মিহির

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন: মানবিকতা, নৈতিকতায় ও মনুষ্যত্ব গঠন

ড: মিহির কুমার রায়: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ও জাতি গঠনে রাজনীতির শুরু থেকে শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন যেখানে বলা হয়েছিল শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোকিত মানুষ তৈরি ও মনুষ্যত্ব গঠন এবং এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে;  যাতে সুস্থ চিন্তা মানবিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। এ ধরনের আলোকিত মানুষ সমস্ত সঙ্কীর্ণতা মুক্ত, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা পরিহার করে সমাজ-দেশ ও বিশ্বকে আলোকিত করবে। তিনি এও প্রত্যাশা করেছিলেন,  শিক্ষক সমাজ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনপূর্বক আলোকিত মানুষ উপহার দিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা তাঁর রাজনৈতিক দর্শন থেকে উৎসারিত, যা নিম্নক্ত উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্ট। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোতে শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়, রাষ্ট্রের প্রত্যেকের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে, শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাতে থাকিবে এবং প্রত্যেক নারী, পুরুষের পক্ষে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করিতে হইবে, দেশের সর্বত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া শিক্ষা সহজলভ্য করিতে হইবে,  উচ্চতর শিক্ষা বিশেষ করিয়া কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা কেন্দ্র খুলিতে হইবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সরকারী বৃত্তির সাহায্যে উচ্চ শিক্ষাকে উৎসাহিত করিতে হইবে, মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করিতে হইবে। 

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে বঙ্গবন্ধু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচীর ৯ ও ১০ নং দফায় দলের শিক্ষা নীতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে- (১) দেশের সর্বত্র প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে (২)  শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া বেসরকারী বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয়সমূহে সরকারী সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের দেশে ন্যূনতম শিক্ষা লাভেরও সুযোগ নাই। সিংহলে নিম্নস্তর  থেকে উচ্চতর পর্যন্ত প্রত্যেকেই এম. এ.  ডিগ্রী লাভ পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। অথচ আমাদের দেশে এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা লাভেরও সুযোগ নাই।’ এটা সত্য যে,  আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে শিক্ষা নীতি প্রণয়নের জন্য শরীফ কমিশন গঠন করেন। শরীফ কমিশন রিপোর্টে বাংলা বর্ণমালা বাদ দিয়ে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার্থে জাতীয় বর্ণমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ,  বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা ও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় এর বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ তখন থেকেই আন্দোলন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন  ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতার মাধ্যমে তার প্রমাণ মেলে। ১৯৭০’র নির্বাচনী ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা,  মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ও শিক্ষায় অধিকতর বরাদ্দের বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে রেডিও-টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষা ভাবনা সুস্পষ্টভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন  ‘সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন অক্ষর জ্ঞানহীন। প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি নিরক্ষর লোক বাড়ছে।  জাতির  অর্ধেকের বেশি শিশুকে প্রাথমিক অক্ষর গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে মনে  করি। কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে,  নিরক্ষরতা দূরীকরণসহ ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা দানের জন্য একটা  ‘ক্রাশ’ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে,  মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে, দ্রুত মেডিকেল কলেজ ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সহ দারিদ্র্য যাতে উচ্চ শিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।’ মিজানুর রহমান মিজান  (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঢাকা, নভেল পাবলিকেশন, ১৯৮৯, পৃ. ২৮ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাপূর্ব কালে যা বলেছেন,  স্বাধীনতাত্তোর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তা করছেন। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্র (ক)  একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর  পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দানের জন্য; (খ)  সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ)  আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ সর্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বস্তুত শিক্ষা যে একটি মৌলিক অধিকার,  তা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। সবার জন্য শিক্ষা ব্যতীত জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির যে উপায় নেই,  তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর মধ্যে দেশের ছত্রিশ হাজার একশ’ পনেরোটি প্রাথমিক স্কুল সরকারীকরণ,  এগারো হাজার নতুন প্রাথমিক স্কুল স্থাপন, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ,  মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ,  কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য। উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা-১৯৭৩ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল,  যাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতসহ শিক্ষকগণ চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ পান। এ সমস্ত কর্মকান্ডের পাশাপাশি দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড.  কুদরাত-এ-খুদাকে সভাপতি ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। উক্ত কমিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের উপযোগী নাগরিক তৈরির জন্য যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন,  কমিশনের উচিত সে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা সুপারিশ করা।’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চান, তার প্রতিফলন ঘটে। শিক্ষা বঙ্গবন্ধুর কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,  তিনি একে সমাজ-দেশ গঠনে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ড.  কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের শিক্ষার সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুবীক্ষণ,  জনগণের কাছ থেকে শিক্ষার বিদ্যমান পরিস্থিতি ও তাদের মতামত নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণপূর্বক ১৯৭৪ সালের ৩০ মে ৩৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৪৩০ পৃষ্ঠা সংবলিত  রিপোর্টটি বঙ্গবন্ধু সরকারের নিকট পেশ করেন। এই রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা বেশির ভাগই প্রতিফলিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উক্ত রিপোর্টটি সাদরে গ্রহণ করে রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী একটি বিজ্ঞান মনস্ক,  আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- রূপকল্প ২০২১ কে সামনে রেখে দেশের শিক্ষার হার শত ভাগে উন্নতি করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুল লক্ষ্য ছিল সুস্থ, সবল, চেতনাসমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক,  বৈষম্যহীন মানব সম্পদ সৃষ্টি যা কেবল একটি পরিসুদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থাই দিতে পারে। দেশের সরকার প্রধানের উক্তি সারা জাতীকে শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে অনেক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। যারা বামপন্থী রাজনীতির সংগে সংযুক্ত তারা প্রায়শই বলে থাকেন, অন্য, বস্ত্র,  বাসস্থানের মত শিক্ষাও মানুষের  মৌলিক অধিকার যা মনোবিকাশের পথ উন্মুক্ত করে এবং জীবনের সর্বস্তরের বিষয়াবলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যেমন নৈতিকতাবোধ সৃষ্টিতে, জীবন জগৎকে জাগ্রত করতে,  মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে ইত্যাদি। একজন পন্ডিত বলেছেন কোন ব্যক্তি যদি সম্পদের মালিক হয় তবে তা রক্ষা করতে কেয়ারটেকার রাখার প্রয়োজন হয় যা ব্যয়বহুল,  আর যদি জ্ঞানের অধিকারী হয় তবে সেই জ্ঞানই তাকে সদাসর্বদা পাহাড়া দিয়ে রাখবে যা অর্জিত হয় সু-শিক্ষার মাধ্যমে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির অধ্যাপক টি. ডব্লিউ. সুজ বলেছিলেন- অর্থনীতিতে যত ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগ সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। এই বিষয়গুলোকে অনুধাবন করেই দু’হাজার দশ সালে শিক্ষা নীতি প্রণীত হয়েছিল যা বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে সুধীমহলে আলোচিত।

বর্তমানে বিভিন্ন স্তরের  শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কারের ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বোর্ডগুলো যে চার স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছে তা আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি প্রতিযোগীতামুলক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে যা আমাদের শিক্ষার হার শতকরা ৭২ ভাগ বৃদ্ধির একটি প্রধান নিয়ামক। তাছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারী সংস্থার (এন.জি.ও)  অবদান বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত তৃণমূল পর্যায়ের জনবসতির জন্য গণশিক্ষা কিংবা কর্মমুখী কার্যক্রম আমাদের সার্বিক শিক্ষার হারে বিশষ অবদান রয়েছে। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার বিশেষতঃ মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনের সূযোগ সৃষ্টি,  মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সরকারী সহায়তার প্যাকেজ সৃষ্টি এবং উচ্চ শিক্ষায় বিশেষতঃ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ব্যাপক বৃত্তি আমাদের শিক্ষার হারের বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন যে,  শিক্ষার হার আগের চেয়ে তুলনামূলক বিচারে অনেক বেড়েছে এখন শিক্ষার মানের ব্যাপারে জোড় দেখার সময় এসেছে বিশেষতঃ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ এর কথা বিবেচনায় রেখে। এরি মধ্যে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নকালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন  (আইকিউএসি)  নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে কয়েক বছর যাবত যেখানে বাংলাদেশের বেসিরভাগ সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করছে পর্যায়ক্রমে। তাছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ রুটিনমাফিক পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার মান নিয়ে সকল মহলে যে আলোচনা/সমালোচনা রয়েছে তা কোনভাবেই গোছানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। অনেকেই বলেন বিভিন্ন পর্যায়ে ত্যাগি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন  শিক্ষকের স্বল্পতা চোখে পড়ার মত এবং যারা আছে তাদের পক্ষে বিশাল এই প্রক্রিয়াকে সামাল দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না এবং একটি প্রজন্ম ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ যারা অবসর গ্রহণ করে চলে গেছেন তারা ভাল,  আবার যারা আসছেন তারা পূর্বেকারদের মত ত্যাগী কিংবা জ্ঞানী নন। আবার শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে শিক্ষার্থীবৃন্দ  লাইব্রেরী কিংবা বইমুখী না হয়ে ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে যাওয়ায় জ্ঞানচর্চার  কাজে এক নূতন মাত্রা যোগ হয়েছে যার বেশীরভাগই নেতিবাচক বলে বিবেচিত। অথচ বিশ্বায়নের যুগে এইটির প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না যাতে সরকার তৃণমুল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বাজেট কাঠামোর আওতায় সহায়তা দিয়ে চলছে। তারপরও শিক্ষার মান বেড়েছে তা বাস্তবে প্রতিফলন পরিলক্ষিত নয়। এতে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠান বিপাকে অন্যদিক শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক বিপাকে যদিও উচ্চ মাধ্যমিক জি.পি.এ-৫ পাওয়া ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোঠার চেয়ে অনেক বেশী।

এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের নামি দামী স্কুল ও কলেজগুলো যেগুলোর ঐতিহ্যগতভাবে অবস্থান মফস্বলে, বোর্ড পরিচালিত পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল মেধার ক্রমানুসারে তারা দেশের নির্দিষ্ট স্থানটি অনেক আগেই হারিয়ে বসেছে  এবং এই স্থানটি দখল করে দিয়েছেন  উদীয়মান শহরকেন্দ্রীক কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এইটি সামাজিক বৈষম্যের আরও একটি কুৎসিত রুপ যদিও পত্র পত্রিকায় দেখা যায় অজো পাড়াগায়ের স্কুল কলেজ থেকে দিন মজুরের সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েও আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাবে মেডিক্যাল কিংবা প্রকৌশলে কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও পড়তে অক্ষম হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের উপায় কিভাবে হতে পারে তা নিয়ে তেমন লেখালেখি চোখে পড়ে না। তবে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও গবেষণা সংস্থা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্থা ভাবনা করে। শিক্ষা প্রশাসকরাও জানেন এই প্রতিযোগিতামুলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে শিক্ষিতের হার উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানের দিকেও নজর দিতে হবে কিন্তু কিভাবে?
 
সরকারি কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে প্রতিটি স্কুল কলেজে সৃষ্ট পদের তুলনায় শিক্ষকের পদ অনেক শূন্য রয়েছে এবং যারা কর্মরত তাদের অনেকেই কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে তাদের শিক্ষকতার চাকুরীটি পরিচালনা করেন না আর কি মানের শিক্ষা উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীকে দিচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর্যাপ্ত ক্লাস নিচ্ছেন কিনা সেকথা নাই বললাম। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে অনেক সরকারী স্কুল কলেজ রয়েছে যেখানে এই ঘটনাগুলো বেশী ঘটছে যা দেখভাল  করার কেউ আছে বলে মনে হয় না আপত:দৃষ্টিতে।আসা যাক সরকারী পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত  জেলা পর্যায়ের কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে প্রায়ই দেখা যায় একি সাথে সমান্তরালভাবে চাকুরী পরিচালনা করে কখনওবা ডিপোর্টেশনে বা প্রশাসনের দৃষ্টির অন্তরালে।
এই ধরনের একটি পরিবেশে সরকার প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদোগ নিয়েছে কিন্তু প্রশ্নটি হলো সরকার শিক্ষক কোথায় পাবে এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিচালনার জন্য যেখানে শিক্ষক নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচানয়, মেধার মানদন্ডে নয়। অতিমাত্রায় রাজনীতির উপস্থিতি মেধার লালন ও পালনকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত যা সৃষ্টিশীল ও উদ্ভাবনী কাজের পথে অন্তরায়। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি কাজ শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ।  কোন আমলে পাঠ্যসূচী তৈরী হয়েছে যার কোন আধুনিকায়ন নাই বললেই চলে অথচ বিশাল জমি, দালান,  হোস্টেল ও অন্যান্য অবকাঠামো নিয়ে এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। আসা যায় দেশের বর্তমানে প্রায় ১০৮টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার দিকে যাদের বেশীর ভাগেরই কোন নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই,  নীচ তালায় হোটেল উপরের তালায় বিশ্ববিদ্যালয়। এক অপূর্ব মিশ্রনের সমাহার নিয়ে শিক্ষা বাণিজ্য বর্তমানে জমজমাট। আর মানসম্মত শিক্ষা মোবাইল ফোন ও লেপটপের বেড়াজালে আবদ্ধ।

তাই আগামী দিনের শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ নিয়ে যে সম্ভাবনা রয়েছে তা করার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষার উপযোগী করে তাকে তৈরীকরণ সেটা যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হউক না কেন?  
একজন ভাল শিক্ষক ছাড়া ভাল ছাত্র তৈরি হয় না যা চিরন্তন সত্য কথা এবং এটি তৈরী করার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবারিত সুযোগ থাকলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তেমন কিছুই নাই যা মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায়। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সকল সুযোগ গ্রহণ করে তাদের তৈরী করে সত্যি কিন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজে লাগায় না। আর গবেষণার ক্ষেত্রটি (এম.ফিল, পি.এইচ.ডি ছাত্র গাইড) একেবারেই ক্ষীন হয়ে গেছে অথচ এর জন্য অবকাঠামোগত সুবিধার যেমন সু-বিশাল লাইব্রেরী,  কম্পিউটার ল্যাব, হোস্টেল,  ক্যাফেটেরিয়া ইত্যাদি কোন ঘাটতি নেই। এই জায়গাগুলোতে শিক্ষক নিজে থেকে যদি দায়িত্ব পালনে অপারগ হয় তা কিছু করার থাকে না। কিন্তু প্রশাসনিক কিছু থাকলে শিক্ষকরা তা করতে বাধ্য যেমন পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণা ছাত্র তত্ত্বাবধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া যা বর্তমানে অনুপস্থিত অথচ পাশ্ববর্তি দেশ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এগুলো শত ভাগ পালন করা হয়। আবার শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্কুল/কলেজ পর্যায়ের নিয়মের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্নতা থাকলেও একটি মূল্যায়নের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষতা অনেকাংশে অনুপস্থিত রয়েছে যা অজানা নয়। এখন সরকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শত ভাগ প্রতিফলিত করা তাহলেই বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সংগ্রামের সফল বাস্তবায়ন হবে তার উত্তরসুরী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয়া শেখ হাসিনার হাত ধরে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)