দে ছুট সন্দ্বিপ

নয়নাভিরাম সন্দ্বীপ

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম: হুটহাট করেই ছুটে গিয়েছিলাম নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সন্দ্বীপ। কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো না। ইচ্ছে ছিলো যেখানকার টিকেট পাবো সেদিকেই ছুটব। যাবার দিন ট্রেন, বাস ও জাহাজ সব বাহনেরই টিকেট নাই। নাই নাই নাই। অতঃপর ফকিরাপুলের আরিফ ভাইর বদান্যতায় চিটাগাংয়ের দুটো টিকেট ম্যানেজ হতেই রাকিবকে সঙ্গী করে রাত সাড়ে দশটার বাসে চেপে বসলাম। তখনো মাথায় ঘুরপাক চলছিলো কোথায় যাবো। শেষমেশ কুমিরা গিয়ে রাত প্রায় তিনটায় নেমে যাই। সিএনজি’তে চড়ে কুমিরা নৌ টার্মিনাল ঘাট। ভোর ৭টার আগে ট্রলার/স্পীড বোট কোন কিছুই মিলবে না। কি আর করা। কিছুক্ষণ পায়চারী করে হ্যামোকটা ফ্লোরে বিছিয়ে আমি আর রাকিব ভ্যানগাড়িটাকে খাট ভেবে শুয়ে পড়ি। হ্যামোকের কাপড় ভেদ করে ফ্লোরের হিমহিম ঠান্ডা শরীরে আছড়ে পড়ে। বাহ্ কি আনন্দ। উড়ে এসে জুড়ে বসা কনকনে বাতাস সঙ্গী করে, এপাশ-ওপাশ করতে করতেই ফজরের আযান পড়ে। যাই মসজিদে।  জামাতে নামাজ আদায় শেষে এসে দেখি টার্মিনালে বেশ যাত্রি। সাগরের কোল ঘেঁষা পল্টুনে ভোরের আলোয় হাটি। একদা সাগর-মহাসাগরের বুক চষে বেড়ানো বড় বড় জাহাজগুলো স্ক্রাব করার জন্য এই ঘাটেই নোঙ্গর করে রাখা হয়। স্পীড বোটে চড়ার জন্য ঘাটের সেতুটাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে যেনো আপনি সোজা সাগরের বুকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সেদিন কুয়াশা একটু বেশিই ছিলো। তাই প্রথম বোট ছাড়ল ৭টার বদলে ৮টায়। আমাদের টিকেট প্রাপ্তির সিরিয়াল দেরী হওয়াতে, বোটে চড়তে হলো খানিকটা সময় পরে। বোটে থাকা ছেড়া, নোংরা লাইফজ্যাকেটগুলোই যাত্রিরা সবাই পড়ে নিলাম। বাইশজন যাত্রি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুক চীরে স্পীড বোট মাত্র ২০ মিনিটে নামিয়ে দিলো সন্দ্বীপ নৌ টার্মিনাল ঘাটে। জেটিতে পা রাখতেই বেশ ভাললাগে। টার্মিনালের আশপাশ গোট্টাছড়া ঘাট ও সাগরপারের ম্যানগ্রোভ বেশ হাতছানি দেয়। ভ্যানগাড়িতে না উঠে, হাঁটতে হাঁটতেই সিএনজি স্ট্যান্ডে যাই। ভাড়া দরদাম করে উঠে পড়ি। গন্তব্য কালাপানিয়া।

 

যেতে যেতে পথে পথে থামি। সোদা মাটির ঘ্রাণ নিই। খড়কুটোর সঙ্গে দেহটাকে আলিঙ্গণ করি। কখনোবা আবার তেলে ভাজা মচমচা পরোটা-ভাজি আর মহিষের দুধের দই, মিষ্টি দিয়ে উদোর পুর্তি করি। এরকমটা করতে করতেই পৌঁছে যাই কালাপানিয়া বেড়িবাধঁ। স্থানিয়দের সহায়তায় দ্রুত মেঘনার মোহনার তীরে জনমানব শুন্য নারকেল-খেঁজুর গাছ ঘেরা স্থানে তাঁবু ফেলি। আজকের রাতটা কাটবে এখানেই। তাঁবু টানিয়ে ছুটলাম আশপাশ পরিদর্শনে। ততোক্ষণে একপাল শিশুও আমাদের সঙ্গী। দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ দূর বহুদূর যেথায় যাকনা কেন, স্থানীয়দের সঙ্গে ভাব জমাতে সময় লাগে না তেমন। জুম্মাবার তাই খুব বেশী দূরে যাই না। দেখা হয় প্রায় ৯০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কালাপানিয়া হেদায়েতুল উলুম মাদ্রাসা প্রাঙ্গন। জনশ্রুতি রয়েছে এই মাদ্রাসার কাছাকাছি এসেই মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনের তান্ডব বন্ধ হয়েছিলো। মাদ্রাসার জনৈক হুজুরের আহ্বানে হাজার হাজার গ্রামবাসি বাঁশ পুঁতেছিলো। এরপর আর মেঘনার করাল গ্রাস এদিকটায় আগায়নি। বর্তমানে সেখানে বিশাল চর জেগেছে। স্থানীয় সমাজ কর্মী ওমর ফারুকের ভাষ্যমতে, চরের পরিধি যে হারে বাড়ছে তাতে হয়তো একসময় নোয়াখালি জেলার সঙ্গে গিয়ে ঠেকবে। 

মূল ভূখন্ড হতে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছর ধরেই জনবসতি রয়েছে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামও মুগ্ধ হয়েছিলেন। একসময় এখানে লবণশিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্রশিল্পর খ্যাতি বিশ্বব্যাপি ছিলো। তুর্কি সাম্রাজ্যের সুলতান পর্যন্ত সন্দ্বীপে নির্মীত জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, এখান হতে বেশ কিছু জাহাজ সংগ্রহ করেছিলেন। বহিঃবিশ্বের ভ্রমণতরী ও বাণিজ্যিক জাহাজও সন্দ্বীপে নোঙ্গর ফেলত। সেই সুবাদে পুর্তিগিজদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে সন্দ্বীপের উপর। গড়ে তোলে নিজেদের উপনিবেশ অঞ্চল। এরপর ১৬১৫ সালে পুর্তগিজদের সঙ্গে আরাকান রাজ্যের যুদ্ধে দুইশত সৈন্য সহ পুর্তিগিজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হলে তারা সন্দ্বীপ ছেড়ে গেলে, ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখলে নেয়। এরপর আরাকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতা অস্বীকার করে এ অঞ্চল প্রায় অর্ধ শতাব্দী রাজত্য করে দেলোয়ার খাঁ। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সহ পৃথিবীর অনেক পর্যটক সন্দ্বীপের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এখানটাতে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুগ্ধ না হয়ে কি আর উপায় আছে। বর্তমান সন্দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই অনেকটা অনুমান করা যায়, শতবছর আগের সন্দ্বীপ যে আরো অনেক বেশি প্রকৃতির নৈসর্গিক ভান্ডার ছিলো - তা ভেবে চিন্তে ছাড়াই বলা যায়। 

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের সন্দ্বীপ ক্রমাগত নদী ভাঙনের শিকার হতে হতে বর্তমানে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লাড়াইয়ে অবতির্ন মাত্র ৮০ বর্গমাইল আয়তনের নয়নাভিরাম সন্দ্বীপে – ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য ক্যাম্পিং করে থাকার জন্য কালাপানিয়া, হরিশপুর ও রহমতপুর বেস্ট। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো। সারিসারি নারকেল, খেজুর গাছের ফাঁক গলে দিনে সূর্যের আর রাতে চাঁদের আলোয় মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অপার্থিব সুখে। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? সবুজ ঘাসে শুয়ে-বসে আমার কিন্তু সেরকমটাই মনে হয়েছে। আমি নিশ্চিত সন্দ্বীপের নজর কাড়া প্রাকৃতিক রূপের ভান্ডার, ভ্রমণ পিপাসুদেরকে বিমোহিত করবেই।

যাবেন কীভাবেঃ ঢাকা-চট্টগ্রামের বাসে চড়ে নেমে পড়বেন সিতাকুন্ড উপজেলার কুমিরা। সেখান হতে অটো/সিএনজি করে কুমিরা নৌ টার্মিনাল। সকাল ৭টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সন্দ্বীপে স্পীড বোট চলাচল করে। সন্দ্বীপের গোট্টাছড়া ঘাট হতে সিএনজি’তে চড়ে কালাপানিয়া বেঁড়িবাধঁ, হরিশপুর কিংবা রহমতপুর যাওয়া যাবে।
          
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)