মার্জিন লোন ও পুঁজিবাজার

মনজুরুল আলম: ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে  বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে ধস নামে তার অনেক গুলো কারণ ছিল। যথাযথ নিয়ম কানুনের অভাব এবং প্রযুক্তিগত অভাব ছিল মূল সমস্যা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিঁজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রচুর পরিমানে নিয়ম কানুন তৈরী করে, যার মাধ্যমে মার্কেটে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, সেই সাথে পুঁজিবাজরে প্রযুক্তির যে অভাব ছিল তাও সংযুক্ত করা হয়। ধীরে ধীরে ১৯৯৬-১৯৯৭ সালের ধস কাটিয়ে ওঠে মার্কেট যখনই একটা স্বাভাবিক গতিতে চলতে শুরু করল তখনই নতুন করে আবারো সংকট শুরু হলো।

২০১০-২০১১ তে আবার সেই আগের মতো মার্কেট বাবল আপ হলো; মানুষ সর্বশান্ত হলো। আবার শুরু হলো বিশেষণ। এইবার আর আগের মতো প্রযুক্তি কিংবা রেগুলেটরের আইন কানুন সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হলো না, চিহ্নিত হলো মার্জিন লোন। যদিও ব্যাকগ্রাউন্ডে রেগুলেটর এবং প্রযুক্তি আংশিক ভাবে দায়ী ছিল। ২০১০ সালে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) একাউন্টের  সংখ্যা বেড়েছিল দ্রুত গতিতে এবং মার্কেট ইনডেস্কও বাড়তে লাগলো প্রতিদিন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগ হলো ব্যাংকগুলোর ১:২ মার্জিন লোন, ব্যাংকগুলো তাদেও পোর্টফোলিওর মাধ্যমে বিপুল পরিমানে বিনিয়োগ করলো।  বাজারে দেখা দিলো যোগানের সংকট, চাহিদা তখন তুঙ্গেঁ, রেগুলেটর পর্যাপ্ত পরিমান আইপিও বা শেয়ার ছাড়তে উৎসাহিত করতে গিয়ে প্লেসমেন্ট এর এপ্রোভাল দেয়। এতে করে কিছু কিছু মধ্যসত্ত্বাভোগী ফুলে-ফেপে উঠে।  সর্বশান্ত হয় সাধারন বিনিয়োগকারীরা। এই সময় প্রচুর ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানী মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ এর লাইসেন্স নেয়। এর মাধ্যমে তারা বাজারে লাগামহীন বিনিয়োগ করে। এরই ফলশ্রুতিতে মার্কেট  ইনডেক্স উঠে যায় ৮ হাজার ৫শ তে।

আর এই সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে থাকে। আর তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসি একসাথে মাকের্টের লাগাম টেনে ধরে। বিএসইসি মার্জিন লোনের রেশিও কমিয়ে নিয়ে আসে ১:২ থেকে দশমিক ৫০ এ। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার ঠিক করে দেয় ২৫% অফ ক্যাপিটাল।  এতে করে মার্কেট রাতারাতি ফল্ট করতে থাকে। প্রতিবাদ মুখর হয় সাধারন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু অবিচল থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসি। এতে করে ব্যাংকগুলো ক্ষতির হাত থেকে বাচলেও সর্বশান্ত হন সাধারন বিনিয়োগকারী। আটকে যায় ২ হাজার কোটি টাকার মার্জিন লোন। ব্যাংকগুলো তাদের দেওয়া মাজিন লোন এবং ইন্টারেস্ট এর কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো চলে যায় লোকসানে। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালের দিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় ফোর্স সেলের। তারা ওই বছরই বিপুল লোকসান করে এবং এই চক্কর থেকে বেরিয়ে আসে। এতে করে তারা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা লাভবান হয়। শুধু রেগুলেটরদের সাথে সমন্বয় এর অভাবে সবাই এই সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। যদিও এ পদ্ধতি মার্কেটের জন্য ক্ষতিকারক ছিল।

পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফোর্স সেল এর হাত খেকে বিনিয়োগকারীদের বাচাতে এগিয়ে আসে ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার এর সংজ্ঞা চেইঞ্জ করে। এতে করে ব্যাংক গুলোর ফোর্স সেল বন্ধ হয় কিন্তু ইন্টারেস্ট এর চাকা সচল থাকে। এতে করে সংকটে থেকে গেল সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর মার্জিন লোন দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন নতুন নিয়ম কানুন আসতে লাগলো রেগুলেটরদের কাছ থেকে। প্রভিশন মেন্ডেটরি করা হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার এর ওপর। অন্যদিকে ক্ষুদ্র তহবিলের মাধ্যমে ৯ শতাংশ হারে ফান্ড দিল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আইসিবি। এতে করে কিছুটা মলমের কাজ হলো সর্বশান্ত  হলো সাধারন বিনিয়োগকারী। কিন্তু যেই হারে ক্ষতি হতে থাকলো ইন্টারেস্ট এর জন্য তার সিকিভাগও পরিত্রান হলো না। সর্বশেষে যুক্ত হলো ডিভিডেন্ড টেক ওভার এট মার্জিন লোন একাউন্ট। এতে করে সাধারন বিনিয়োগকারীরা আবারো ক্ষতিগ্রস্থ হলো; কিন্তু লাভবান হলো মার্জিন লোন দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। যা দিয়েও রিকভারি কোনোভাবে সম্ভব না।

মার্জিন লোনের এই চক্র থেকে বের হওয়ার জন্য আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন ভাবে চেষ্টা করছি। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন চেষ্টা কোন ফল বয়ে আনছে না। আমাদের উচিত সম্মিলিত ভাবে এ থেকে পরিত্রানের চেষ্টা করা।

প্রথমত, আমাদের ইক্যুয়িটি নেগেটিভ কোড এ ইন্টারেস্ট চার্জ বন্ধ করতে হবে, সেটা যে কোন উপায়ে হোক না কেন।
*কেউ কেউ অলরেডি সাবসিডিয়ারীকে দেয়া মার্জিন লোনকে পেইড আপ ক্যাপিটালে রুপান্তরিত করে ইন্টারেস্ট চার্জ বন্ধ করে দিয়েছে।
*অনেক প্রতিষ্ঠান সাবসিডিয়ারীকে দেয়া মার্জিন লোনের ইন্টারেস্ট রেট শূন্য করে দিয়েছে।
*অনেক প্রতিষ্ঠান  ইক্যুয়িটি নেগেটিভ ক্লায়েন্ট এর কোড এ ইন্টারেস্ট চার্জ বন্ধ করে দিয়েছে।
* অনেক প্রতিষ্ঠান ইক্যুয়িটি নেগেটিভ মার্জিন একাউন্টের ইন্টারেস্ট চার্জ এ্যাকর্ড করে রাখছে।
* অনেক প্রতিষ্ঠান ইক্যুয়িটি নেগেটিভ ক্লায়েন্ট এর ইন্টারেস্ট মওকুফ করে দিচ্ছে।
* তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে এগিয়ে আসলে কাজটা অনেক সহজ হয়। যেমন- কম ইন্টারেস্টে একটা ফান্ড দিতে পাওে, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো ইক্যুয়িটি নেগেটিভ কোড এর ইন্টারেস্ট বন্ধ করতে পারে। অর্থ্যাৎ যেকোনো ফর্মুলাতে হোক এক্সিসটিং ইক্যুয়িটি নেগেটিভ একাউন্ট এর ইন্টারেস্ট চার্জ বন্ধ করতে হবে।
এরপর কাজ হবে মার্জিন একাউন্ট এর এক্সিজটিং ইক্যুয়িটি নেগেটিভ রিকোভারি করার চেষ্ঠা। এ জন্য যা করা যেতে পাওে, তা হলো –
* যে সমস্ত কোম্পানী ভাল ডিভিডেন্ড দেয় অর্থ্যাৎ ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড  বেশি সে সমস্ত কোম্পানর শেয়ার ইক্যুয়িটি নেগেটিভ পোর্টফোলিওতে কেনা যেতে পারে।   যেমন-মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স প্রভৃতি।
* ইক্যুয়িটি নেগেটিভ পোর্টফোলিওগুলোতে ক্লোজ ইন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড কিনে রাখা যাতে পারে যা তাদেও জন্য ভাল, কারণ নির্দিষ্ট সময় শেষে এই মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো সম্পদ মূল্য আপনাকে ফেরত দিবে। যেমন- পিএইচপি ফাস্ট, ট্রাস্ট ফাস্ট, ইবিএল ফাস্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড প্রভৃতি।
* মার্কেট প্রাইস এবং এনএভি প্রাইস এর পার্থক্য যাদের ভাল এবং যারা ভাল ডিভিডেন্ড দেয় তাদের শেয়ার কেনা যেতে পারে। যেমন- ফার্স্ট জনতা, ফার্স্ট আইসিবি, থার্ড এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড প্রভৃতি।
* ইক্যুয়িটি নেগেটিভ পোর্টফোলিও এর জন্য আইপিও কোটা বরাদ্দ করা যেতে পারে, যাতে করে এই ফান্ড দিয়ে আইপিও আবেদন করে লাভবান হওয়া যায়।
* ইক্যুয়িটি নেগেটিভ পোর্টফোলিও এর টাকা দিয়ে ভাল প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে রাখা যেতে পারে, যাতে করে যখন আইপিও আসবে, কোম্পানীগুলো তখন দ্বিগুন/তিনগুন প্রাইস এ শেয়ার সেল করে রিকভারি করতে পারবে।
* ইক্যুয়িটি নেগেটিভ পোর্টফোলিও এর বিনিয়োগ ভাল কোম্পানীতে বিনিয়োগ  করা যেতে পাওে, যাদের শেয়ার দর ভবিষ্যতে ২গুন/৩গুন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিছু ভাল এনালাইসিস আছে যারা এইটা ঠিক করে দিতে পারে প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

সর্বশেষ, একটা কথা বলতে চাই ‘নো রিস্ক-নো গেইন’। সবাইকে মার্জিন লোনের এর এই দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে হলে সদিচ্ছ থাকতে হবে এবং সেই সাথে পোর্টফোলিও ম্যানেজারকে রিস্ক নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। নতুবা এর থেকে পরিত্রান পাওয়া সত্যিই অসম্ভব।

লেখক: মনজুরুল আলম, র্পোটফোলিও ম্যানেজার


Comment As:

Comment (0)