মিহির

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ

ড: মিহির কুমার রায়: গত অর্ধ শতকেরও বেশী সময়ে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমকপ্রদ অগ্রগতি হয়েছে, দেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে প্রবেশের দাড়প্রান্তে রয়েছে এবং আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে প্রবেশের স্বপ্ন দেখছে। এর পেছনে অন্যতম বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে  সরকারের বলিষ্ঠ নীতি সহায়তা বনাম সরকারের ধারাবাহিকতা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক দৃশ্যপটে সব কিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে-  এক দিকে চলমান করোনার অভিঘাত (কভিড-১৯)  অন্য দিকে ইউক্রেন রাশীয়ার চলমান যুদ্ধের ফলে বিপর্য্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। তারপরও বিশ্বে উন্নয়ন কর্মকান্ড থেমে থাকেনি এবং দেশগুলো প্রবেশ করছে এক চলমান জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে। যার ফলে সামনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে এবং এই অবস্থায় বাংলাদেশকে টিকে থাকতে  হলে বর্তমান মানব সম্পদের উৎ্পাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়ানোর পূর্ব শর্তই হলো একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মাণ যার ভিত্তি হলো মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত ও কার্যকর জ্ঞান অর্জন করা; যারা যত বেশি প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করতে পারবে, তারাই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হবে। ফলে বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা ও মানোন্নয়নে জোর দেয়া হচ্ছে যার প্রকৃষ্ঠ নিয়ামক হলো ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং পদ্ধতি যেখানে প্রধান সাতটি ক্ষেত্র বিবেচনায় নেয়া হয় যার মধ্যে রয়েছে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চ শিক্ষা,  গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি,  অর্থনীতি ও সহায়ক পরিবেশ। এই অবস্থায় সেখানে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বরাবরই ভালো করছে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো। এবারো শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে সুইজারল্যান্ড, দ্বিতীয় অবস্থানে সুইডেন, তৃতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম পাঁচে আছে স্ক্যান্ডিনেভীয় আরো দুটি দেশ:  ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো করেছে সিঙ্গাপুর যেখানে দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ষষ্ঠ, ভালো অবস্থানে আছে ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন। মূলত প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুবিধা, মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, অত্যাধুনিক উৎ্পাদন প্রক্রিয়া, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা,  দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর সুশাসিত ও জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা দেশগুলোকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে, যা তাদের সাফল্যের মূখ্য বিষয়।

এরি আলোকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থাটা কি তারি একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষনই এই প্রবন্ধের মুল উদ্দেশ্য। আঠারো শতকের মার্কিন শিক্ষাবিদ হরেসম্যান বলেছিলেন, সত্যিকার জ্ঞানে যোগ হওয়া প্রতিটি সংযোজনই মানব শক্তির নবতর সংযোজন। তার এ উক্তি আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, তা আলোচনায় আাসে। বর্তমানে জ্ঞান সূচকে বিবেচ্য সব চলকেই বাংলাদেশের নৈপুণ্য সন্তোসজনক নয়। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক প্রতিভা সূচক ও বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকেও একি পরিস্থিতি বিদ্যমান বলে প্রতিয়মান হয়। ফ্রান্সভিত্তিক বিজনেস স্কুল ইন সিয়েড ও ওয়াশিংটনভিত্তিক পোর্টুল্যান্স ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিভা সূচকে ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ নম্বরে। একইভাবে জাতিসংঘের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন প্রকাশিত সর্বশেষ বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১১৬ নম্বরে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো এ দুটো সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে বাংলাদেশ। এসব তথ্য স্পষ্টত বৈশ্বিক জ্ঞান পরিমন্ডলে দেশের দৈন্য দশাই তুলে ধরে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশ হয়েছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)  ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক। এই তথ্য বলছে,  ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে পাকিস্তান  (১২৩), নেপাল (১২৮) ও আফগানিস্তান (১৫১) এবং এ অঞ্চলে শীর্ষে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট জর্জরিত শ্রীলংকা (৮৬), ভারত ও ভুটান যথাক্রমে ৯৭ ও ১০৮তম স্থানে।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ এবং সময়ের ব্যবধানে দেশে শিক্ষায় অবকাঠামোগত ও সংখ্যাগত বড় উল্লম্ফন হয়েছে যার পরিমান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি যদিও প্রশ্ন উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যেখানে অনুমোদন পাওয়ার পর কোনো ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দেয়া হচ্ছে, এমনকি কোথাও কোথাও শিক্ষক নিয়োগের আগেই চলছে শিক্ষার্থী ভর্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব অবকাঠামোয় ক্লাস শুরুর আগেই কয়েকটি ব্যাচ গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে বের হয়ে যাওয়ার নজিরও দেখা যাচ্ছে। সার্বিকভাবে এখনো একটা জ্ঞানবান্ধব সমাজ গড়ে উঠেছে বলে মনে হয় না্। এর মূলত কারন হলো সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ও ল্যাব সুবিধার স্বল্পতা রয়েছে,  ধুঁকছে উচ্চ মানের শিক্ষক ও উন্নত ব্যবস্থাপনার ঘাটতিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে জ্ঞান চর্চা হওয়ার কথা,  সেখানেও আমরা জ্ঞানের মূল্য দিতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান হচ্ছেন তিনি নিযুক্তি পাচ্ছেন রাজনৈতিক আনুকল্যে,  গবেষণাও হচ্ছেনা, আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনার স্বল্পতা তদুপরি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানান্বেষণায় অনুপ্রাণিত করতে পারছেন না শিক্ষকরা এবং শিক্ষাক্রমও তেমন যুগোপযোগী নয় যা পড়ানো হচ্ছে যার ব্যবহারিক মূল্য সামান্য। অন্যদিকে যার ব্যবহারিক মূল্য আছে, সে জ্ঞান শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছাতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নেই,  জ্ঞান বিকাশের গুরত্বপূর্ণ ধাপ প্রশ্ন-উত্তরের একটা সুস্থ চর্চা গড়ে উঠেনি ইত্যাদি। মোট কথা হলো জ্ঞান চর্চার এক মুক্ত ও সহায়ক পরিবেশের অভাবই জ্ঞান সূচকে আজকের নিম্নগামিতার বড় কারণ। 

এখন গবেষনার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আসছি যা এই সময়ে প্রাসঙ্গিক। কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হলো গবেষণা। কিন্তু দেশের সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় খুব একটা মন নেই অথচ উচ্চ শিক্ষার মান বাড়াতে গবেষণা অন্যতম পূর্ব শর্ত। উন্নত দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাতে এমন অর্থ ব্যয় করা হয়,  যা উল্লেখ করার মতো নয়। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম মাত্র গবেষণা পরিচালনা করা হয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুই-তৃতীয়াংশই নাম মাত্র গবেষণা খাতে খরচ দেখায়। এর প্রমাণ হলো বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায় নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় বরাদ্দ একদম কম। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়,  সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্থান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ,  যেখানে ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়।

যে দেশে যত বেশি গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া,  ভারত ইত্যাদি দেশে পুনঃপুন গবেষণা ছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়,  সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ,  যেখানে ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন,  যারা আর্থিক প্রণোদনা,  মূল্যায়ন ও নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশের মত ঋন্নয়ন অর্থনীতির দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাজেটের বাইরে কেবল গবেষণায় বড় ধরনের বরাদ্দ রাখা সম্ভব। টেকসই ও স্থায়ী  (ভায়াবল) গবেষণার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই আলাদা ভাবে বরাদ্দ রাখতে সক্ষম। তাছাড়া বৈশ্বিকভাবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য  (এসডিজি)  নিয়ে এগোচ্ছে দেশ এবং আর টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত দেশের আসনে উন্নীত হতে গবেষণায় বরাদ্দের বিকল্প নেই। এখন গবেষনা ব্যয়ে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি কি? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণা খাতে সবেচেয়ে বেশি ব্যয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)  যার পরিমান ২০২০ সালে ছিল ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা যদিও প্রকল্প পরিচালনায় বেশ পিছিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেমন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়,  ২০২০ সালে ঢাবি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে ২৩৩টি। ঠিক এই সময় সর্বোচ্চ গবেষণা প্রকল্প (৮২১টি) পরিচালনা করেছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয ২০২০ সালে গবেষণার পেছনে ব্যয় করেছে ৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা,   শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খরচা করে ৪ কোটি টাকা, সে বছর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্,  জাহাঙ্গীর নগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ খাতে ব্যয় ছিল ৩ কোটি টাকার বেশি। ইউজিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী,  ২০২০ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে (৪৬৪টি) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)   ২১৩টি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয় ১৪৩টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর  (বিবিএস)  একটি সমীক্ষায় দেখা যায় গবেষণার কাজে বাংলাদেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ১ টাকাও খরচ করেনি। এর মধ্যে আছে আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণার কাজে কোনো টাকা খরচ করেনি। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি,  বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয় কিন্তু ইউজিসি বলছে এ ব্যাপারে একটা বাধ্য বাধকতা আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক গবেষণা থাকতে হবে।

এ কথা অনস্বিকার্য যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে গবেষনার কোন বিকল্প নেই এবং এর জন্য যা প্রয়োজন তা হলো মৌলিক গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার  এবং পাশাপাশি শিক্ষকরা যাতে গবেষণায় উৎসাহী ও নিয়োজিত হন সে ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও করা যেতে পারে,  যেমন গবেষণায় আলাদা বাজেট দেয়া হলে এর ফলাফল দেশ অবশ্যই পাবে। এখন আমাদের মতো গরিব দেশে এত বাড়তি অর্থ আসবে কোত্থেকে? কিন্তু’ এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক যে অর্থের স্বল্পতা আছে কিন্তু অগ্রাধিকার থাকলেই বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে যা সময়ের দাবি। গবেষণায় বরাদ্দ দেয়ার অর্থ যযথাযথ ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি ও মানসম্পন্ন গবেষণা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)  যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা। পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাঙ্ক্ষিত মানের গবেষণার জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্য করতে হবে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে,  যাতে মেধাবী যারা গবেষণার জন্য বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শেষে ফের দেশে এসে দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী হন। এ জন্য প্রয়োজন তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে রাখার উদ্যোগ নেয়া। ইউজিসিকেও গবেষণার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে,  যাতে কেউ গবেষণা কার্যক্রমে উদাসীন থাকার অবকাশ না পায়। তাহলেই দেশের উচ্চ শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ফিরে আসতে পারে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান সৃজন আর গবেষণাই হলো জ্ঞান সৃজনের প্রধান উপায়। তাছাড়া যে কোনো দেশের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জনজীবনের চাকা সচল রাখতে হলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণার বিকল্প নেই। এ কাজে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিতে হয়। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ শুধু একটা উন্নয়নশীল দেশ নয়, এর অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিগুলোর একটি; স্বল্প সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া তার লক্ষ্য। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যে উন্নত জ্ঞান, প্রযুক্তি, সর্বোপরি জনবল প্রয়োজন তার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় প্রচুর নিজস্ব গবেষণা দরকার। বলাবাহুল্য, বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই জ্ঞান-প্রযুক্তি ও জনবল সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশ তার অভিষ্ঠ লক্ষে পৌছতে পারবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের তৎপর  হতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর,  জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খ্যাতি জোড়া উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। বেশি দূর যেতে হবে না প্রতিবেশী ভারতেও টাটা, আদানি,  আম্বানি প্রভৃতি শিল্প গ্রুপে আন্তর্জাতিক মানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা কেন্দ্রের দেখা মেলে। এদিক থেকে আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা যেন সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের ব্যক্তি খাতকেও উচ্চমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে অর্থায়ন নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে  সেদিকে নজর দিতে হবে। তা হলেই গবেষনার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

লেখক: অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)