undefined

মতামত/বিশ্লেষণ

অর্থনীতিতে বিনিয়োগ প্রণোদনা ও পুজিবাজার প্রসঙ্গ

ড: মিহির কুমার রায়ঃ করোনা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ যে গতিতে বাড়ছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গত অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির হিসাব দেখে। পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৫.৭০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছেন উদ্যোক্তারা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৫.৫০ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ফলে বিনিয়োগ বাড়ার ‘দৃশ্যমান’ অগ্রগতি ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে বিনিয়োগ নিবন্ধন পরিস্থিতিতেও গতি সঞ্চার হয়েছে। চলতি বছরের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) দেশী-বিদেশী ১৮৪টি শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড (বিডা)। গতবছরের একই সময়ে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত হয়েছিল মাত্র ৪৬টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ৩৮ হাজার ৯৬৯ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আগামী নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ শীর্ষক সম্মেলন। ঢাকার রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে ২৮ ও ২৯ নভেম্বর দুই দিনব্যাপী এ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন) বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৫৭০ কোটি ২৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এই অংক আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ১৫.৫০ শতাংশ বেশি। অথচ, অর্থবছরের ১০ মাস পর্যন্ত (জুলাই-এপ্রিল) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯.৬ শতাংশ কম ছিল। গত মে মাসেই সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে ১৬.৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় আর অর্থবছরটি শেষ হয় ১৫.৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৩ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ১৯.৫০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই পণ্য আমদানির জন্য এক অর্থবছরে এত বেশি বিদেশী মুদ্রার এলসি খোলা হয়নি। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৫.৭০ বিলিয়ন ডলারের যে এলসি খোলা হয়েছে, সেটাও রেকর্ড। ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য আগের কোন বছরেই এত ডলারের এলসি খোলেননি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা।
অর্থনীতিবিদদের ধারনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে ক্যাপিটাল মেশিনারি। গত দেড় বছর ধরে দেশে করোনা মহামারী চলছে যেখানে সবাই জীবন বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। নতুন বিনিয়োগ-ব্যবসা বাণিজ্য-উৎপাদন নিয়ে খুব একটা ভাবেননি শিল্পোদ্যোক্তারা। কেননা, শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্বই মহামারীর কবলে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সে সব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। সে সব পণ্যের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগের ছক আঁকছেন। আর সে কারণেই ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছেন।

বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন  সম্প্রসারণ করে থাকেন অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে, বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে বিধায় সার্বিক আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়া সত্যিই ভাল দিক, যা অব্যাহত থাকলে মহামারীর ধকল দ্রুত কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। এখানে উল্লেখ্য যে সরকার ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তার বেশিরভাগ বড় উদ্যোক্তারা পেয়েছে আর করোনায় যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ছোট-মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা বঞ্চিত হয়েছে। এখন নতুন করে তাদের সহায়তা দিতে হবে কারন ছোট-মাঝারি শিল্পগুলো ঘুরে না দাঁড়ালে বড় বড় শিল্পগুলোও ধাক্কা খাবে। 

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আগামী নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঢাকার রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে ২৮ ও ২৯ নভেম্বর দুই দিনব্যাপী এ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্দেশ্য বিনিয়োগ প্রসার। ইতোমধ্যে ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং কিছু ইউরোপীয় দেশসহ ১০টি দেশের বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এবং ব্যক্তিকে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হবে যেখানে বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য যে সুবিধাগুলো দেবে তা উপস্থাপন করা হবে।’

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, চামড়া, ফার্মাসিউটিক্যালস, সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যালস উপাদান (এপিআই), লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অটোমোবাইল শিল্প এবং প্লাস্টিকসহ ১৪টি প্রতিশ্রুতিশীল খাতের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা উপস্থাপনের জন্য ১৪টি প্রযুক্তিগত অধিবেশন হবে। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের দেয়া সুবিধাগুলো উপস্থাপন করে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য একটি পৃথক অধিবেশন করবে। এছাড়াও এখানে যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য বিজনেস টু বিজনেস (বি টু বি) অধিবেশনও অনুষ্ঠিত হবে।

র্দীঘময়োদী অর্থায়নের উৎস হিসাবে পুঁজিবাজার র্অথনীতিতে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এখানে উল্লেখ্য, যে দেশের পুঁজিবাজার যত বেশী গভীরতম সে দেশের অর্থনীতি তত বেশী সমৃদ্ধ। যেমন: পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশী থাকে। অর্থনৈতিক বাজারে ঋণের সরবরাহ যেমন এক অর্থ সরবরাহের মাধ্যম হিসাবে গণ্য হয়, সেখানে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়নের তথা অর্থনীতির অর্থ সংগ্রহের বিভিন্ন উপায় (শেয়ার, বন্ড, ঋণের পত্র, কমার্শিয়াল পেপার ইত্যাদি) রয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে যে কোন ধরনের ব্যবসায়ীকে সহজে পুঁজি যোগান দেয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকটাই গতিশীল ও স্থিতিশীল। এর কারন- বাজার মূলধন অনেক বেড়েছে, এখানে নতুন নতুন প্রোডাক্ট যুক্ত হয়েছে, স্বল্প মূলধনী কোম্পানির জন্য আলাদা প্লাটফর্ম করা হয়েছে, পৃথক বন্ড মার্কেট চালু করা হচ্ছে, গ্রীণ বন্ড চালু করা হয়েছে, বাজারের পরিধি বাড়াতে দেশ-বিদেশে মার্কেটিং করা হচ্ছে, পুঁজিবাজারকে বিস্তৃত করতে তৃণমূলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ডিজিটাল বুথ স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক আইন-কানুন করা হয়েছে, বাজারে এখন বিপূল পরিমান বিদেশী বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করছেন।

বাজারকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যেতে আরও অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসিস), যা হলো পুঁজবিাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিনিয়োগ হয় তার মাত্র ১৫ থেকে ১৮% আসে পুঁজিবাজার থেকে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের তুলনায় বাংলাদেশের এ বাজার অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের হলেও গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের ফলে পুঁজিবাজার ও বাজার মূলধন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সকল সূচক ইতিবাচক হওয়ায় পুঁজিবাজার বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন/জিডিপি অনুপাত তুলনামুলক বিচারে অনেক কম রয়েছে, যেমন- বাংলাদেশ (১৭.১৯%), পাকিস্তান (২৫.২০%), ভিয়েতনাম (৫২.২%), জার্মাণী (৬১.৫%), ভারত (৮৯.৬%), যুক্তরাজ্য (৯৮.২%), কানাডা (১৪৩.২%) এবং আমেরিকা (২৬৫.৭%)।

পুঁজিবাজারে পণ্যসমূহকে একত্রে সিকিউরিটিজ নামে অভিহিত করা হয়, যার মধ্যে কোম্পাণী কর্তৃক ইস্যুকৃত শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, সমন্বিত বিনিয়োগ স্কীমে ইউনিট, সম্পদ ভর্তুকি সিকিউরিটিজ, শরিয়ত ভিত্তিক সিকিউরিটিজ (সুকুক) ইত্যাদি রয়েছে। এসব সিকিউরিটিজ এর মাধ্যমে যে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজনে বাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারে, যার ব্যাপকতা আর্থিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশী। আবার প্রাইমারী/সেকেন্ডারী মার্কেট থেকে একই ধরনের সিকিউরিটিজ ইস্যু করে অর্থ উত্তোলন করা যায়। উৎপাদনমূখী শিণ্পে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে নয়; পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন করতে হবে, বড় বড় অবকাঠামোগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত করে এসব প্রকল্পের উন্নয়নে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য একমাত্র পুঁজিবাজারকেই মূল অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিতে হবে, তৃনমূল পর্যায়ের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে জানান দিতে হবে। তাদেরকে ভয়ভীতিমুক্ত পুঁজিবাজার উপহার দিতে হবে, তাদেরকে পুঁজির নিশ্চয়তা দিয়ে বাজারমূখী করতে হবে। এর ফলে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা যেমনভাবে হ্রাস পাবে তেমনি পুঁজিবাজারের বিস্তৃতিও বাড়বে, সহায়ক নীতি সহায়তা ও কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজারের যে অমিত সম্ভাবনা তাকে ফুঁটিয়ে তুলতে হবে। 

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের তারল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে গতিশীল করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ গ্রহন করছে। যার মধ্যে রয়েছে- পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা শিথিল করা, বর্তমানে বিনিয়োগ সীমার বাহিরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক প্রতি ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন, ব্যাংকের জন্য নূতন লভ্যাংশ বিতরণ নীতিমালা (লভ্যাংশ ৩০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশ নগদে প্রদান) ও দীর্ঘমেয়াদী রেপো ও অন্যান্য তারল্য বৃদ্ধির নীতিমালা গ্রহনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে তহবিল পরিচালনার কাজটি সহজ করা যার মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আইনের অনুশাসন পরিপালনে নজরদারির সঙ্গে সঙ্গে এ বাজারের কার্যক্রমে মুদ্রানীতি প্রোগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মাত্রায় তারল্য যোগান বজায় রাখা হয়েছে। পুঁজিবাজারের সমর্থনে বিশেষ পুন:অর্থায়ন কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক অব্যাহত রেখেছে। আগামী দিনগুলোতেও বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মনীতির মধ্যে থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। পুঁজিবাজার ও বীমা খাত নিয়ন্ত্রণকারী  কর্তৃপক্ষগুলোর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নীতি সমন্বয় সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে। পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যু না হওয়া কোম্পানীগুলোতে বিদেশী প্রাইভেট ইক্যুইটি দেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রির জন্য মূল্যায়নে নীট এ্যাসেট ভ্যালুর পরিবর্তে বাস্তবসম্মত বাজারভিত্তিক মূল্যায়ন গ্রহণীয় হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে নির্দেশনা জারি করেছে।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে মোট তিন হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৫.১০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর ৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রপ্তানি চিত্রের বাস্তবতাও সেই আভাস দিচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া ছাড়াও আগামী শীত ও বড়দিন ঘিরে পোশাকের প্রচুর ক্রয়াদেশ পেয়েছে কারখানাগুলো। জুন ও জুলাই মাসে পোশাক খাতে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ক্রয়াদেশ পেয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে বস্ত্র খাতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক চাঙাভাব। বস্ত্রখাতে মোট ৫৮টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত, সম্প্রতি এই খাতের প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেনও বেড়েছে। যদিও এর আগে বেশ কিছু মাস ধরে এই দর বাড়ার দাপট লক্ষ করা যাচ্ছিল দুর্বল ও রুগ্ণ বিমা খাতে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নানা উদ্যোগের ফলে দেশের শেয়ারবাজার এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। জুন-জুলাই মাসের ধারাবাহিকতায় আগস্ট মাসের শুরুতে শেয়ারবাজার সূচকের উত্থানের মধ্য দিয়ে লেনদেন হয়েছে, তাতে ডিএসইর প্রধান সূচক ৬ হাজার ৭০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছে, পাশাপাশি বাজার মূলধন বেড়ে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা শেয়ারবাজারের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। আর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকটিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার পয়েন্ট। এ দুটি সূচকে কয়েক দিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড হচ্ছে। সূচক বৃদ্ধি মানেই আগের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড। আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর পর এটিই সূচক দুটির সর্বোচ্চ অবস্থান। তবে নতুন সূচক চালুর আগে ডিএসই সাধারণ সূচক (ডিজিইএন) ছিল ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক। ওই সূচকের অবস্থান বিবেচনা করলে সূচকের বর্তমান অবস্থান প্রায় এক দশকের সর্বোচ্চ। সূচক সাড়ে ৬ হাজার বা বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার এবং ভবিষ্যতে হয়ত ৮ হাজার পয়েন্টে যাবে। সূচকের এই অবস্থানগুলোকে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লক্ষ করার বিষয় হলো-সূচকটির ইতিহাসে আরও বেশ কয়েকবার এই অবস্থানের কাছাকাছি উন্নীত হয়েছিল।

এরপর ক্রমাগত দরপতনে গত বছর মহামারীর শুরুতে সূচকটি ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসে। এর পর বিএসইসির নেতৃত্বে আসে পরিবর্তন ও নতুন চেয়ারম্যানের সঠিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনায় শেয়ারবাজারে আপতদৃষ্টিতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ফলে চলতি বছরের ৩০ মে সূচক বেড়ে আবার ৬ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে যার ফলে বিনিয়োগকারীরা ফিরে পায় আস্থা। ২০১০ সালের পর যেকোনো সময়ের চেয়ে লেনদেনে আসে গতিশীলতা। লেনদেন এখন ৩ হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। তবে আমাদের শেয়ারবাজার পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় এখনো অনেক অবমূল্যায়িত, এখনো অনেক শেয়ার বিনিয়োগযোগ্য রয়েছে। গত এপ্রিলে মার্জিন ঋণ নীতিমালার পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সে সময় সূচকের সঙ্গে সমন্বয় করে ঋণসীমা নির্ধারণ করা হয়। ডিএসইর প্রধান সূচক-ডিএসইএক্সের ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম না করা পর্যন্ত ঋণসীমা নির্ধারণ করা হয় প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ৮০ টাকা যা আগে ছিল ৫০ টাকা। ঋণসীমা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়ে। কারণ, গ্রাহকদের শেয়ার কেনার সক্ষমতা বাড়ে। এখন ১ লাখ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পায় বিনিয়োগকারীরা। এরপর ওই বিনিয়োগকারীর শেয়ারের দাম যত বাড়বে তার ঋণ নেওয়ার সক্ষমতাও তত বাড়বে। এভাবে ঊর্ধ্বমুখী বাজারে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ বাড়ায় এবং অবশেষে অতি লোভে ঋণের জালে আটকে পড়ে। কারসাজির ঘটনাও বেড়ে যায়। বুঝে শুনে সঠিক সময় শেয়ার বিক্রি করতে না পারলে-ফোর্সড সেলের সম্মুখীন হয়ে সর্বস্বান্ত হয় বিনিয়োগকারীরা।

গত কয়েক মাসে সূচক বেশ বাড়লেও ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারের দাম এখনো অবমূল্যায়িত। এসব শেয়ারের দাম বাড়তে থাকলে সূচকটি আরও তরতর করে বাড়বে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া ৭ হাজার পয়েন্টে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তাই-তো নিয়ন্ত্রক সংস্থা ১২ আগস্ট ফোর্সড সেল বন্ধে সর্বোচ্চ ঋণসুবিধার পরিধি ৭ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার পয়েন্টে উন্নীত করেছে। ফলে আপাতত সূচক বাড়লেও ঋণ সমন্বয়ে শেয়ার বিক্রির চাপ আসবে না। তবে নতুন নির্দেশনায় সূচক ৮ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করলে ঋণসীমা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে ১০০ টাকার বিপরীতে ৫০ টাকায় নেমে আসবে। তখন আবার ঋণ স্বমন্বয়ের সেই ধাক্কা সামলে সূচক কতটুকু স্থায়ী হবে সেটি ভেবে দেখার বিষয়। তাই বিনিয়োগকারীদের সাবধান থাকতে হবে। সূচকের এ ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের নতুন করে ঋণের সক্ষমতা বাড়লেও ঋণ নেওয়া ঠিক হবে কিনা-সেটি ভেবে দেখতে হবে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূচকের সঙ্গে মার্জিন ঋণ বারবার সমন্বয় করে-একটি ঋণনির্ভর বাজার ও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সূচক ধরে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস না করে, ধীরে ধীরে ঋণের আনুপাতিক হার কমিয়ে, বাজারকে ঋণনির্ভরতা থেকে বের করে একটি সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও স্বনির্ভর বাজার গঠনে মনোযোগ দিতে হবে। 
মার্জিন ঋণ অথবা সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণসহ যেকোনো ঋণের টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাজারকে সাময়িক চাঙা করলেও নিঃসন্দেহে বাজারে ঝুঁকি তৈরি করে। যা সুষ্ঠু স্থিতিশীল বাজার গঠনে অন্তরায়। ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়। বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের শেয়ারবাজারের কাঙ্খিত বিকাশ ঘটবে না। শেয়ারবাজার খুবই সংবেদনশীল জায়গা। এখানে অল্পতেই প্রভাব পড়ে। তাই শেয়ারবাজার-অনেক বেড়ে যাওয়া বা লাগাম টেনে ধরা এধরনের অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করে বাজারকে বিতর্কিত করে তোলা থেকে বিরত থাকা উচিত। বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়াই শ্রেয়। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শেয়ারবাজার নিয়ে মন্তব্যের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও সতর্ক থাকতে হবে।

বাংলাদেশ এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। করোনা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় শেয়ারবাজারেও তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা। তাই শেয়ারবাজারে স্বল্পমেয়াদি গতানুগতিক বিনিয়োগ চিন্তা ও অধিক মুনাফার আশায় মার্জিন ঋণ না করে নিজের বিনিয়োগ সক্ষমতা, ব্যাংকের সুদহার, মূল্যস্ফীতি ও কোম্পানির ডিভিডেন্ড ইল্ড পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে ক্যাপিটাল গেইন মাথায় রেখে একটু ভেবেচিন্তে সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীরা দেশের উন্নয়নের সুফল ঘরে নিতে পারবেন।

লেখক: অধ্যাপক, গবেষক, ডীন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)