মিহির

বিশ্ব অর্থনীতি, দারিদ্র্য ও উন্নয়ন ভাবনা

ড: মিহির কুমার রায়: গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে সাফল্য দৃশ্যমান এবং সরকারের পরিকল্পিত উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯- সালে এসে দাড়ায় ৮.১৫ শতাংশ,  এ সময়ে দারিদ্র্যের হার নেমে আসে ২০.৫ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার নেমে আসে ১০.৫ শতাংশ,  মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০৬৪ মার্কিন ডলারে (যা বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার ডলারের কাছাকাছি)। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের ন্যায় বাংলাদেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়, ২০২০-এ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নেমে আসে ৫.২৪ শতাংশে, কর্মসংস্থানেও দেখা যায় ঋণাত্মক প্রভাব। ফলে সাময়িক দারিদ্র্য যায় বেড়ে যা বেসরকারি গবেষনা সংন্থা সিপিডি, ব্রাক,  পিপিআরসি এর গবেষনার ফলাফলে বেরিয়ে আসে যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ। যদিও সরকারের বেশ কিছু দ্রুত সাহসী পদক্ষেপে বাংলাদেশ ফের উন্নয়নের ট্র্যাকে উঠে আসতে সক্ষম হলেও অস্বস্তি রয়ে যায় আয় অসমতার ক্ষেত্রে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে অসমতা দারিদ্র্য হ্রাসের সাফল্যকে ব্যাহত করছে এবং সাম্প্রতিক নানা আলোচনা সত্ত্বেও বিশ্ব জুড়ে অসমতা হ্রাস পায়নি বরংচ কিছু অঞ্চলে বেড়েছে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব / কিছু উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বাংলাদেশও বাদ পরেনি। 

বর্তমান সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতিতে রাজস্ব আয়ের ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি,  রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সংকট হচ্ছে,  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে দ্রব্য মূল্য। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতে করোনার যে অভিঘাত, তা কাটিয়ে ওঠা এখনো সম্ভব হয়নি,  অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক করোনা-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যায় নি এবং তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত এসেছে যুদ্ধ যা সবটাই ধংসাত্বক বিশেষ করে খাদ্য,  জ্বালানি ও সারের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) হিসাব অনুযায়ী,  যুদ্ধ শুরুর পর শুধু এ তিন পণ্যের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির কারণেই নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে পতিত হতে যাচ্ছে ব্ংলাদেশের অন্তত ৫০ লাখ মানুষ। সম্প্রতি বাংলাদেশের দারিদ্র্যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আইএফপিআরআইয়ের এ পর্যবেক্ষণ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ:  ইম্প্যাক্ট অব দি ইউক্রেন অ্যান্ড গ্লোবাল ক্রাইসিস অন পভার্টি অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে যেখানে দেখা যায়, যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য,  জ্বালানি ও সারের দাম দ্রুত বেড়ে চলেছে যার ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের হারে পণ্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, যা এরই মধ্যে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। রুরাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি অ্যানালাইসিস (আরআইএপিএ)  মডেলের ভিত্তিতে পরিচালিত আইএফপিআরআইয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, যুদ্ধের সার্বিক প্রভাবে দেশের প্রকৃত জিডিপি কমেছে দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট, এর চেয়েও বেশি কমেছে কর্মসংস্থান, যার হার ১.৬ শতাংশ, সেক্ষেত্রে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বাড়তে যাচ্ছে ৩.৩ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলেই এ অভিঘাত বেশি স্পষ্ট যেখানে গ্রামীণ দারিদ্র্য বাড়তে যাচ্ছে ৩.৮ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে এ হার ২ শতাংশ।

সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভুট্টা, গম ও ভোজ্য তেলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর চাহিদার বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে বাংলাদেশ যেখানে পণ্যের দাম ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে, আবার স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি পণ্য উৎপাদনের জন্য ফসলি জমিতে ব্যবহার্য সারের ও সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে দাম বেড়েছে যার ধারাবাহিকতায় বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদিত পণ্যের দামও। যুদ্ধের প্রভাব নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের ওপরেই বেশি পড়ছে এবং, দেশে নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নির্ভর করবে যুদ্ধের স্থায়িত্ব এবং বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারাটি থাকার উপর।  দেশে বর্তমানে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক যা ৭.২৫ শতাংশ,  আগামী বছর সাড়ে ৭ শতাংশ হওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে এবং যদি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে নতুন করে দারিদ্র্যের কোনো কারণ নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে মূল্যস্ফীতি, তার প্রভাব গ্রামীণ এলাকায় পড়বেই কারন আগে থেকেই গ্রামীণ এলাকায় শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন,  চলমান যুদ্ধের প্রভাব বৈশ্বিক যার প্রভাব দেশ অনুযায়ী ভিন্ন যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাইরের প্রভাবকগুলোর সাথে পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার সুশাসন ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পর্যায়ে বাজার নজরদারিও বেশ দুর্বল। এতে করে মূল্যস্ফীতি, আয়,  কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর পর গত পাঁচ মাসে ২১ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে এসেছে বলে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)  ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি)  এক সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। দারিদ্র্য সীমার নিচে মানুষ যে পরিমাণেই আসুক না কেন, সেটা শুধু বাইরের প্রভাবকের কারণে না,  এসব বহিঃপ্রভাবকের অভিঘাত নানা দেশে নানা রকমভাবে হচ্ছে যা নির্ভর করছে শক ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরীণভাবে কতটুকু ও কীভাবে করা হচ্ছে। শুধু বহিঃপ্রভাবকের কারণে সংকট প্রকট হচ্ছে,  এমনটা নয়। এর সঙ্গে এখানকার বাজার ব্যবস্থাপনায় জনস্বার্থের বিষয়গুলো কতটুকু দেখা হচ্ছে এবং কতটা দক্ষতার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারি পর্যায়ে যে পদক্ষেপগুলো,  সেগুলো এখন পর্যন্ত সঠিক পথেই আছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তবে শুধু সরকার নয়, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাধারণ মানুষ,  বিশেষ করে উচ্চ আয়ের মানুষের কৃচ্ছতা  সাধনের সচেতনতা বড় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তারা। যদিও বাংলাদেশে বিষয়টির অভাব রয়েছে বলে মূল্যায়নে উঠে এসেছে। তারপরও সরকার এরি মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের বিদেশ ভ্রমণে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে,  বিদ্যুৎ ব্যবহারে সংযমি হতে বলছে, রাত্রি ৮টার পর শপিং মল সহ সকল ব্যবসাহিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলছে,  অপ্রয়োজনীয় যান চলাচলে ঘোষনা এসেছে, যেসব প্রকল্পে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার রয়েছে, সেগুলো ধীরে বাস্তবায়ন করা, আমদানি এলসি মার্জিন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে,  কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংককে  প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে সত্যি কিন্তু এত কিছুর পরও রিজার্ভের ক্ষয়রোধ করা কঠিন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রদর্শিত রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারে নিচে নেমেছে,  প্রতিমাসেই দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে,  ডলারের ব্যবহার কমাতে এসব উদ্যাগ কার্যকর হবে, ভর্তুকির চাপ কমানোর ক্ষেত্রে সারের দাম বাড়ালে ঝুঁকিপূর্ণ হবে এবং সেখানে ইউরিয়ার দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি (কৃষি)  বাড়াতে হবে ইত্যাদি। 

আইএমএফ-এর এক সূত্র মতে, যে পরিমাণ রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে তা থেকে ব্যবহার অযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগকৃত রিজার্ভ রয়েছে ২০০ মিলিয়ন ডলার, চুরি যাওয়া রয়েছে ১০ কোটি ডলার,  এছাড়া রিজার্ভ হিসেবে রক্ষিত স্বর্ণ তাৎক্ষণিক দায় মেটানোতে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এতে করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো দাঁড়ায় বলে ধারণা করা হয়,  যা দিয়ে আমদানি বিল বর্তমান পর্যায়ে থাকলেও আড়াই মাসের মতো মেটানো যাবে। তিন মাসের কম আমদানি বিল মিটানোর রিজার্ভকে বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অবস্থা সামনে রেখে কাতার থেকে এলএনজি কেনার বিল পরিশোধ না করে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও এভাবে সভরেন গ্যারান্টিকৃত আমদানি বিল পরিশোধ পিছিয়ে দেয়ার অবস্থায় বাংলাদেশ নিকট অতীতে পড়েনি আর এতে দেশের দায় পরিশোধে সক্ষমতার রেটিং নিচে নেমে যায়। সে যাই হউক না কেন এর সফলতা নির্ভর করবে জন সাধারন সরকারের ঘোষনার সাথে কতটুকু একাত্বতা দেখাচ্ছে। যদি ধরে নেয়া হয় এখন মনে হচ্ছে যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে না এবং ইউক্রেন কৃষিজাত পণ্যের বড় সরবরাহকারী যা বিঘ্নিত হচ্ছে, গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে,  জ্বালানির দামও বেড়ে যাচ্ছে,  উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও ভুগতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেক ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে যেমন ভর্তুকি বৃদ্ধির বিষয়টি অব্যাহত রাখা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ধরে রাখা যদিও না হলে শিল্পের উপরও চাপ পড়বে, সাধারণ মানুষের সহনশীলতাও বাড়াতে হবে, ভোগ কমিয়ে কৃচ্ছতা সাধনের মানসিকতা তৈরী করতে হবে এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষ ও সরকার উন্নয়নে বিশ্বাসী বিধায় এত বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশের কর্মক্ষম যুবার (১৫-২৯ বছর বয়সী)  সংখ্যা ৪১.২৫ মিলিয়ন। আর এই নির্দিষ্ট বয়স সীমার মধ্যেই বেকারদের সংখ্যা সর্বোচ্চ। অধিকন্তু, শিক্ষা,  কর্ম বা প্রশিক্ষণ কোনোটাতেই জড়িত নেই এমন যুবার হার শতকরা প্রায় ২৭ ভাগ। তাই এদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেয়া হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়, যাতে এদের হার ২০২৫ সাল নাগাদ শতকরা ১২ ভাগে নামিয়ে আনা যায়। এ লক্ষ্যে সরকার ২০২৫ সাল নাগাদ শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন ক্ষেত্রে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ গত এক যুগে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী,  বাংলাদেশ মোট শূন্য দশমিক ৭২৩ স্কোর নিয়ে ১৫৩টি দেশের মধ্যে লুক্সেমবার্গ, ইতালি, কোরিয়া,  জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোকে পেছনে ফেলে ৫০তম স্থান অর্জন করে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে জেন্ডার সমতা অর্জন করেছে, টারশিয়ারি লেভেলেও তা অর্জনের পথে রয়েছে (বর্তমানে তা ০.৭২)। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ দৃঢ়, মহান জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার, সংসদ নেত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ ২০.৮৬ শতাংশ সংসদ সদস্যই নারী। কিন্তু নজর দিতে হবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো শতকরা মাত্র ৩৬ ভাগ। নারীদের ক্ষমতায়নকে মাথায় রেখে সরকার ২০০৯ সাল থেকে জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করে। বর্তমানে জেন্ডার বাজেট মোট জাতীয় বাজেটের ৩০ দশমিক ৮২ শতাংশ,  যা ২০২৫ সাল নাগাদ ৩৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে অষ্টম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায়। নারীর পাশাপাশি বাংলাদেশে অরক্ষিত জনগোষ্ঠী যেমন শিশু,  বয়োবৃদ্ধ, নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়,  অসমর্থ বা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ এবং নিম্ন বর্ণের জনগোষ্ঠীদেরও সুরক্ষা প্রদান। এ জনগোষ্ঠীর সবাই সাধারণত চরম দারিদ্র্য,  প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অন্যান্য অভিঘাতে সহজেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে, যা তাদের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। একইভাবে শিক্ষা,  স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবায়  তাদের অভিগম্যতাও নানা ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আর তাই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মানব সম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন সংশ্লিষ্ট কৌশলে এই সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর বিভিন্ন চাহিদাও প্রাধিকারের বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণে প্রবেশ সুবিধা পায়,  তা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে অধিকতর কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। স্বাস্থ্য সেবার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা হবে,  যাতে প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ জনকে এই সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যায়। দেশের সমতল ভূমির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের ন্যায় একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সপ্তমত,  সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন ও আওতা বৃদ্ধি। এখাতে ব্যয় (সরকারি পেনশন ব্যয় ব্যতীত)  বর্তমানে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ক্রমে বাড়িয়ে ২০২৫ নাগাদ জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ভুলবশত সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি কিংবা যথাযোগ্যদের বাদ পড়ে যাওয়া সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোয় পরিহারের পদক্ষেপ নেয়া হবে।

অষ্টম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় গৃহীত কৌশলগুলো বাস্তবায়ন হলে কভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা সামলেও ২০২৫ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নামিয়ে আনার পাশাপাশি অসমতা হ্রাস পাবে, সুগম হবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১০ নং অভীষ্ট (অসমতা হ্রাস) অর্জনের পথও। সর্বশেষ বলতে চাই, সরকারের সাহসী পদক্ষেপ ও সকলের সহযোগীতায় বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকটের উত্বোরন ঘটাতে পারবে ও ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশের যাওয়ার চুড়ান্ত সনদ পাওয়ার গৌরব অর্জন করতে সমর্থ হবে এই প্রত্যয় রইল।

লেখক: গবেষক ও ডীন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)