এফএওর প্রতিবেদন
বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম সর্বোচ্চ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
ড: মিহির কুমার রায়: আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা বিষয়ক অঙ্গসংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে সার্বিকভাবে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের যে দাম ছিল, তার তুলনায় চলতি ২০২৪ সালের অক্টোবরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এই তথ্য অনুযায়ী, মাংস ব্যতীত প্রায় সবধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। অক্টোবরে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, যা শতকরা হিসেবে ২০২৩ সালের অক্টোবরের তুলনায় ২১ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি, চিনির দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সিরিয়েলের দাম বেড়েছে দশমিক ৮ শতাংশ। বিপরীতভাবে, মাংসের দাম কমেছে গত অক্টোবরে। এফএওর খাদ্য সূচক বলছে, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে বৈশ্বিক বাজারে মাংসের দাম হ্রাস পেয়েছে দশমিক ৩ শতাংশ। তবে তারপরও গত মাসে গড়ে যে দামে মাংস ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে— তা ২০২৩ সালের অক্টোবরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। অক্টোবরে বৈশ্বিক খাদ্যের মূল্য ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে সার্বিকভাবে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। এফএও ফুড প্রাইস ইনডেক্স অক্টোবর মাসে ১২৭.৪ পয়েন্টে পৌঁছায়। এটি এপ্রিল ২০২৩-এর পর থেকে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে বৈরী আবহাওয়া এবং জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা খাদ্য বাজারকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে ভোজ্য তেল।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ:
বাংলাদেশে আরো অবনতি হয়েছে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। আর সেপ্টেম্বরে এ হার খাদ্যপণ্যে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময় শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির তীব্রতা বেড়েছে। অক্টোবরে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে তা ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি নিত্যপণ্যের শুল্কছাড় এবং বাজার তদারকিতে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর পরও তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। উল্টো ভোক্তাদের জন্য পরিস্থিতি দিনে দিনে আরো অসহনীয় হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং এখানে রাজস্বনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্যের সরবরাহ চেইনে শৃঙ্খলা ফেরানোও গুরুত্বপূর্ণ। নইলে শুল্কছাড়ের সুফল ভোক্তার কাছে না পৌঁছে গুটিকয়েক সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জনও দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চাহিদা সংকোচন করা ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার নেই। কিন্তু এতে কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার তদারকি করা হলেও পদক্ষেপ হিসেবে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। প্রতিনিয়ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। উৎপাদন ও আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে একটি বড় সরবরাহ চেইন রয়েছে। এখানে কিছু অংশগ্রহণকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছে। তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে মূল্যস্তর সহনীয় করা যাবে। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা না বাড়িয়ে শুধু তদারকির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’ ২৮ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ অর্থনীতির বহিঃস্থ উপাদানগুলোকে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসেছে মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর কারণেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর প্রচলিত পথেই হাঁটছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা কম। এ কারণে বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের মতো কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের পাশাপাশি কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা না নিয়ে পণ্যমূল্য নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সেভাবে কার্যকরী হয় না।
নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা মূল্যস্ফীতি এখন নীতিনির্ধারকদেরও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। অক্টোবরের মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান প্রকাশের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অর্থ, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া এবং খাদ্য, নিত্যপণ্য ও সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় সাময়িকভাবে একক গ্রাহক ঋণসীমায় ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার নজরদারি বজায় রাখা হলেও এক্ষেত্রে বেশি কঠোর অবস্থানে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, যেটা আমরা ডিমের বাজারে দেখেছি। তাই সরকার বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের তারল্য প্রবাহে লাগাম টানা হয়েছে এবং এতে করে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এক্ষেত্রে এর সুফল পেতে হলে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে।’ বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় ১০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে অভিযান। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযানে যুক্ত হচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। নজরদারির পাশাপাশি কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো বাজারে সবজি বিক্রির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এমনকি নিত্যপণ্যের মূল্যহ্রাসে পেঁয়াজ, চাল, তেল, চিনি, আলু ও ডিমের মতো পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড়ের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে এসব উদ্যোগের সুফল মেলেনি। সরকার পরিবর্তন হলেও সুবিধাভোগীরা আগের মতোই বহাল রয়েছে। অস্থিরতা তৈরির জন্য একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। বাজার তদারকির পদক্ষেপগুলোও দায়সারাভাবে করা হচ্ছে।’ বাজারে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় সরকার চাল আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের পরও পাইকারি বাজারে পণ্যটির দামে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি, উল্টো ১০ দিনের ব্যবধানে মোটা ও মাঝারি চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে। শুল্কছাড় দেয়া অন্যান্য পণ্যের দামও খুব একটা কমতে দেখা যাচ্ছে না। কৃষি অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বলছেন, মৌসুমি কারণেই এ সময়ে দেশে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে থাকে। তাছাড়া এবারের বন্যাও মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল।
সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে, ঋণপত্র বা এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানি করা যাবে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান খাদ্য, নিত্যপণ্য ও সার আমদানি করে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কোনো সীমা থাকবে না। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় গ্রাহকদের জন্য ‘সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট’ প্রযোজ্য রয়েছে। অর্থাৎ একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কোনো ব্যাংক থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ঋণ পায় না। এখন এই সীমাবদ্ধতা তুলে নেওয়ার ফলে বড় আমদানিকারকেরা প্রয়োজনীয় ব্যাংকঋণ পাবেন। এই সুবিধা পাওয়া যাবে খাদ্য ও নিত্যপণ্য এবং সার আমদানির ক্ষেত্রে।
মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উন্নয়ন কোন পথে?
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা সেভাবে না থাকায় বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের মতো কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের মাধ্যমে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্বনীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। পাশাপাশি বাজারকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে তুলতে হবে। এর জন্য কেবল বাজার তদারক করলেই চলবে না। সমস্যার মূল চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে চাহিদামাফিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য উৎপাদন পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে শুল্ক হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা সংশ্লিষ্টরা হরহামেশাই বলে থাকেন। তবে শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে যথাসময়ে শুল্ক কমানো প্রয়োজন। কারণ শুল্ক কমিয়ে তৎক্ষণাৎ এর ফলাফল পাওয়া যায় না। যেহেতু আমদানি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এছাড়া সরবরাহ শৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা থাকলে শুল্ক ছাড়ের সুফল ভোক্তারা পাবে না। শুল্ক ছাড়ের টাকা সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকে যাবে। তাই দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতা থাকলে কেউ সহজে দাম বাড়াতে পারে না। প্রতিযোগিতা কমিশনকে এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। আমদানিকারকদের সংখ্যা বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে যেন বাজার কোনো সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে না পড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে সরকারের রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন আনা। করজালের আওতা বাড়লে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমে যায়। তবে করারোপের ক্ষেত্রগুলো খুব সতর্কভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর আরো আর্থিক চাপ না পড়ে। এছাড়া সরকার বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়াতে পারে। এতে বাজারের চাহিদামাফিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে উৎপাদনশীল খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব। এর প্রভাবে বাজারদর কমে আসতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখালেও বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে সমাধানের পথে হাঁটা হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সবগুলোই ছিল খাপছাড়াভাবে নেয়া। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হলেও বাজেট ছিল সম্প্রসারণমূলক। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এতে বঞ্চিত হয় বেসরকারি খাত এবং এক ধরনের কোণঠাসা অবস্থায় পড়তে হয়েছে খাতটিকে। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া যথোচিত হবে। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতির সমন্বয় ও কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্তর নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//