চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষার সম্ভাবনা

মোঃ শাহ্ নেওয়াজ মজুমদার: মানুষের মেধা ও অতীত শিল্প অভিজ্ঞতা বিরামহীন উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ আমাদের দ্বারপ্রান্তে কড়া নাড়ছে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ । প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বৈপ্লবিক পরিবর্তনকেই বলা হচ্ছে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’। সহজ কথায় ‘ডিজিটাল রেভ্যালুশন’ বলতে আমরা সাধারনত যা বুঝি হাতেকলমে সেটাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এটি একটি মানসিক দক্ষতা ও ডিজিটাল সিস্টেমকে প্রাধান্য দিয়ে একটি শিল্প বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারনাটি প্রথম এপ্রিল ২০১৩ সালে জার্মানিতে  বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৫৮.৫% অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল এবং তাদের মাত্র ৫.৩% বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষিত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে আমাদের মাত্র ০.৩% কর্মসংস্থান হয়েছে। নতুন করে আরো অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই জায়গাটি কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন প্রচুর প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রয়োজন গুণগত ও মানসম্মত তথ্য প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কেউ চাইলেই নিজে তার দক্ষতা বাড়াতে পারে না, দরকার যথোপযুক্ত কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।

একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Intellectual Property)। এখানে সব কিছু বিক্রয় যোগ্য। ইতিমধ্যে আমরা সকলে জানি উবার এর নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই,ফেসবুক এর নিজস্ব কোনো কন্টেন্ট নেই, আলি  বাবার কোনো গুদাম নেই। সব কিছুই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষের চাহদিাকে হাতের নাগালে পৌঁছানো। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হবে অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তির নির্ভরতা।  আর্ন্তজাতিক বানিজ্য হবে হাতের মুঠোয়,সহজেই কেনা-বেচা করা যাবে। আগামী দিনের বাংলাদেশ পৃথিবীর সব উন্নত প্রযুক্তিগুলোকে গ্রহনের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে সুপার কম্পিউটিং  চালকবিহীন গাড়ি কৃত্রিম বুদ্ধিমান রোবট,নিউরো প্রযুক্তির ব্রেন,জেনেটিক প্রযুক্তি দেখতে পাবো। প্রযুক্তির এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের জন্য আমাদেরকে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে।

বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্প বিল্পব, দ্বিতীয় শিল্প বিল্পব শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে, তৃতীয় শিল্প বিল্পব শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালে  ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে। আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,রোবোটিকস,মেশিন লার্নিং,ইন্টারনেট অব থিংক ,বায়ো টেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিলনে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিল্পব। এই শিল্প বিল্পব মোকাবেলায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা শ্রমজীবিদরকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়াতে প্রয়োজন হয় গুনগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের। এ প্রশিক্ষনের প্রথম ধাপ শুরু হয় শিক্ষা গ্রহনের প্রথম থেকে। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে কর্মীতে রূপান্তর হয় এবং উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে কর্মী সম্পদে পরিনত হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম জনশক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের জন্য গুনগত মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন এবং আরো প্রয়োজন সরকারী প্রাতষ্ঠানিক ও ব্যাক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা।

বর্তমান পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধি মত্তা দিয়ে পন্য উৎপাদন,অপারেশন থিয়েটারের কাজ ও আইনি সেবা পর্যন্ত দিচ্ছে। সেক্ষেএে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু দেখতে হবে। পৃথিবীর বড় বড় জায়ান্টরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্যের বা সেবায় উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়েছে ও পণ্যের গুণগত মান উন্নত করেছে। এতে করে তাদের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি বহুগুণে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আমাদের কারিগরি শিক্ষা ও বিশ্ব প্রস্তুতিতে দেখা যায়,জার্মানিতে ১৯৬৯ সালে,সিঙ্গাপুরে ১৯৬০ সালে ও বাংলাদেশে ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছে। অন্যান্য দেশগুলি দ্রুত উন্নতি করলেও আমরা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে কারিগরি শিক্ষার হার ও গুনগত মানেরদিক দিয়ে অন্যদের থেকে অনেক  পিছিয়ে আছি।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সূত্র অনুযায়ী, আমাদের দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮ হাজার ৬৭৫ টি। বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পড়াশোনা করছে। কারিগরি শিক্ষার হারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের মাত্র ১৪% শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে, যেখানে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার জার্মানিতে ৭৩ শতাংশ,জাপান ৬৬শতাংশ,সিঙ্গাপুর ৬৫শতাংশ,অষ্ট্রেলিয়া ৬০শতাংশ,চীন ৫৫শতাংশ,দক্ষিণ কোরিয়া ৫০শতাংশ, মালয়েশিয়া ৪৬ শতাংশ।  অবশ্য আমাদের বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে একটি র্দীঘময়োদী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা ২০২০ সালে ২০% ,২০৩০ সালে ৩০%  এবং ২০৫০ সাল নাগাদ কারিগরি শিক্ষার হার ৫০% এউন্নীত করবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদশে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

শিল্প, কল-কারখানা ও অফিসে এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারনে আগামী ১০ বছর অনেক পেশা হারিয়ে যাবে এবং তৈরি হবে নতুন কর্মক্ষেএ। পিডব্লিউসি জানাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮০ কোটি শ্রমিক চাকুরি হারাবে। স্বভাবত আমাদের  মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। আমাদের দক্ষতাবিহীন সনদভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাড়াবে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের এই কথায় জানান দেয়। প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুন তরুনী বেকারের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙ্গামাটি জেলার বেতবুনিয়ার একটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি দেশের অর্থনীতিকে আধুনিকায়ন করার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন । বর্তমান সরকার তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে র্সবাধকি গুরুত্ব  দিয়ে মহাকাশে উপগ্রহ কেন্দ্র  স্থাপনের মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তির যাত্রাকে বিশ্বের দরবারে আমাদরকে অগ্রগামী করছে।

বর্তমানে আমাদেরকে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন পূর্বক প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষাকে বিস্তৃত করতে হবে।  এখনকার প্রতিষ্ঠিত সকল উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে পূর্ণগঠন করতে হবে। অন্যথায় দেশের শ্রমবাজার আয় বৈষম্য তৈরি হবে। মুষ্টিমেয় কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন লোক অনেক বেশি আয় করবে আর অন্য শ্রমজীবিরা জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় আয়ের ব্যবস্থা করতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হবে।

সরকার দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। আর এখানে প্রচুর কারিগরিভাবে দক্ষ শ্রমিকরে প্রয়োজন হচ্ছে। এই সংগে রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরকে বিদেশে পাঠানোর আগে যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি  পাবে বহুগুন। যা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। তাই আমাদের শিক্ষা মন্ত্রনালয়, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ও হাইটেক পার্কসহ সবাইকে এক হয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিষয়টি মনেপ্রানে অনুধাবন র্পূবক কারগরি শিক্ষার উন্নয়নের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং সরকারকে এ খাতে উন্নয়ন বাজেট বাড়াতে হবে। তা নাহলে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বো এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষনে আমাদরেকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

লেখক: মোঃ শাহ্ নেওয়াজ মজুমদার

হেড অব অপারেশন

ড্যাফোডিল ইনসটিটিউট অব আইটি, চট্রগ্রাম।

(এএনএম/এসএএম/০৮ নভেম্বর ২০২০)


Comment As:

Comment (0)