বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: শুধু বানিজ্য ঘাটতি কমানো আর বিনিয়োগ বাড়ানোই কি যথেষ্ট

মাহামুদুল হাসান: একবিংশ শতাব্দীর এক অন্যতম পরাশক্তি চীন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এই দেশটি পৃথিবীতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখায় খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন চীনের রাষ্ট্রপতি। চীনের রাষ্ট্রপতির এই সফরকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ –চীন সম্পর্ক নিয়ে করছেন চুলচেরা বিশ্লেষণ। বেশিরভাগ বিশ্লেষকরাই গুরুত্ব দিচ্ছেন আমদের সাথে চীনের বানিজ্য ঘাটতি কমানো এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গুলোতে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর। চীন এবার বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যে  এ-সংক্রান্ত ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। চুক্তিগুলোর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ১৫টি এবং অন্য পর্যায়ে হয়েছে ১২টি। এর মধ্যে চিন থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার চুক্তিও রয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১৩টি বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। এ সকল চুক্তির ফলে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবেন।

এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ যে আমদের দেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং চীনের সাথে আমাদের যে বিশাল বানিজ্য ঘাটতি তা কমাতে হবে। কিন্তু চীনের সাথে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি কমানো আর আমাদের দেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোই কি শেষকথা? এর বাইরে কি চীনের কাছ থেকে নেওয়ার মত আমাদের আর কোন কিছুই নেই?

চীনের কাছ থেকে আমাদের সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি নেওয়া উচিত তা হচ্ছে তাদের উন্নয়ন মডেল থেকে ‘শিক্ষা’ নেওয়া। কয়েক দশক আগে এটা কোনভাবেই অনুমান করা যায় নি যে এই দেশটি একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হবে। বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে চীন আজকের এই অবস্থানে। চীনকে মুখোমুখি হতে হয়েছে আভ্যন্তরীণ কোন্দল, গৃহযুদ্ধ, দুর্যোগ এবং গণহত্যার। চীনের ২০০০ বছরের রাজকীয় শাসনের অবসান ঘটে ১৯১২ সালে চীন প্রজাতন্ত্র গঠনের মাধ্যমে। রাজকীয় শাসনের শেষভাগ এবং চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চীনে অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং বহিশত্রুর আক্রমণ ছিল নিয়মিত ব্যাপার। চীনা রিপাবলিকান পার্টি এবং বামপন্থীদের মধ্যে চলতে থাকে অব্যাহত সংঘাত। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় চীন কে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। এ সময় জাপানিদের চালানো ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় চীনের বেসামরিক জনগণ। দ্বি তীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান পরাজিত হলে আবার দুই দলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মাও-সে-তুং এর নেতৃত্বে বামপন্থীরা জয়লাভ করে। এরপর চালানো হয় আর একদফা গণহত্যা ‘ The Great Leaap Forward’ এর নামে।

এত সমস্যার পর ও চীন আজ অর্থনৈতিক পরাশক্তি। আর চীনের এই সাফল্যের কারন বের করার জন্য চালানো হয়েছে অনেক গবেষণা। ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি, বিশ্বায়নের সাথে তাল মেলানো , উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, পাশ্চাত্যের জ্ঞান কে কাজে লাগানো ইত্যাদি অনেক কারনের কথা বলা হয়। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশ ও তো এসকল পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাহলে তারা কেন চীনের মত সফল হল না?

Yokung Jha  নামক একজন চাইনিজ লেখক তার The Chinese Secrets: Five inspring Confucian values বইতে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই লেখকের মতে চীনের সফলতার আসল কারন হচ্ছে চীনের জনগণের কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য যা তারা তাদের পারিপার্শিক পরিবেশ থেকে অর্জন করে। চীনারা পরিশ্রমী , মিতব্যয়ী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিবারের প্রতি যত্নশীল এবং পড়ুয়া। চীনারা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে।

চীনের উদ্যোক্তারা বেশ কয়েক বছর আগেও অন্য ব্রান্ডের পণ্য নকল করে বিক্রি করত, আর আজ চীনে নিত্যনতুন অনেক নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে। সারা পৃথিবিতে চিনারা পরিচিত ছিল সস্তা-মানহীন পণ্যের উদ্ভাবক হিসেবে, আর আজ পাশ্চ্যাতের থেকে অনেক ভাল পণ্য ও চীনারা তৈরি করছে। চীনারা এখন ‘মেড ইন চায়না’ থেকে ‘মেড বাই চায়না’ তে নিজেদের ব্রান্ডিং করার চেষ্টা করছে।চীনারা এখন সুপার কম্পিউটার তৈরি করছে যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ৫গুন বেশি শক্তিশালী। জিন এডিটিং এবং 5G মোবাইল টেকনলজিতে পৃথিবিতে সবচেয়ে বেশি উন্নত এখন চীন। পৃথিবির সবচেয়ে উদ্ভাবনশীল প্রথম ২৫ টা দেশের মধ্যে চীন একটি। ২০২৫ সালকে লক্ষ্য করে চীন এখন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নিজেদের কে প্রযুক্তিগত বিষয়ে আরও উন্নত করার জন্য তারা ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নামের এই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যার জন্য তারা খরচ করবে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। এই পরিকল্পনার আওতায় তারা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম আরও আধুনিক করবে এবং এর পাশাপাশি রোবটিক্স, ইনফরমেশন টেকনোলোজি, বিগ ডাটা এনালাইসিস ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের কে আরও উন্নত করবে। অনেক পণ্য চীন এক দশক আগেও বাইরে থেকে আমদানি করত, আর আজ তারা নিজেরাই সেসব পণ্য তৈরি করে বাইরে রপ্তানি করে। ১৯৯৮ সালের পর থেকে প্রত্যেক বছর তারা শিক্ষা খাতে ১% হারে বাজেটের বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে।

চীনের এই অব্যাহত উন্নতি থেকে আমাদের শেখার মত অনেক বিষয় আছে। চীনের সাথে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে। আমারা নিজেরা যদি আমদানি নির্ভরতা কমাই এবং দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দেশে উৎপাদনের দিকে জোর দেই তাহলে এই ঘাটতি এমনিতেই কমবে। আমাদের যে সব উদ্যোক্তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাইরের ব্রান্ডকে নকল করে হুবুহু পণ্য তৈরি করছে তাদের খুজে বের করে আমাদের প্রণোদনা দেওয়া দরকার। নিজেদের ‘লোকাল ব্র্যান্ড’ তৈরির দিকে আমাদের এখন নজর দেওয়া দরকার। দেশে এত শিক্ষিত বেকার তৈরি করে আমরা কার্যত আমাদের জনশক্তি অপচয় ছাড়া আর কিছুই করছি না। এত গ্রাজুয়েট কি আদৌ আমাদের দরকার? আর উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার মত যোগ্যতা কি সকলের আছে? অযথা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়  এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি করে  এত শিক্ষিত বেকার তৈরি করার কি কোন দরকার আছে? আমাদের রপ্তানি আজও শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের উপর  নির্ভরশীল। আমারা এত বছর পরেও কেন আমাদের রপ্তানি যোগ্য পণ্য বাড়াতে পারছি না তা নিয়েও আমাদের চিন্তার দরকার। চীনা উদ্যক্তাদের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয় যে তারা নিজেদের প্রশ্ন করে ‘why not me?’ তারা চিন্তা করে যদি বিল গেটস রা পারে তো আমরা পারব না কেন? আমরা কি আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে এরকম আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছি? চীন যেমন নিজের দেশে এখন ব্র্যান্ড তৈরি করা এবং নিজেদের আধুনিকায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে, ঠিক তেমনি আমাদেরও দরকার এখন এরকম লক্ষ্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া।

লেখকঃ শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ,

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

tuhinjobs46@gmail.com


Comment As:

Comment (0)