ন্যায্য বাণিজ্যের পাঁচ দশক এবং বাংলাদেশ

মাহামুদুল হাসান: বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে Fair Trade এর ধারনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তা অপরিচিত। ন্যায্য বানিজ্যের চর্চা এবং আলোচনা ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, সাধারন গনমানুষ কারো মধ্যেই তেমন চোখে পরে না। সারাবিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার ন্যায্য বাণিজ্য দিবস হিসেবে পালন করা হলেও বাংলাদেশে তার উপস্থিতি তেমন লক্ষণীয় নয়। যদিও বিশ্বের নামকরা ন্যায্য বানিজ্য প্রতিষ্ঠান গুলো বাংলাদেশে ন্যায্য বানিজ্যের নেতিবাচক অবস্থার ব্যাপারে প্রায়ই প্রচারনা চালিয়ে আসছে।

ন্যায্য বানিজ্যকে বলা হয় একটি সামাজিক আন্দোলন যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর উৎপাদকরা যেন তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পায় তা নিশ্চিত করা। ন্যায্য বানিজ্য আন্দোলন আন্তর্জাতিক বানিজ্যে সাম্য নিশ্চিত করার দাবি জানায়। এই আন্দোলন উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর প্রান্তিক উৎপাদনকারী এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের সুরক্ষা করার চেষ্টা করে। ন্যায্য বানিজ্যের প্রবক্তারা একজন ক্রেতার একটি ক্রয়কে কোন ব্যবসায়ীর প্রতি ভোট বলে বিবচনা করে এবং ক্রেতাদের উৎসাহিত করে তারা যেন তাদের এই ভোট (ক্রয়) টি সেই ব্যবসায়ী বা উৎপাদককে প্রদান করে যিনি ন্যায্য বানিজ্যের চর্চা করেন।

বিশ্বে বেশ কয়েকটি সংগঠন ‘Fair Trade Certifier’ এর দায়িত্ব পালন করে আসছে যাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে যে সকল উৎপাদনকারী ন্যায্য বানিজ্যের চর্চা করেন তাদের পণ্য কে labeling করা যেন বাজারে ক্রেতারা এ সকল পন্য আলাদা ভাবে চিহ্নিত ও ক্রয় করতে পারে । ন্যায্য বানিজ্য কয়েকটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছে । ১. উৎপাদকের ক্রেতাদের সাথে একসাথে সংহতি প্রকাশের ক্ষমতা আছে। ২. বর্তমান বিশ্বে বানিজ্যের যে চর্চা তা সম্পদের অসম বণ্টনের কারন। ৩. গরিব দেশের থেকে ন্যায্যমুল্যে পন্য কেনা সে দেশে অনুদান অথবা সাহায্য দেওয়ার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দশটি ন্যায়-নীতি নিয়ে ফেয়ার ট্রেড যাত্রা শুরু করেছিল।  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা তাদের প্রথম নীতি। অন্যান্য নীতি গুলো হলঃ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা, উৎপাদকের ন্যায্যমূল্য, কাজের ভালো পরিবেশ, নারী-পুরুষের সমতা, পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ফেয়ার ট্রেড প্রোমোট করা এবং কোম্পানি এবং উৎপাদকের সক্ষমতা বাড়ানো ।

বানিজ্যে ন্যায্যতা এবং অন্যায্যতা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলে আসছে বহুদিন ধরে। উৎপাদক যেন তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, উৎপাদনের কাজে যারা জড়িত তারা যেন তাদের ন্যায্য মজুরি পান এবং ক্রেতারা যেন প্রতারিত না হন তা নিয়ে দাবি দাওয়া এবং প্রচার প্রচারনা চলছে বহু বছর ধরে । তবে অধুনা ন্যায্য বানিজ্যের ধারনার প্রচার-প্রচারনা এবং একে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার যে কাজ তা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেই হয়েছে । ১৯৪৬ সালে আমেরিকাতে ১০,০০০ গ্রাম পুয়েত্রোরিকা থেকে সূচীকর্ম কেনা শুরু করে যাকে আমেরিকার ন্যায্য বানিজ্যের সুত্রপাত বলা যায়। প্রথম Fair Trade Shop আমেরিকাতে খোলা হয় ১৯৫৮ সালে। উত্তর আমেরিকার পাশাপাশি ইওরোপের দেশগুলোতেও ন্যায্য বানিজ্য আন্দোলনের সূচনা হয় ৫০-৬০ এর দশকে। অক্সফাম ইউ.কে চাইনিজ উদ্বাস্তুদের তৈরি হস্তশিল্প যুক্তরাজ্যে বিক্রয় শুরু করে পঞ্চাশের দশকে। অক্সফাম ইউ.কে ১৯৬৪ সালে ইউরোপে প্রথম ন্যায্য বানিজ্য সংগঠন তৈরি করে। এর পাশাপাশি নেদারল্যান্ডে  Third World Shop খুলে উন্নয়নশীল দেশের পণ্য বিক্রয় শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে দিল্লীতে UNCTAD সম্মেলনে ন্যায্য বানিজ্যের নীতিকে উন্নয়ন নীতিমালায় বিবেচনা করা হয় এবং এই সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর দিকে Trade But Not Aid এই message  পৌছে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে উন্নয়নশীল দেশে তৈরি হস্তশিল্পের উপর ভর করে ন্যায্য বানিজ্য এগিয়ে চলে। এ সকল হস্তশিল্পের বিক্রয় বেশ বেড়ে চলছিল। কিন্তু ৮০ র দশকের শুরুর দিকে এ সকল হস্তশিল্পের চাহিদা বেশ কমতে থাকে। ন্যায্য বানিজ্যের প্রবক্তারা তখন উন্নয়নশীল বিশ্বে উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিপণ্য যেমন কফি, চা, কোকো, ফলের জুস ইত্যাদি বিক্রয়ের উপর জোর দেন।

ন্যায্য বানিজ্যের পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচেছ এবং সামনেও হবে। উৎপাদক এবং উৎপাদনের কাজে যারা জড়িত তারা যেন তাদের কাজের জন্য ন্যায্যমূল্য পান এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই। তবে ন্যায্য বানিজ্যের যে চর্চা পাশ্চাত্য দেশগুলো করছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। পণ্যের গায়ে Fair Trade label  থাকার কারনে ভোক্তারা কেনার ক্ষেত্রে Fair Trade  পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয় এবং তার জন্য বেশি মূল্য পরিশোধ করে। উৎপাদনের শুরুতে থাকা ক্ষুদ্র উৎপাদক এবং মজুরদের কাছে তার কতটুকু অংশ যায় তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। ন্যায্য বানিজ্য ধারনাকে একটি দাতব্য ধারণায় রূপ দেওয়া হয়েছে। ন্যায্য বানিজ্যে পণ্য ক্রয় করাকে দান করার সাথে তুলনা করা হয় যা এর মূল আদর্শের পরিপন্থী। যে সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ন্যায্য বানিজ্যের এই আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত নন তারা বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তা ‘Level Playing field’ তৈরিতে বাধা তৈরি করছে।

ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী নিত্য নতুন পণ্য তৈরি এবং পণ্যের মান বাড়ানোর চেয়ে ‘ন্যায্য বানিজ্যের’ প্রবক্তারা ক্রেতাদের আবেগের উপর প্রভাব বিস্তার করে পণ্য বিক্রয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। ন্যায্য বানিজ্যকে খৃস্টধর্মের পোশাক পড়াবার চেষ্টা ও করা হয়েছিল এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ন্যায্য বানিজ্যের সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ব্যাপার হল ন্যায্য বানিজ্যের প্রবক্তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়ই নেতিবাচক প্রচারণা চালায় যা স্মস্যা সমাধানের পরিবর্তে আরও বড় সমস্যা তৈরি করে । রানা প্লাজা ধ্বস এবং তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডের পর পাশ্চাত্যের ন্যায্য বানিজ্য সংগঠন গুলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালায় এবং সে দেশের ক্রেতাদের বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কিনতে নিরুৎসাহিত করে। এতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতে জড়িত অন্যান্য উৎপাদকরাও যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হন। যে আন্দোলন কিনা উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের উৎপাদকদের স্বার্থের জন্য সেই আন্দোলন এখন তাদের ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ন্যায্য বানিজ্য আন্দোলনকে শুধুমাত্র charity ধারনার ভেত্র সীমাবদ্ধ করে ফেললে অথবা ন্যায্য বানিজ্য দিবসে কয়েকটি সেমিনার- আলোচনা সভার আয়োজন করলেই ন্যায্য বানিজ্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এজন্য সচেতনতা তৈরি করতে হবে ক্ষুদ্র উৎপাদক, শ্রমিক এবং সাধারন জনগণের মধ্যে। পাশ্চাত্যের বহুজাতিক বড় কোম্পানি এবং Megaretailer দের উপর চাপ তৈরি করতে হবে তারা যেন উৎপাদনের শুরুতে যারা আছেন তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার দেয়।

লেখক: প্রভাষক, মার্কেটিং বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি (বি.ইউ.বি.টি) ই-মেইল: tuhinjobs46@gmail.com


Comment As:

Comment (0)