দুর্নীতি দমনে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন
দুর্নীতিবাজদের দমনে এ বিষয়ক সরকারি সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করছে। দুদকের একজন কমিশনার সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘একজন দুইজন তো না, হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ’৷
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১৪ জুন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে' এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, "বিদেশে সম্পদ আছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ কিনেছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা করছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা৷ প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিদেশে সম্পদ গড়া ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষে আছেন আমলারা৷ এছাড়া বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য আছেন৷ অনেকের স্ত্রী আমেরিকায় নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন৷ সন্তানরাও সেখানে পড়াশোনা করছে৷ নিজের পাসপোর্টেও লম্বা মেয়াদে আমেরিকার ভিসা লাগানো আছে৷ এ ধরনের ব্যক্তিরা সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ তাদের কেউ কেউ আমেরিকাকে খুশি করার চেষ্টা করছেন৷”
সংবাদ মাধ্যমে কারও দুর্নীতির খবর ছাপা হওয়ার পর দুদককে নড়ে-চড়ে বসে৷ সরকারি এমন কোনো ব্যবস্থা কি নেই, যা দিয়ে কারও অবৈধ সম্পদ থাকলে সেটা ধরা যায়?
সাবেক সচিব ও যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু আলম শহীদ খান সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেন, "কারো অবৈধ সম্পদ হলে সামাজিকভাবেই সেটা জানা যায়৷ তার চলাফেরা, সন্তানদের পড়াশোনাসহ অনেক কিছুই দেখে প্রতিবেশিরা ধারণা করতে পারেন৷ ফলে কেউ অবৈধ সম্পদের মালিক হলেন সেটা কেউ জানে না, একথা ঠিক না৷ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি আছে৷ তাদের কেউ না কেউ তো জানে৷ কিন্তু সমস্যা হলো এ কথাগুলো কেউ বলেন না৷”। না বলার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, "এর অনেকগুলো কারণে আছে৷ যদি তিনি খুবই প্রভাবশালী হন তাহলে অযথা হয়রানির ভয়ে কেউ বলেন না৷ এ জন্য তো ‘হুইসেল ব্লোয়ার প্রটেকশন অ্যাক্ট করা হয়েছিল৷ কিন্তু গত ১৩ বছরে একজন ব্যক্তিও তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসেন নি৷”
কারও অবৈধ সম্পদের তথ্য সংবাদ মাধ্যমে আসার পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক অনেক ক্ষেত্রেই সময়ক্ষেপন করে৷ আর সেই সুযোগে ওই ব্যক্তি ব্যাংক থেকে টাকা পয়সা নিয়ে বিদেশে চম্পট দিচ্ছেন৷ সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয় গত ৩১ মার্চ৷ তিনি বিদেশে যান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে৷ এরপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দুদক৷ মধ্যে যে এক মাস পেরিয়ে গেছে, এই সময়ে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন৷ দুদুক তদন্তে নেমে এ তথ্য পেয়েছে৷
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বেনজীর আহমেদের কিছু অ্যাকাউন্ট ‘জিরো ব্যালেন্স' হয়ে গেছে, যদিও তিনি পরিমাণ বলতে অস্বীকৃতি জানান৷
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাষ্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এম হাফিজ উদ্দিন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাষ্ট্রীয় যে ব্যবস্থা আছে, তাতে কেউ দুর্নীতি করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই৷ এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাই কিনা? যদি না চাই তাহলে তো বেনজীর আহমেদের মতো টাকা পয়সা তুলে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে৷ আর যদি ব্যবস্থা নিতে চাই তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব৷ সরকারের এত এজেন্সি, তারপর কেউ জানবে না, একজন সরকারি কর্মকর্তা বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদ গড়লেন? এটা হতে পারে না৷ আসলে দুর্নীতি দমনে ছাড় দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না৷ সরকার কঠোর হলেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব৷ এখানে কে আমার ঘনিষ্ট, আর কে ঘনিষ্ট না সেটা দেখা যাবে না৷’
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও এলকপ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, জাতি হিসেবে বিশ্বব্যাপি আমাদেরকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে দূর্ণীতিবাজরা। তাই দূর্ণীতিবাজ যে-ই হোক তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। আর তা করতে না পারলে স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বপ্নই থেকে যাবে, কোনোদিন বাস্তবে রূপ পাবে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকিএসএফ’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. এম খলিকুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্র যদি শক্ত অবস্থানে থাকে তাহলে কোনো অবস্থায়ই দূর্ণীতি বাড়তে পারে না। মাঝেমধ্যে দু/একজনকে ধরলে কোনো স্থায়ী ফল পাওয়া যাবে না। তাই দূর্ণীতি দূর করতে সারাবছর ব্যাপিই রাষ্ট্র ও সমাজকে সোচ্চার থাকতে হবে। আর এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও অগ্রনী ভূমিকা রাখতে হবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দূর্ণীতিবাজদের তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা অনেক হেনস্থার স্বীকার হয়েছেন। এ কারনে গণমাধ্যম কর্মীদের অনেক হামলা-মামলা ও আক্রমনের স্বীকার হতে হয়েছে। এসব ঘটনার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসবের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে দূর্নীতিবাজরা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হচ্ছে আর কোনো ধরনের বাধাহীনভাবে দূর্ণীতি করে যাচ্ছে নির্লজ্জ ও বেহায়ারা। তাই চিহ্নিত ও লুকায়িত দূর্ণীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ব্যবস্থায় নামতে হবে এখনই।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//