যদি এই পতন রোধ না করে তবে কার কাছে জাতির প্রত্যাশা বড় হবে। আমাদের এখন তাই বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তুলে ধরতে হচ্ছে। আসুন উচ্চস্বরে বলি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
ঢাকা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৭ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা ॥ ই-মেইল: mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ : www.bijoyekushe.net


Comment As:

Comment (0)